ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

এমন জয় কতটা গৌরবের

Daily Inqilab মোহাম্মদ আবু নোমান

১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

৭ জানুয়ারির ভোটে আওয়ামী লীগের যতটুকু না বিজয় হয়েছে, তার চেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে নৈতিকতার। সেই নৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ অদূর ভবিষ্যতে আর ফিরে পাবে কী? নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে, জনগণ হরতাল আহ্বানকারীদের প্রত্যাখ্যান করেছে, উন্নয়নের পক্ষে জনগণের রায় হয়েছেÑ এ আওয়াজ সর্বত্র। এটা অনস্বীকার্য, উন্নয়ন অবশ্যই লাগবে। কিন্তু গণতন্ত্রের ঘাটতি বাড়িয়ে উন্নয়নকে টেকসই করা কী সম্ভব? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সকল দল ও মতকে আস্থায় নেয়াটাই আসল। সব দিক মিলিয়ে এবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটা নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আরেকবার আইনগতভাবে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু তারা নৈতিক বৈধতার সংকটে পড়ল।

জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে যে কোনো দেশ নানামুখী সঙ্কটে থাকে। নির্বাচনের পর সেসব সঙ্কট কেটে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক ও অস্থিরতা দূর হলো না। বরং তা বেড়ে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। দেশ অর্থনৈতিক সংকটে আছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট যুক্ত হলে তা হবে ভয়াবহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্জন কিছুই হলো না। রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার খুব একটা আশা দেখা যায় না। নতুন বছর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসার কথা। কিন্তু ২০২৪ সাল দেশের মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্তদের জন্য সম্ভাবনা নিয়ে আসবে, নাকি আরও দুর্ভাবনার মধ্যে নিয়ে যাবে, তা আসলে সময়েই বলে দেবে।

সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। দেশের ৭০ ভাগ মানুষেরই ‘নুন আনতে পানতা ফুরানো’র দশা। মুদ্রাস্ফীতি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নি¤œগামী। রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমন ঘটেছে। অনিয়ম, সিন্ডিকেট কারবারি, সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি, ব্যাংক লোপাট, টাকা পাচার ইত্যাদি এখন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গলা চেপে ধরেছে। সাধারণ কর্মজীবী সবার মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে।

গণতন্ত্রের মানেই হলো অর্থপূর্ণ নির্বাচন। একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে গেলে সব দলকে নির্বাচনে আসতে হবে এবং ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকতে হবে। এ দুটোর কোনোটাই এবারের নির্বাচনে দেখা গেল না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর এবারের নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হলো না। দেশ কার্যত দীর্ঘস্থায়ী একটা একদলীয় সরকারব্যবস্থার মধ্যে পড়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই লেখা, আন্দাজ ও অনুমানের পথে চলে না। সেই ধারণা থেকেই বলা যায়Ñ আগামীতেও চলার সম্ভাবনা কম! তার অর্থ, আরো রক্তারক্তি, আরো জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতা ও জনজীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার এই সত্যটাই প্রমাণ করেছে।

একতরফা নির্বাচনের ফলে ভোট ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে। দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বিনিয়োগ আছে। তার চেয়ে বড় ব্যাপার, ইউএসএ ও ইইউ আমাদের গার্মেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের বৃহত্তম বাজার। তারা মুখ ঘুরিয়ে নিলে বা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা দিলে তা বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে। ইরাক, লিবিয়া, মিশর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনকে পরাশক্তিধররা একেক সময় খেলার মাঠে পরিণত করেছিলো। এসব রাষ্ট্রের কোনো কোনোটি কিন্তু আমেরিকা জোটের পরম বন্ধুও ছিল। কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে বন্ধু-বন্ধুভাবে খেলেছে। কিন্তু এক পর্যায়ে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পরাশক্তিধররা খেলার ‘আইচা-বাটি’ গুটিয়ে, ‘মিশাইল’ ও ‘বোমা’ বৃষ্টি ঝরিয়েছে। পরবর্তীতে এসব রাষ্ট্রের পরিণতি কী হয়েছে তা কারো অজানা নয়। এছাড়া উত্তর কোরিয়া, ইরান আর বাংলাদেশ এক কথা নয়। তারা পশ্চিমাদের বাদ দিয়ে কেবল চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে পারছে। বাংলাদেশ তা পারবে কী? বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কোনো একদিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া ঝুঁকিপূর্ণ নয় কী?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস গড়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা নতুন রেকর্ড করে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। টানা চারবার ক্ষমতায় থাকায় একটি দলের নেতাকর্মীর মধ্যে অহংকার, দাম্ভিকতা, হামবড়াই ভাব আসাটাই স্বাভাবিক। নেতা-কর্মীরা জনগণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন। অনেকেই মনে করতে পারেন, ক্ষমতা মানে, সব কিছু আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে। এই মানসিকতা যেন কোনভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক থাকতে হবে। নেতা-কর্মীদের উদ্ধ্যত আচরণ সরকারের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে ২২২ সিট নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি। সরকার হিসাবে শক্তিশালী হয়েছে মাত্র। আর এতে জিতেছে সরকার, হেরেছে বাংলাদেশ, পরাজিত হয়েছে জনগণ। তাহলে এই জয় কতখানি গৌরবের? রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও খাজানা যাদের হাতে ছিলো, পরাজয়ের ভয় কেন তাদের থাকবে? কেন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ আওয়ামী লীগ? সুষ্ঠু ভোট হলে কি এমন ক্ষতি হতো! দেশে আওয়ামী লীগ উন্নয়নমূলক যে কাজ করেছে এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অধিকাংশ সিটে বিজয়ী হয়ে, বুক ফুলিয়ে যে গর্ব করতে পারতো, এখন ২২২ আসন নিয়ে সে গর্ব করতে পারছে কী? শতাধিক সিট অপজিশনের থাকলেও রাজনীতি রাস্তা থেকে সংসদে চলে আসতো। তাতে দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে যেতো এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিজয়ের পসিবিলিটি শেষ হয়ে যেতো না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল