ভোটার উপস্থিতি : ছবি কোনোদিন মিথ্যা বলে না : সিইসির তথ্য এবং ছবির ভাষা
০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
এই কলামটি লিখতে হচ্ছে ৭ জানুয়ারি রোববার। আর ঘটনা চক্রে এই দিনটিতেই অনুষ্ঠিত হলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের ব্যাপারে আমি মোটেই আগ্রহী ছিলাম না। কারণ, এটি নিয়ে বিগত এক মাস ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিস্তর লেখা বেরিয়েছে। অনুরূপভাবে অসংখ্য টকশো হোস্ট করা হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। এছাড়া ফেসবুক এবং ইউটিউবে এই এক মাস ধরে দেশে এবং বিদেশে অনেক লেখা ভাইরাল হয়েছে এবং অনেক সচিত্র মন্তব্য আপলোড করা হয়েছে। অনেক লেখালেখির মধ্যেও একটি সুর ছিল কমন। সেটি হলো, এটি হবে একতরফা নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল ৩ সপ্তাহ আগেই সকলেই জানতেন। অর্থাৎ ফলাফলটি ছিল পূর্ব নির্ধারিত। আমি যখন লিখছি তখন ভোটের কাউন্টিং শুরু হয়েছে। সেই কাউন্টিংয়েও আমি ইন্টারেস্টেড নই। কারণ, বিজ্ঞজনরা যা বলছিলেন, ফলাফল সেই দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সেই মহাজনী পন্থা। সকলেই বলেছেন এবং আমিও ধরেই নিয়েছি যে, আসন ভাগাভাগির এই ইলেকশনে আওয়ামী লীগ তথা নৌকা মার্কা অন্তত দুই তৃতীয়াংশ আসন হাতে রাখবে। দুই তৃতীয়াংশ হয় ২০০। আমার ধারণা ২০০ এর কিছু ওপরে আসন হাতে রেখে অবশিষ্ট আসনগুলো আওয়ামী লীগ তাদের পরগাছা বা প্যারাসাইটদের মাঝে বিলি বণ্টন করবে। তাই ইলেকশন প্রসেস এবং ফলাফলের ওপর শুধুমাত্র আমিই নয়, দেশের সমস্ত শিক্ষিত সচেতন মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। ভোটার টার্ন আউট বা ভোটে উপস্থিতিও খুব বড় ফ্যাক্টর নয়। কারণ, বাস্তব উপস্থিতি যাই হোক, আওয়ামী লীগ সেটিকে ৪০ শতাংশের নিচে আনবে না। তারপরেও ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আমার একটা আগ্রহ ছিল। কারণ, আগের দিন অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি দুপুর থেকেই ঢাকা এবং মফস্বলের একাধিক জেলা থেকে খবর পাচ্ছিলাম যে, ঢাকাসহ ঐসব জেলার রাজপথ একেবারে সুনসান। বনানীতে আমার বড় মেয়ে থাকে। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর ওরা ওদের বাড়িতে অর্থাৎ বনানীতে ফিরে গেল। সাধারণত দিনে বনানী থেকে আমার কলাবাগান বাসায় আসতে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ড্রাইভ। আমাদের দুই বাসায় আসা যাওয়া করতে হলে রাস্তাতেই ৫ ঘণ্টা কাটাতে হয়। এজন্য আমিও আমার মেয়ের বাড়িতে কম যাই, ওরাও আমার বাসায় কম আসে। কিন্তু ৬ তারিখ সন্ধ্যার পর ফিরে গিয়ে আমাকে ফোন দিয়ে ওরা বিস্ময়ের সাথে জানালো যে, ওদের বাসায় গাড়ি গ্যারাজ করতে সময় লেগেছে ২৫ মিনিট। আমার বড় ভাই বগুড়ায় সাত মাথায় একটি চার তলা ভবনের ছাদে উঠে আমাকে ফোনে জানালেন যে, তিনি চারধারে দেখতে পাচ্ছেন শহর সম্পূর্ণ জনশূন্য। গাড়ি ঘোড়া তো দূরের কথা, রিক্সাও চলাচল করছে কদাচিৎ।
ইলেকশনের দিন অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি আমার বড় ভাই ফোনে জানালেন যে, বগুড়া শহরের অন্তত ২০টি নির্বাচন কেন্দ্র তিনি পরিদর্শন করেছেন। বলতে গেলে কোথাও কোনো ভোটার নাই। তার ফোন পেয়ে ভাবলাম, আমি পরের হাতে ঝোল খাব না। নিজেই সরে জমিনে পরিস্থিতি দেখবো। তাই আমি কলাবাগান থেকে ঢাকা মহানগরের অবস্থা জানতে বের হই। প্রায় ৩ ঘণ্টা আমি এই বিশাল মহানগরীর এক প্রান্তে সদরঘাট থেকে অন্য প্রান্ত অর্থাৎ মিরপুর-১০ পর্যন্ত যাই। আমি স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করি যে, ঢাকা মহানগরীতে যেন কারফিউ জারি করা হয়েছে। কলাবাগান লেকসার্কাস প্রভৃতি ভোট কেন্দ্রের বাইরে একটি টেবিল ও চেয়ার নিয়ে বসে আছেন নৌকা মার্কার কর্মীরা। তাদের চার পাশে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন নৌকার কয়েক জন কর্মী। ঈগল, গোলাপ ফুল বা ট্রাক মার্কার কোনো টেবিল চেয়ার বা কর্মী নাই বললেই চলে। সদরঘাট থেকে মিরপুর পর্যন্ত প্রলম্বিত সুদীর্ঘ এলাকা এবং পশ্চিমে জিগাতলা থেকে পূর্বে কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকায় সর্বত্র একই দৃশ্য দৃশ্যমান। বেলা পৌনে তিনটায় আমি বাসায় ফিরে আসি।
আমি যখন বাসা থেকে রওনা হই তখন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের আরেক জন ফ্ল্যাট ওনার ঘরে ফিরছিলেন। দেখা হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? উদ্দেশ্য বলায় হেসে বললেন, কোনো লাভ নাই। কারণ, সর্বত্র আওয়ামী কর্মী ছাড়া কোনো পাবলিক নাই। তারপরেও আমি বের হলাম। আসলেই তাই। মনে হলো ২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের এই বিশাল মহানগরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজপথ এত ফাঁকা যে তরুণ যুবক ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। এরপর ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ৫ শতাংশের ওপর ভোট পড়া সম্ভব নয়।
॥দুই॥
বেলা ৪টার সময় টেলিভিশন এবং আমার ল্যাপটপ কম্পিউটার ওপেন করি। সেখানে অনলাইন পত্রিকাসমূহে একটি খবর দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। নির্বাচন কমিশনের সচিব বলেছেন যে, বেলা ৩টার মধ্যে নাকি ভোট পড়েছে ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ। হতভম্ব এই কারণে হই যে, নিজের চোখকে অবিশ^াস করি কীভাবে? যদি ম্যাক্সিমাম কাস্টিংও হয় তাহলেও ৫ শতাংশের বেশি হবে না। সেখানে ২৭ শতাংশ হয় কীভাবে? যাই হোক, ৪টার সময় ভোটিং ক্লোজড হয়। অর্থাৎ ১ ঘণ্টা মাত্র সময় বাঁকি।
আমার জন্য আরেকটি বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সন্ধ্যা ৭টার সময় কম্পিউটারে দেখি সিইসি হাবিবুল আউয়ালের তথ্য। তিনি বলেছেন, বেলা ৪টার মধ্যে নাকি ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নেই যে, সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত অর্থাৎ ৭ ঘণ্টায় যদি ভোট পড়ে থাকে ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, তাহলে অবশিষ্ট ১ ঘণ্টার মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ শতাংশ ভোট পড়ে কীভাবে? আসলে ভোট পড়েছে কত?
অনুসন্ধানের জন্য কয়েক জনকে নক করলাম। যা ভেবেছিলাম, তাই সত্য। বেশ কয়েক বছর আগে সুদীর্ঘ সময় ধরে আমি দৈনিক ইনকিলাবের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ছিলাম। সেই সুবাদে এখনও কিছুকিছু জানা শোনা আছে। আমি যে তথ্য পেলাম সেটি ছিল আমার জন্য তৃতীয় বিস্ময়।
॥তিন॥
কী ঢাকার বাইরে, কী ঢাকার ভেতর, কোথাও ৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে বলে কেউ বিশ^াস করেন না। আরো কয়েকটি অবাক করা তথ্য। সিদ্ধান্ত ছিল সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হবে এবং শেষ হবে বিকাল ৪টায়। কিন্তু অনেকগুলো সেন্টারে একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার আগে ডিউটিতেই আসেননি। আর ভোটাররাও একজন দুজন করে গুটি গুটি পায়ে এসেছেন। এমনকি বাংলাদেশের কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে একাধিক সেন্টারের নাম বলা হয়েছে যেখানে ভোটার সংখ্যা ৪ হাজার ২০০। সেখানে বেলা ১১টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৫৭টি। কোনো কোনো সেন্টারে তার চেয়েও কম। এই লেখার মধ্যে আমরা ৭ জানুয়ারি ডেইলি স্টারের অনলাইনে প্রকাশিত দুইটি ছবি দিলাম। প্রিয় পাঠক, আপনারা ভালো করে ছবি দুটি দেখুন। আর আপনারাই বিবেচনা করুন, এরপরেও কি ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেটা বিশ^াস করতে হবে?
॥চার॥
এতক্ষণ তো আমার অবজারভেশন বললাম। এবার ৭ জানুয়ারি ডেইলি স্টারের অনলাইনে প্রকাশিত রিপোর্টের অংশ বিশেষ বাংলায় তুলে ধরছি। রিপোর্টটির শিরোনাম, ‘Peaceful’ but not festive: Dhaka wears a deserted look on polls day. অর্থাৎ ‘শান্তিপূর্ণ’ কিন্তু উৎসবমুখর নয় : ভোটের দিন জনশূন্য ঢাকা। ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি ঢাকার কাওরান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় স্মরণী, মগবাজার, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল এবং শাহবাগ এলাকাতে ভরদুপুরে পরিদর্শন করেছেন। তার ভাষায়, কোথাও মনে হচ্ছিল না, যে দেশে বা মহানগরে কোনো ইলেকশন হচ্ছে। সমস্ত রাস্তা জনশূন্য এবং যানবাহন শূন্য ছিল। আরো বলা হয়েছে যে, ইলেকশন বুথগুলোতেও দলীয় সমর্থক এবং তাদের এজেন্ট ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। তেজগাঁও এবং বিজয় স্মরণীর সংযোগকারী রাস্তায় ছেলেরা মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলছিল। রিপোর্ট মোতাবেক সুমন মিয়া নামক একজন রিক্সাওয়ালা বলেন যে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি মাত্র ৩টি ট্রিপ পেয়েছেন। সোলায়মান নামক সিএনজি চালক বলেন যে, ৩ ঘণ্টা এক স্থানে অবস্থান করার পরেও তিনি একটি ট্রিপও পাননি।
৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের রিপোর্ট, কার্জন হল কেন্দ্রে ঢুকে নৌকায় সিল মারল ছাত্রলীগ।
প্রিয় পাঠক, ৭ জানুয়ারি এই ধরনের নির্বাচনের অনেক কারচুপি এবং অনিয়মের খবরে ভরা পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠা। আমরা আজকে ঐ বিষয়ে যাচ্ছি না। আমাদের সেন্ট্রাল ফোকাস হলো ভোটার উপস্থিতি। আমার তো মনে হয় সুধী সমাজ বা নাগরিক সমাজ দাবি তুলতে পারে, কীভাবে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লো? এই ৪০ শতাংশ ভোটের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নির্বাচন কমিশনের নিকট চাওয়া তাদের অধিকার। অতীতে দেখা গেছে, যত ভোট কাস্ট করা হয় বাস্তবে সেটিকে অনেক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়।
প্রিয় পাঠক, যেহেতু রবিবার রাতে এই কলাম লিখছি। তাই এই নির্বাচন সম্পর্কে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া সম্ভব হলো না। আগামী সপ্তাহের কলামে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।
Email: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬
সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল