ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

গাজার যুদ্ধ নিয়ে এক শ্রেণির আলেমের বিভ্রান্তিকর ফতোয়া

Daily Inqilab ড. মো. কামরুজ্জামান

০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ৪ কোটি মানুষ হতাহত হয়। এতে বিশ্ববাসী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বিশ্বকে যুদ্ধ থেকে বাঁচাতে ১৯২০ সালে জন্ম হয় ‘লিগ অব নেশনস’। কিন্তু ‘লিগ অব নেশনস’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের তাবৎ যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এ যুদ্ধে প্রায় সাত কোটি মানুষ নিহত হয়। যুদ্ধ থামাতে লিগ অব নেশনস কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে বিশ^মোড়লরা কার্যকর নতুন এক সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ প্রেক্ষাপটেই যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে জাতিসংঘের জন্ম হয়। সার্বভৌম দেশগুলোর মধ্যে সমতামূলক নিরাপত্তাবিধান নিশ্চিত করাই হলো জাতিসংঘের লক্ষ্য। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করে। সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাতিসংঘ। আদর্শিক এ ভাবনা থেকে জাতিসংঘের জন্ম হলেও সংস্থাটির জন্মের পরে বিশ্বে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বর্তমানেও বিশ্বে চলমান রয়েছে অনেক যুদ্ধ। দুর্বলদের উপর চলমান রয়েছে বহু সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলো ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমস্যা। এ সমস্যার মৌলিক বিষয় হলো ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তা বিদ্যমান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয় ঘটায় মুসলিম দেশগুলো ইউরোপের অধীনে চলে যায়। ফিলিস্তিনও ইউরোপীয়দের কলোনিতে পরিণত হয়। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত হয়। এ সময় ফিলিস্তিনে মুসলিম সংখ্যা ছিল কয়েক লাখ। আর ইহুদিদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েক হাজার। কিন্তু ব্রিটিশদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে হাজার হাজার ইহুদিকে ফিলিস্তিনে আমদানি করা হয়। এভাবে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানবিশ^ থেকে ইহুদিদের এনে এখানে জড়ো করা হয়। ১৯৪৮ সালে তাদের সংখ্যা ৬ লাখে দাঁড়ায়। তখন মুসলিম সংখ্যা ছিল ২০ লাখ। ভিতরে ভিতরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। ততদিনে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে বসে গেছে। ইহুদি-ব্রিটিশের জোর লবিং বিষয়টিকে নিয়ে যায় জাতিসংঘে। এটা সকলের মনে রাখা দরকার যে, জাতিসংঘ মানেই ইহুদি-খ্রিস্টানদের স্বার্থরক্ষাকারী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। আর এর নিয়ন্ত্রক হলো আমেরিকা ও ইউরোপ। আমেরিকা-ইউরোপ নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন নিয়ে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ প্রস্তাব পাস করে। এ তত্ত্বের ভিত্তিতেই জাতিসংঘ প্রাচীন ফিলিস্তিনকে ভেঙে দুই ভাগ করে। এক ভাগের নাম থাকে ফিলিস্তিন। আর নতুন ভাগের নাম দেয়া হয় ইসরাইল। ২০ লাখ মুসলিমের জন্য জাতিসংঘ জমি বরাদ্দ দেয় মাত্র ৪৩ ভাগ। বিপরীতে মাত্র ৬ লাখ ইহুদির জন্য জমি বরাদ্দ দেয় ৫৭ ভাগ! এভাবেই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের একচোখা নীতির ভিত্তিতে পাস হয় এক অযৌক্তিক প্রস্তাব। জন্ম নেয় একটি অবৈধ রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। রাত তখন ১২টা ১ মিনিট। ইহুদি নেতা দাভিদ বেনগুরিয়ান ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিট পর ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অতঃপর স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন। এ স্বীকৃতির ঠিক ১ ঘণ্টার মধ্যেই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। নেতৃত্বশূন্য আর সমন্বয়হীন আরবরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। ইহুদি সৈন্যরা ফিলিস্তিনের ৫০০টি গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়। ইহুদিরা দুই হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। প্রায় ৮ লাখ মুসলিম দেশ ছাড়া হয়। দীর্ঘ ৭৬ বছরেও তারা তাদের বাড়ি ফিরে পায়নি। আজও তারা বিভিন্ন দেশের বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে! সেদিন থেকে একটি দিনের জন্যও মুসলিমদের উপর ইহুদিদের নিষ্ঠুরতা থামেনি বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটি দিনের জন্যও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক সব রীতি-নীতি উপেক্ষা করে ইসরাইল প্রতিনিয়ত নির্মাণ করেছে দেয়াল। চালিয়েছে তাদের আগ্রাসী অভিযান। জবরদখল আর নৃশংসতায় ফিলিস্তিন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর মৃত্যুপুরিতে। এর প্রতিবাদে জাতিসংঘ শুধু নিন্দা করেই খালাস। ঘটেছে সাময়িক যুদ্ধবিরতি। এমন নিন্দা আর যুদ্ধবিরতি নতুন নয়। হামলা আর যুদ্ধবিরতির ঘটনা ১৯৪৮ থেকেই চলমান। জাতিসংঘের নিন্দায় ফিলিস্তিনিরা পায়নি তাদের অধিকার ও স্বাধীকার। কোনোদিন পায়নি কোনো সুবিচার। বিশ্বনেতারা কখনো তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করেনি। আর এক্ষেত্রে আরব বিশ্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক। ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৮৬ লাখ ৭১ হাজার ১০০ জন। আর ২৫টি আরবদেশের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। এ বিশাল জনসংখ্যার নীরবতা ইসরাইলকে করে তুলেছে ভয়ানক আগ্রাসী। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আরব নেতাদের কোনো ভূমিকাই নাই। বরং তারা একে একে ইসরাইলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন মিত্রচুক্তিতে। এর বিনিময়ে মুসলিম নেতারা পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার।

এই হলো ফিলিস্তিন বিষয়ে ইসরাইলের অবস্থান! এটাই হলো প্রাচীন মুসলিম ফিলিস্তিনের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা। ফিলিস্তিনিদের মাটিতে জাতিসংঘ জায়গা করে দিল ইহুদিদের। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রটি আজো প্রতিষ্ঠিত হলো না। স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ফিলিস্তিন আজো পায়নি। বরং ফিলিস্তিনের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক বণ্টিত জমিটুকুও দখলে নিয়েছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের দাবি হলো, তাদের দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের পদ দিতে হবে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বণ্টিত ৪৩% ভূমি তাদেরকে ফেরত দিতে হবে।

বলা বাহুল্য, ইসরাইল মানেই আমেরিকা। ইসরাইল কার্যত আমেরিকার কলোনি। আর আমেরিকা হলো বিশে^র সুপার পাওয়ার। তাদের রয়েছে বোমারু বিমান, মিসাইল বোট, প্যাট্রোল বোট, সাবমেরিনসহ আধুনিক সকল অস্ত্র। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের আছে শুধু কিছু গুলতি, পাথর আর মাছ ধরার নৌকা। এটা দিয়েই তারা ইসরাইলের মোকাবেলা করে আসছে। বিগত সাড়ে সাত দশকের অধিক সময় ধরে ইসরাইলের উচ্ছেদ অভিযানে নিষ্পেসিত ফিলিস্তিনিরা বড়ই ক্লান্ত। আকাশপথে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমানের হামলা, স্থলপথে ট্যাংক, গানবোট আর কামানের গোলাবর্ষণে প্রতিনিয়ত উড়ে গেছে ফিলিস্তিনিদের হাত, পা, চোখ ও কান। থেতলে গেছে তাদের মাথা। আর ঝলসে গেছে দেহ ও মুখ। বহুতল ভবন নিমিষেই তারা মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সঙ্গে। প্রতিদিনের মিডিয়ায় ভেসে এসেছে ফিলিস্তিনি অবুঝ শিশুদের নিষ্পাপ আর্তনাদ। অথচ, ৮০০ কোটি বিশ্ববিবেক চুপচাপ! প্রতিবাদী পাথর কিংবা গুলতির মধ্যেই ষড়যন্ত্র খুঁজে ফিরেছে বিশ্বমিডিয়া। আর ঝাঁকবাঁধা বোমারু বিমান, ট্যাংক, আর কামানের হামলা হলো ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার!

বিগত ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা শুধু গুলতি আর পাথর দিয়েই ইসরাইলের মোকাবেলা করতো। এর বাইরে তাদের কোনো অস্ত্র ছিল না। এতে ইসরাইলের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ফিলিস্তিন। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর প্রত্যুষে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী হামাস যোদ্ধারা গাজার সীমান্তে ইসরাইল ভূখ-ে প্রবেশ করে। তারা অতর্কিতভাবে ইসরাইলি বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হয়। তারা ২৫০ জন ইসরাইলিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা বিশে^র সেরা। গোটা দেশ সুরক্ষিত। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীর সেরা প্রযুক্তি দিয়ে সুরক্ষিত। অথচ, সবকিছুকে ফাঁকি দিয়ে হামাস ইসরাইলে হামলা চালালো! এতজনকে হত্যা ও বন্দী করে নিজ দেশে নির্বিঘেœ ফিরে এলো হামাস! ইসরাইলের কাছে এটা একটা স্বপ্নের মতো ঘটনা।

এ যেন ভিমরুলের চাকে ছোটো একটি ঢিল ছোঁড়া। ইসরাইল গর্জে উঠলো। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে ঐদিনই তারা গাজায় হামলা শুরু করলো।‎‎‎ গাজা তাবৎ দুনিয়ার মামুলি দরিদ্র্র এক উপত্যকা। আর হামাস সংগঠনটিও পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র বেসরকারি গোষ্ঠি। ইসরাইল ও পশ্চিমা জগতের কাছে হামাস একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। হামাসকে ধ্বংস করতে প্রায় তিন মাস ধরে ইসরাইল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে গোটা গাজা একটি মৃত্যকূপে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে তারা হত্যা করেছে, যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই শিশু ও নারী। বহুতল ভবনকে তারা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালেকে তারা ধ্বংস করেছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। প্রতিদিন গাজায় ১৮০টি শিশু জন্ম নিলেও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এমুহূর্তে গাজায় ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী থাকলেও তারা চিকিৎসা নিতে পারছে না। বুলেট-বোমায় বিধ্বস্ত গাজায় এখন নতুন সংকট শীত ও বর্ষা। দিনে যাইহোক রাত নামলেই জেঁকে বসে কনকনে শীত। হাড় কাঁপানো শীত অথচ গরম কাপড় নেই! আর ক্ষুধার জ্বালাতো আছেই। সবমিলিয়ে নিঃস্ব গাজাবাসী রীতিমতো দিশেহারা। একদিকে ফাঁকা মাঠ, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বালুভূমি আর বিধ্বস্ত জনপদ। অন্যদিকে ফুটপাতেই পলিথিনের তাঁবু খাঁটিয়ে রাত কাটাচ্ছে গাজাবাসী। বৃষ্টি আসলেই সে পলিথিন চুইয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। ভিজে যাচ্ছে মেঝে। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ২৩ লাখ গাজাবাসী খাবারের তীব্র সংকটে পড়েছে। সামান্য খাবারের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বাবা-মা হারা ছোটো ছোটো শিশু। ১০ ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করেও তারা খালি হাতে বাড়ি ফিরছে। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই গাজায়। প্রায় ১ লাখ মানুষের ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকই ৫ বছরের নিচে। পাশপাশি ফুসফুসে ইনফেকশনে ভুগছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে বেশিরভাগ মানুষই মস্তিষ্কের প্রদাহ, হেপাটাইটিসসহ নানান স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রেও ভঙ্গুর দশা। টয়লেট সুবিধা ভোগ করতে পারছে ২২০ জনে মাত্র একজন। অন্যদিকে গড়ে ৪ হাজার ৫০০ জনে মাত্র ১ জন পাচ্ছে গোসলের সুযোগ।

গাজায় সৃষ্ট এসব বিপর্যয়ের জন্য অনেকে হামাসকেই দায়ী করেন। হামাস কর্তৃক ৭ অক্টোবরে হামলাকে নিন্দাযোগ্য বলে মনে করেন। আমেরিকা ও ইউরোপ এটাকে সন্ত্রাসী হামলা বলেই আখ্যা দিয়েছে। অনেক আলেম আমেরিকার সুরে হামাসকে দায়ী করে ফতোয়া দিয়েছেন। অনেকের ফতোয়া এখনও ইউটিউবে ভেসে বেড়াচ্ছে। কোনো কোনো আলেম বা শায়খ হামাস ইসরাইলের সৃষ্টি বলে বিবৃতি দিয়েছেন। আলেমদের কেউ কেউ আবার ‘হামাসের আকিদায় সমস্যা আছে’ বলে ফতোয়া জারি করেছেন। অপ্রাসাঙ্গিকভাবে কিংবদন্তি মুসলিম বীর ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবির (র.) আকিদা ঠিক ছিল না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। আশ্চার্যজনকভাবে ইহুদিদের পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। ইহুদিদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘ইহুদিরা এখন শিরক করে না। তারা মূর্তিপুজা করে না। আর নিয়মও আছে, যে জাতি মূর্তিপুজা করে না তাদেরকে দ্রুত থামিয়ে দেয়া যায় না।’ এসব ফতোয়ায় সাধারণ মুসলিমগণের মাঝে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আমাকে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করেছেন। এসব আলেমকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যায় না। জালিম শাসকের জুলুমের বিরুদ্ধেও তারা কোনো কথা বলেন না। তাদের কথা ও কর্ম ধর্মহীন শাসকদের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। দেশের ১৮ কোটি মানুষ সুদি কারবারের যাঁতাকলে নিষ্পেসিত হলেও তারা অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যাপারে সোচ্চার নন। ১৮ কোটি মুসলিম আজ সাংস্কৃতিক গোলামে পরিণত হলেও এ ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ। দেশে ইসলামী শিক্ষা সংকুচিত হলেও তারা এ ব্যাপারে নীরব দর্শক। দেশে ৬ কোটি তরুণ-তরুণী রয়েছে, যারা ধর্মহীন শিক্ষার কবলে পড়ে বেশামাল-অস্থির। তাদের ব্যাপারেও কোনো পরিকল্পনা দেখা যায় না। তাদের বক্তব্য শুধুই ধর্মীয় গ্রুপের মাঝে নতুন গ্রুপের জন্ম দিচ্ছে। এমতাবস্থায় হামাসের বিপক্ষে ফতোয়া দেয়া সাধারণ মুসলিমরা মেনে নিতে পারছে না। সাধারণ মুসলিমদের বক্তব্য হলো, কেউ যদি কারো বাড়ি দখল করে তাহলে তখন তার করণীয় কী? এর উত্তরে বলা যায়, নিজের বাড়ি পুনরুদ্ধারে নিয়মতান্ত্রিক সকল প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব প্রচেষ্টা জিহাদের অন্তর্ভুক্ত, যার চূড়ান্ত ধাপ হলো সশস্ত্র যুদ্ধ। ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সাল থেকে সকল নিয়ম মেনেই তাদের ভিটেমাটি ফেরত পেতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সকল সংস্থার কাছে তারা ধর্না দিয়েছে। তাদের এসকল প্রক্রিয়াই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। হামাস সদস্যগণ তাদের আচরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমেই তাদের সঠিক আকিদার পরিচয় দিয়েছে মর্মে সাধারণ মুসলিমরা মনে করে। এক্ষেত্রে হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলি নারীর এক চিঠির উল্লেখ করা যেতে পারে। চিঠিতে ড্যানিয়েল অ্যালোনী নামের ঐ ইহুদি নারী তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের জন্য হামাসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ইসরাইলি এক সুন্দরী তরুণী মায়া রিগেভ। ২১ বছর বয়সী ঐ তরুণী হামাসের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রকাশ করেছে। তরুণী হামাস সদস্যের হাতে ৪৯ দিন বন্দী ছিলেন। এত দীর্ঘ দিনে হামাস সদস্যদের ব্যবহার ও ব্যক্তিত্বের কাছে তরুণী নিজেকে সমর্পণ করেছেন। হামাস সদস্যরা সাধারণত সার্বক্ষণিক মুখ ঢেকে রাখে। তরুণী হামাস তরুণের মুখ দেখতে চায়। তার মুখের পর্দা সরাতে অনুরোধ করে। তরুণ হামাস সদস্য জবাবে বলে, আমরা শুধু আল্লাহকেই ভালোবাসি। বন্দীদের সাথে হামাসের এ আচরণ বদর যুদ্ধের বন্দীদের সাথে নবীজির (সা.) আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিপরীতে ইসরাইল ফিলিস্তিনি বন্দীদের সাথে পশুর মতো আচরণ করে আসছে যুগের পর যুগ। সকল নিয়ম ভঙ্গ করে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর আগ্রাসী অভিযান অব্যাহত রেখেছে তারা। বর্তমান যুদ্ধে তারা হামাসের বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে শুধুমাত্র গায়ের জোরে তারা শিশু, নারী ও বেসামরিক লোকদের হত্যা করে চলেছে। এতদিনেও তারা অখ্যাত হামাস গোষ্ঠির অবস্থান সনাক্ত করতে পারেনি। ছোটো একটি শহরের কোথায় ইসরাইলের বন্দীদের হামাস লুকিয়ে রেখেছে তারও কোনো হদিস তারা পায়নি। হামাস যোদ্ধারা তাদের ও গাজার সম্ভাব্য পরিণতির কথা মাথায় রেখেই ইসরাইলে হামলা করেছিল। ইসরাইল ঘোষণা করেছিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গাজাকে নিশ্চিহ্ন করে হামাসকে ধরাশয়ী করা হবে। কিন্তু ইসরাইলের সকল শক্তি ও অহংকার মাটির সাথে মিশে গেছে। হামাসের কৌশলের কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে ইতোমধ্যেই পরাজিত হয়েছে ইসরাইল। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত এখন ইসরাইলি সেনারা। এ যুদ্ধে কয়েক হাজার ইসরাইলি সেনা ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। দশ হাজার ইসরাইলি সেনা এ যুদ্ধে পাগল হয়ে গেছে। দশ হাজার সেনা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। শতাধিক ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার এমপি ও মন্ত্রীদের নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংকারে অবস্থান করছে। ইসরাইলের রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সৈন্য। নিয়মিত সেনা আছে পৌনে দুই লাখ। গাজার চারদিকে বর্তমানে মোতায়েন আছে ৩ লাখ সেনা। অন্যদিকে আকাশ পথে বিমান হামলাতো আছেই। বিপরীতে হামাসের সদস্য সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। যারা কখনও প্রকাশ্যে মাটির উপরে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়নি। মাটির নিচের টানেলে তাদের বসবাস। এ টানেল ধ্বংস করতে ইসরাইল সব উপায় অবলম্বন করে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে তারা টানেল ব্লাস্ট করার শক্তিশালী বোমা ব্যবহার করেছে, কিন্তু পারেনি। অতঃপর তারা শক্তিশালী পানির পাম্প দিয়ে ভূমধ্যসাগর থেকে পানি দিয়ে টানেলে পানি ঢুকিয়ে হামাস বাহিনীকে মারতে চেয়েছে। তাতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এরপর তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর টানেলে প্রেরণ করেছে। কোনোভাবেই তারা হামাসের ক্ষতি করতে পারেনি, পারছে না। আর হামাসের কাছে বন্দী ইসরাইলি নাগরিকদেরও উদ্ধার করতে পারছে না। এমতাবস্থায় ইসরাইল মারাত্মক সংকটে পড়েছে। তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আসছে। হামাস সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হচ্ছে না। হামাসের দাবি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। এই লেখাটি যখন প্রস্তুত করছি তখন ইসরাইলের গোয়েন্দা প্রধান কাতারে অবস্থান করছে। কাতারের আমীরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, এ যুদ্ধে ইসরাইলের চূড়ান্ত পরাজয় হবে। ইতোমধ্যেই ইসরাইল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাল্টা হামলায় ইসরাইলের বিভিন্ন শহর বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসরাইলের প্রধান মিত্র আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে লাখো জনতা ফুঁসে উঠেছে। ২০২৪ সালে আমেরিকায় নির্বাচন হলেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কারো কাছে ভোট চাইতে পারেছেন না। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ঘর থেকে বেরুতে পারছেন না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁরও একই অবস্থা। ওদিকে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইসরাইলি জনগণ নেতানিয়াহুর বাড়ি ঘিরে রেখেছে। সাধারণ ইসরাইলিরা নিরাপদ জীবন যাপনে সাইপ্রাস পাড়ি জমাচ্ছে। অসংখ্য ইহুদি ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এটাই হামাসের বিজয় বলে সাধারণ মুসলিমরা মনে করেন। পরিশেষে বলা যায়, বিশে^র সকল পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে দুর্বল হামাস। কিন্তু পরাজয়ের প্রহর গুনছে পরাশক্তি ইসরাইল-আমেরিকা-ইউরোপ। যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেই চলেছে হামাসের বীর সেনারা। তাদের এ বীরত্ব দেখে মনে পড়ছে বদর, উহুদ ও খন্দকের বিজয়ের কথা। ১৪০০ বছর আগে সাহাবীদের ঈমানের শক্তি শুধু আমাদের কল্পনাতেই স্থান পেতো। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা এখন সেটা বাস্তবেও প্রত্যক্ষ করছি।

লেখক: অধ্যাপক, দা›ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ)
Email: [email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান