ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন কমাতে হবে

Daily Inqilab অমৃত চিছাম

০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

ভূগর্ভস্থ পানি কী? ভূগর্ভস্থ পানি হলো, ভূপৃষ্ঠের নিচে সঞ্চিত পানিসম্পদ, যা প্রধানত ভূপৃষ্ঠের সঞ্চয়িত পানি নিয়ে গঠিত। এই পানি মৃত্তিকা ও তার রন্ধ্রে সঞ্চিত থাকে। ভূগর্ভস্থ পানির উপরের স্তরকে বলে ভূজলপৃষ্ঠ (ধিঃবৎ ঃধনষব)। পৃথিবীর স্বাদুপানির প্রায় ৩০% আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। তবে আহরণযোগ্য সাধু পানির প্রায় ৯৭% আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। নদী জলাশয়ে এই পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। বাদবাকি ৬৯% হিমবাহ আকারে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে সুপেয় পানি দিন দিন ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। কারণ, আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি ব্যবহার করি।

আমরা প্রতিদিন যে হারে সুপেয় পানি উত্তোলন করি, সেই হারে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হয় না। এর অন্যতম প্রধান কারণ দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড। বিশেষ করে, এটা রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি লক্ষনীয়। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মানুষের বাস, তাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি প্রয়োজন। দূষণ, দখল ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীর চারপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি বর্তমানে প্রায় ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ায় প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার ঘরে ও শিল্প-কারখানাসমূহের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মাটির নিচ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয়। অবাক করার মতো বিষয় এই যে, শুধুমাত্র ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, যা দিয়ে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সমান প্রায় ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব।

দেশে বসবাসরত বিশাল জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়, দেশব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, যার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে নানা প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করে উত্তোলনের মাধ্যমে। দেশে ভূগর্ভস্থ পানির উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ হলো- খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, সেচ ও শিল্পক্ষেত্র। দিন দিন দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ও তাদের বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির উপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। সেচ ব্যবস্থার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। অধিক পরিমাণ উত্তোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলোতে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করে।

অত্যাধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামলে সুপেয় পানির সংকট তো দেখা দেবেই। পানি সংকট সরাসরি প্রভাব ফেলবে কৃষি ও শিল্পখাতে। এছাড়াও আশঙ্কা আছে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের। জাতিসংঘের চালানো এক সমীক্ষা হতে দেখা যায়, অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটার, যা পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার নিচে নামে, ২০১০ সালে ৬০ মিটার ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে যা ৭৫ মিটার নিচে নেমে গেছে। ২০৫০ সালের দিকে যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২০ মিটারে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওয়াসার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন ৩৫ লাখ ঘনমিটার, ২০৩০ সালে ৪৩ লাখ ঘনমিটার, ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৫২ লাখ ঘনমিটার পানির প্রয়োজন হবে রাজধানী ঢাকায়। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের অনিয়ন্ত্রিত ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে কিরূপ অবস্থা হতে পারে তা চিন্তা করলেই গাঁ শিহরে উঠে। ঢাকার কেন্দ্রে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় একটি শূন্যস্থান চিহ্নিত করেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। ভূতত্ত্বের ভাষায় উক্ত ঘটনাকে বলা হয় ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’। এ ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’ এর বিস্তৃতি রাজধানী ঢাকার কেন্দ্র হতে শুরু করে আশেপাশের উপজেলাসমূহে। উপজেলাগুলো হলো: টঙ্গী, সাভার, ধামরাই, দোহার ও নবাবগঞ্জ এবং এর বিস্তৃতি প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ বিশাল জায়গা জুড়ে ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’ রয়েছে।

তবে আশার কথা, ভূগর্ভের বালির মধ্যে বিদ্যমান বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যার ফলে এখন পর্যন্ত মারাত্মক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে উক্ত স্থানসমূহ। ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের বিষয়টি নগর-পরিকল্পনা, বসতবাড়ি পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করা দরকার। পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের পানি ৯০ শতাংশ ব্যবহারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নাগরিকদের মাঝে পানির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীর পাশ থেকে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে।

ঢাকার আশপাশের নদীসহ অন্যান্য সকল নদী ও জলাশয় দখল, ভরাট ও দূষণ রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষের সারাদিনে খাওয়ার জন্য দরকার ৫ লিটার, স্যানিটেশনে ২০ লিটার, স্নানের জন্য ১৫ লিটার আর রান্নার জন্য ১০ লিটার, মোট ৫০ লিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬৭৬ বর্গমিটার বাড়ির ছাদের বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারলে তাতে অন্তত ৪০ জন মানুষের সারা বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। আর ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ ।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান