নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে পরস্পর বিরোধী প্রতিক্রিয়া
১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি একবারেই আলাদা। দেশের ইতিহাসের এর আগের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটির সঙ্গেও এবারেরটির তুলনা চলে না। বিশ্বব্যাপী কূটনীতি পাল্টে গেছে। দেশে দেশে রাজনীতিও বদলে গেছে। গণতন্ত্রের ধাঁচও একেক দেশে একক রকম। যে যার দেশে সুবিধা মতো গণতন্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। তার ওপর স্নায়ুযুদ্ধ গোটা দুনিয়ার কূটনীতি-রাজনীতির খোল নলচে বদলে দিয়েছে। সকালের শত্রুই সন্ধ্যায় বন্ধু। কর্তৃত্ববাদের মুখেই গণতন্ত্রের ছবক। বাংলাদেশে স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষকে কাবু করে নিজেকে এমন উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছেন, যেখানে কেবল সরকার নয়, তাকে বিরোধীদলও ঠিক করে দিতে হয়। রাজনৈতিকভাবে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। এটিকে তার সক্ষমতা বা হেডম হিসেবে দেখার মানুষ আছেন। আবার কর্তত্ববাদ-স্বৈরাচার হিসেবে মূল্যায়নও আছে। বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চীনের আদলে একক কর্তৃত্বের নির্বাচন ও শাসন কায়েম হয়ে যাচ্ছে বলে সমালোচনা তো আছেই। এর মাঝেই তিনি সামনে ধাবমান। পেছনে বা দেশে-বিদেশে কে কী বললো, তা কেয়ার করতে নারাজ। বিশ্বশক্তিগুলোর মন-মর্জিও সেই সমান্তরালে। তার পক্ষে ছোট-বড় কিছুদেশ। বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
নির্বাচনের আগে থেকেই ধারা দুটি স্পষ্ট। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন নিয়ে ছিল সোচ্চার। অন্যদিকে ভারত-চীন-রাশিয়া প্রভৃতি দেশের পক্ষ থেকে ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান। নির্বাচনের পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, সেটা নানা বিবৃতিতেই স্পষ্ট। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েক দেশ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পরপরই শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের বিজয়ে উল্লসিত। এসব দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা কেবল সমর্থন-বিবৃতি নয়, গণভবনে সশরীরে ছুটে যেতেও দেরি করেননি। বেসরকারি ফল প্রকাশের পরই তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
ভোটগ্রহণের আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে রাশিয়ার পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে ওয়াই শুটব বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আয়োজনও চমৎকার ছিল। এই ঘোর সমর্থনের বিপরীতে অবস্থান জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের। তারা মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা ব্যক্ত করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি সহিংস আচরণ পরিহারের আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বিভিন্ন সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বানও জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে। আর যুক্তরাজ্য বলেছে, এ নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মান পূরণ হয়নি। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসÑ এফসিডিওর মুখপাত্র বিবৃতিতে ভোটের আগে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময় এসব মানদ- ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি।’ সব দল অংশ নেয়নি বলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট দেয়ার যথেষ্ট বিকল্প ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিবৃতিতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন মর্মাহত হয়েছে এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেয়ায়। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোটো নিনো জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন মহাসচিব। এ ছাড়া, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওএইচসিএইচআর নির্বাচন নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে সংস্থাটির প্রধান ফলকার টুর্ক বলেছেন, ‘ভোট শুরুর আগের কয়েক মাস হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে বা ভয় দেখানো হয়েছে। এই ধরনের কৌশল সত্যিকারের আন্তরিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়।
এমন প্রতিক্রিয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বা ইইউ কি সম্পর্ক ছিন্ন করবে? বিবৃতিতে কিন্তু, সে ধরনের আভাস-ইঙ্গিত নেই। বরং মানবাধিকার, বাণিজ্য ও উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা আছে। এও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে তারা সকল রাজনৈতিক দলকে তাদের মতপার্থক্য দূর করতে এবং একটি অভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশের নবনির্বাচিত সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দেশের প্রতিশ্রুতি নবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভোলকার তুর্ক।
পক্ষে-বিপক্ষের সব প্রতিক্রিয়াকেই সরকার তার জন্য শুভ মনে করে। দেশে তার প্রতিপক্ষ নেই। আন্তর্জাতিকভাবে বিপক্ষরা নির্বাচনের সমালোচনা করলেও সরকারকে সমর্থন না দেয়া বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো কোনো বার্তা দেয়নি।
স্বাভাবিকভাবেই সরকার এতে নির্ভার। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে বা আরো উন্নত হবে, সেই আশা করে সরকার। সেই মশলা সরকারের কাছে রয়েছেও। সরকার এবং তার ঘরানার কূটনীতিকরা মনে করেন, ভয়ের কিছু নেই। তাদের হিসাব একদম সোজা। ভারতের সাথে জাপানও অভিনন্দন জানিয়েছে। জাপান-ভারতকে ছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্ব ভাবা যায় না। আর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিবৃতিও অনেকটা ভারসাম্যমূলক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ভোটের ২৪ ঘণ্টা পর নির্বাচনকে ‘অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না’ বলে উল্লেখ করলেও এগুলো খুব জোরালো কণ্ঠের দাবি ছিল না। বরং তাদের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কীভাবে ভোটপূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসা যায় তার একটা ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। বিবৃতিগুলোতে ভাষার ব্যবহার এমনভাবে করা হয়েছে তাতে সমন্বয় বা সমতা তৈরির দিকে জোর দেয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তারা নির্বাচন সুষ্ঠু-ফ্রি-ফেয়ার হয়নি বলেছে। ভায়োলেন্সের ব্যাপারে সরকার যেন ইনভেস্টিগেশন করে সেই তাগিদও দিয়েছে। সরকারের সাথে তারা কতগুলো বিষয়ে আগামীতে কাজ করে যাবে বলেও জানিয়েছে। ভায়োলেন্সের ব্যাপারে সরকারকে ইনভেস্টিগেশনের তাগিদটি বেশ ইন্টারেস্টিং। এতে ভায়োলেন্সের অপরাধে নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপিকে আরো শায়েস্তা করার অপশন পেয়ে গেল সরকার। সরকারি মহলের এমন সোজা-সরল সমীকরণের বিপরীত নানা উপাদানও আছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মেরুকরণের একটি পার্ট করে ফেলা হলো কিনা-এটি গুরুতর প্রশ্ন।
এ প্রশ্ন ও শঙ্কা নির্বাচনের আগে থেকে থাকলেও এখন তা আরো জোরালো হয়েছে। বড়দের লড়াইয়ে বাংলাদেশ এক পক্ষ হয়ে গেছে তা আর বলার-বোঝার বাকি নেই। বাংলাদেশের স্বার্থ অন্য কেউ দেখতে থাকা মানে নিজেদের বিপদ নিজেই ডেকে আনা। বাংলাদেশ তা কিভাবে সামলাবেÑ এ প্রশ্নের কিছুটা জবাব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিতে দিয়েছেন। নির্বাচনে জয় উপলক্ষে গণভবনে অভিনন্দন জানাতে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, বিদেশি প্রভুদের পরামর্শ মেনে চললে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। আমাদের কোনো প্রভু নেই বলে দাবি করেন তিনি। তাহলে ভারত, চীন, রাশিয়া কী? প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়: ‘বাংলাদেশের জনগণই আমাদের প্রভু ও শক্তি’। বাস্তবটা কি এমন? এ প্রশ্নে না গিয়ে বলা যায়, রাজনীতির মাঝে প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিতেও একর পর এক মাত করে চলছেন। এর প্রমাণ হিসেবে ধরা হয় চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা নবায়নের আগেই চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের অভিনন্দনের জোয়ারকে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কূটনীতির আরো হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এই হটস্পটের হটচেয়ারে এরই মধ্যে পঞ্চম মেয়াদের জয় উপভোগ করতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নতুন মেয়াদে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে এরই মধ্যে ভারতীয় হাইকমিশনার আশা প্রকাশ করেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূতের ভাষা আরো মায়াবি ও চিত্তাকর্ষক। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে তিনি কেবল অভিনন্দনই জানাননি। বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেয়া, পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো এবং সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে চীন শেখ হাসিনার সরকারের সাথে কাজ করবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। এও বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখে দিতে পাশে থাকবে চীন। রাশিয়া জানিয়েছে মহাতৃপ্তির কথা। সেখানে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া শুধু বিবৃতিতেই সীমিত থাকবে? এর তলে তলে অন্যকিছু থাকতে পারে, সেটা অপেক্ষার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬
সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল