ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

এই নির্বাচন করে লাভ কি

Daily Inqilab মুহাম্মদ শাহ আলম

২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদে বিজয়ী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। নির্বাচনে দলটি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৩টি আসন রেখে বাকি আসনগুলো জোটের শরিকদের ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জাপাকে ২৬টি আসন ছাড় দিয়েছে। এই ২৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে জাতীয় পার্টি (জাপা) লাঙ্গল প্রতিক নিয়ে ২৮৩ আসনে লড়াই করবে। এর বাইরে চৌদ্দ দলীয় জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপিকে মোট ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এসব আসেন নৌকার প্রার্থী থাকেছ না। কয়েকিট আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকবেন যার অধিকাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা। এর বাইরে নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত কিংস পার্টিখ্যাত তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে (বিএনএম) কোনও আসনে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। এসব দল নিজেদের মতো করে নির্বাচন করছে। যদিও এসব দল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আশ্বাস ও বিশ্বাস নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে কক্সবাজার, বিএনএমের শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে ফরিদপুর, তৃণমূল বিএনপির শমসের মবিন চৌধুরীকে সিলেট এবং তৈমূর আলম খন্দকারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ভোটে জেতানোর জন্য সরকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবে, এমন স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছে। কারণ, এই দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা এবং ভোটের অবস্থা স¤পর্কে সবাই জানে। যেসব দল নির্বাচন করছে, সেগুলোর প্রার্থী কার্যত আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল। তাদের নিজস্ব কোনো সক্ষমতা এবং ক্যারিশমা নেই। আওয়ামী লীগের সহযোগিতা ছাড়া তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এছাড়া আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম হবে, তা সময়ই বলে দেবে। যেসব দল সরকারি দলের সাথে আসন ভাগাভাগি করে আশা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, সেই নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে বলতেন খেলা হবে। এখন দেশব্যাপী নির্বাচনের খেলা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই খেলা কি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সাথে হচ্ছে, নাকি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হচ্ছে? খোদ নির্বাচন কমিশনেই সন্দেহ আছে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে কিনা! প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ২০ ডিসেম্বর রাজশাহীতে জেলার ছয়টি আসনের প্রার্থীদের নিয়ে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সাথে বলেছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে, সেটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না।

অন্যদিকে, সরকার পতনের একদফা দাবিতে গত ২০ ডিসেম্বর ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ডামি ভোটের খেলা বর্জন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া নেতাকর্মীসহ মিথ্যা ও গায়েবী মামলায় অভিযুক্তগণ মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছ, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক বিশ্বে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে আসন ভাগাভাগি করে একই প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ওই একই দল বা জোটের সদস্য পদে বহাল থেকে ডামি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইতিহাস বিশ্বে দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমাদের জানা নেই। এ নির্বাচন কেমন হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনি গত ১৭ ডিসেম্বর বেসরকারি টিভি চ্যানেল ২৪ কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপিকে ভোটে আনতে সব চেষ্টাই করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি এক রাতে সব নেতাকে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিএনপি এতে রাজি হয়নি। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে বাংলাদেশে আজকে হরতালের দিন গাড়ি চলতো না। গ্রেপ্তার ছাড়া আমাদের অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। বিকল্পও ছিল না। যেটা করেছি আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে দেশের মানুষ সত্যবচন হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকারের একজন মন্ত্রী যখন কোনো বিষয়ে কথা বলেন. তখন বিষয়টিকে হালকা ভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি যে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে তাদেরকে নির্বাচনের বাইরে রাখার কৌশল হিসেবে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে পর অন্তত ৮৩৭টির বেশি হয়রানিমুলক গায়েবি মামলায় ২০ হাজারের বেশি বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে কম করে হলেও ৭৩ হাজার। প্রায় প্রতিদিনই একাধিক মামলার রায় ঘোষণা করছেন আদালত। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে অন্তত ৫৫ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন এক হাজারের বেশি বিএনপির নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে ছয় শতাধিক নেতাকর্মী দুই বছর এবং অনেকে তার চেয়ে বেশি মেয়াদে দ-িত হয়েছেন। ঘোষিত রায়ের অধিকাংশই ২০১৩ ও ২০১৮ সালের রাজনৈতিক মামলা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে এধরনের গণহারে গ্রেফতার এবং সাজার তাৎপর্য রয়েছে। সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন্য দুই বৎসরের কারাদ-ে দ-িত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হইয়া থাকে।

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক বিরোধের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করেন। ফলে আওয়ামী লীগ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাতে ভোট হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নজির খুব একটা নেই। ফলে সরকার এবং সরকার সমর্থক দল ছাড়া কোনো বিরোধীদলই এখন আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী নয়।

নির্বাচন কমিশনের প্রাপ্ত তথ্য মতে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ১৮৯৬ জন প্রার্থী। এই প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৪শ’ প্রার্থী আওয়ামী লীগের, আওয়ামী লীগের ডামি তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী অথবা আওয়ামী লীগের একান্ত অনুগত দলের প্রার্থী। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচনে মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে, যা ক্ষমতা ও পেশি শক্তির লড়াইয়ে পরিণত হওয়ার আশংকা রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী যেমন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করবে, তেমনি স্বতন্ত্র প্রার্থীও বিজয় ছিনিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠবে। যদিও দুই প্রার্থীই আওয়ামী লীগের দলীয় লোক। এমপি নির্বাচিত হওয়ার জন্য তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে যে প্রার্থীই বিজয়ী হোক না কেন, দিন শেষে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য হবেন। ফলে নির্বাচনটি হয়ে পড়েছে প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ ।

লেখক : আইনজীবী


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান