সম্পদ লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্র
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণের সম্পদ লুন্ঠনের শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে অর্থ পাচার ও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কথাবার্তা, লেখালেখি হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আদতে সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের মধ্যে পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট না থাকায় দিন দিন অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ অংশগ্রহনকারী প্রার্থীদের হলফনামায় উত্থাপিত সম্পদের বিবরণ দেখে সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। রাজনীতি এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যদিও নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব বিবরণীতে নানাবিধ গোঁজামিল থাকে, তথাপি বিগত একাদশ নির্বাচন থেকে দ্বাদশ নির্বাচন পর্যন্ত সরকারের অন্তত ১০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ১৩৩শতাংশ থেকে ১০৬৩ শতাংশ পর্যন্ত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও সম্পদের হিসাব বিবরণীকে উপজীব্য করে টিআইবি’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে মন্ত্রী-এমপিদের অকল্পনীয় সম্পদ বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে,’ শিরোনামে টিআইবি’র বিশ্লেষণে দেশের রাজনীতিতে সম্পদ লুন্ঠনের একটি সাধারণ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। টিআইবি’র প্রতিবেদনে মাত্র ৫ বছরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ঢাকা-২০ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থীর ২২৩৮%সম্পদ বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। রাজশাহীর একজন এমপির গত ১৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে দুই লক্ষগুনের বেশি (২৪৩৫১৩%)। হলফনামা অনুসারে ১৮ প্রার্থীর শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা এর বহুগুণ বেশি। টিআইবি’র বিশ্লেষণে এক মন্ত্রীর বিদেশে ২হাজার ৩১২ কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকলেও নির্বাচনী হলফনামায় তার কোনো উল্লেখ নেই।
বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক নেতারাই রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। তারাই দেশের রাজনীতি এবং সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে আমাদের রাজনীতি এবং আইন প্রণেতাদের নেতৃত্ব পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ৮৭ভাগই কোটিপতি। প্রার্থীদের পেশাগত হিসাবে শতকরা ৫৭ ভাগ ব্যবসায়ী। রাজনীতিকের হার শতকরা ৩ ভাগের কম। কোটি টাকার সম্পদ বহুগুণ কম দেখিয়েও সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতির চিত্র আড়াল করতে পারেনি অনেক প্রার্থী। এটি হঠাৎ করেই উন্মোচিত হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি, ব্যাংক জালিয়াতি এবং টাকা পাচারের চিত্র প্রকাশিত হয়ে আসলেও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো সব সময় বিরোধীদলের নেতাকর্মী ও চুনোপুটিদের নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকান্ড সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা অত্যন্ত দু:খ ও হতাশাজনক। ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অর্থনৈতিক লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে দেশ আজ এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এসব লোক দেখানো উন্নয়ন প্রকল্প সাধারণ জনগণের কল্যানে তেমন ভূমিকা রাখতে না পারলেও দেশের উপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে জাতীয় সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতার স্বার্থে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশনার কথাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর আরো তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অনেকে বার বার মন্ত্রী-এমপি হয়ে হাজার, কিংবা লক্ষগুণ ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ালেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা সম্ভবত বেমালুম ভুলে গেছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের শত শত কোটি টাকার অস্বাভাবিক সম্পদের স্ফীতির তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজানা থাকার কথা নয়। মূলত রাষ্ট্রশক্তির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই এক শ্রেণীর মানুষ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এবং বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ফোঁকলা করে দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সাথে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র এক মতবিনিময় সভায় দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে এক দশকে ৯২ হাজার২৬১ কোটি লোপাটের যে চিত্র বেরিয়ে এসেচে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের শৈথিল্য অব্যাহত থাকলে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়নে সবচেয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পদ অর্জনকারী ও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এগিয়ে রাখা হচ্ছে। এ ধরনের বাস্তবতা দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ থেকে উত্তরণ ছাড়া দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার
রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি
দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়
যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের
রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা
বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে
টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে
জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে
৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা
আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি
পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই
তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা
ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের
উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি
২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট
২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের
কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু
১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে
বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো
তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান