ভয়-ভীতি দূর করতে হবে
১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
দেশের সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই। তারা এক ধরনের ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে। সংকুচিত অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে এই ভয় ঢুকেছে অনেক আগে থেকেই। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা ও জানমালের নিরাপত্তার অভাব, অন্যদিকে উচ্চমূল্য স্ফীতি, আয় কমে যাওয়া, বেকারত্বের ঝুঁকি ইত্যাদি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক সহিংসতায় তারা অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। এই ভয়-ভীতি ও সংকুচিত পরিস্থিতি থেকে তারা কবে মুক্তি পাবে, তা তারা জানে না। বিগত প্রায় দুই বছর অর্থনীতির প্রতিটি সূচক নি¤œমুখী। রিজার্ভের ক্রমাবনতি, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, আমদানি-রফতানিতে ধস, বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিতে সুবাতাস নেই। সামনে অর্থনৈতিক ধস ধেয়ে আসছে বলে ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা স্পষ্ট করে বলেছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কূটনৈতিক সংকট। নতুন সরকারের সড়কপরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি উপলব্ধি করে যথার্থভাবেই বলেছেন, সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই তিনটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। বাস্তবতার নিরিখে তার এ বক্তব্যে দেশের সংকটের স্বীকৃতি রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা। এর সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক সংকট যা নির্বাচনে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে, যাদের সাথে দেশের সিংহভাগ রফতানির সম্পর্ক বিদ্যমান, সেখানে রফতানি হ্রাসের তথ্য রয়েছে, যা উদ্বেগজনক। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম গত বুধবার বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাঁচটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছে। এই ঝুঁকিগুলো হচ্ছে, জ্বালানিস্বল্পতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, সম্পদ ও আয়বৈষম্য, সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং বেকারত্ব। সরকারকে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব সমস্যা সমাধান করা সরকারের জন্য অনেক কঠিন ও জটিল। অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী স্বীকার করে বলেছেন, নতুন সরকারের বড় চিন্তা অর্থনীতি। তার মতে, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভের পতন ঠেকানো, ডলারের প্রকৃত দাম নির্ধারণ, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব বিষয় অর্থনীতির চরম সংকটকেই নির্দেশ করে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকায় অর্থনীতিকে টেনে তোলা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট রফতানিতে ইতোমধ্যে ধস দেখা দিয়েছে। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি আংশকাজনক হারে কমেছে। একইসঙ্গে যুক্তরাজ্য, ইইউ, কানাডা প্রভৃত দেশেও কমছে। কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে এসব বাজার আরও সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। এর পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানি কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিল্প কারখানায়। গ্যাস স্বল্পতার কারণে সরকার গার্মেন্টসহ বড় বড় শিল্প কারখানায় রেশনিং করে সরবরাহ করলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানাগুলো চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না। এতে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এটি বেকারত্ব বৃদ্ধিসহ অর্থনীতিতে বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। গ্যাসের এই সংকট শুধু শিল্পখাতেই নয়, আবাসিক খাতেও চরম আকার ধারণ করেছে। সাধারণ মানুষের নিত্যজীবন কষ্টের মধ্যে পড়েছে। বিল দিয়েও গ্যাস না পাওয়ায় তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও হতাশা কাজ করছে। এছাড়া বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে। ওদিকে, একতরফা নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার অবস্থায় বাংলাদেশ খুব একটা নেই। ব্যাংক খাতও মারাত্মক তারল্য সংকটে রয়েছে। এখাতে বিগত দেড় দশকে এন্তার লুটপাট হয়েছে। খাতটি রুগ্ন হয়ে পড়েছে। সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকখাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এর বড় অংশ পাচার হয়ে গেছে। প্রভাবশালী ব্যবসায়িদের দখলে চলে গেছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়ায় ব্যাংকখাত পরিণত হয়েছে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে। এর ফলে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে, যারা সরকার ও অর্থনীতিকে ঘিরে থাকে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে পড়ে তাদের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য ও ভীতিকর হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট যেকোনো দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করায়। সরকার স্বীকার করুক বা না করুক, বাস্তবতা হচ্ছে, দেশ এখন এই ত্রিশঙ্কুর মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীতা, সুশাসন, মানবাধিকারের সাথে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কূটনৈতিক সুসম্পর্কÑএকটির সাথে আরেকটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এসব মৌলিক বিষয় অস্থিতিশীল ও ভারসাম্যহীন হলেই দেশের বিপদ এবং সাধারণ মানুষের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশ এখন এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের নানা আপত্তি সত্ত্বেও সরকার প্রধান বিরোধীদলসহ অন্য বিরোধীদলগুলোকে বাইরে রেখে নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়েছে। এসব সংকট সরকার কি করে মোকাবেলা করে, তাই এখন দেখার বিষয়। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ যে একধরনের শঙ্কার পরিবেশে রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। এই শঙ্কা ও ভয়ের পরিবেশ দূর করে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। কি করে বিরোধীদলগুলোকে আস্তায় নিয়ে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেদিকেও মনোযোগী হতে হবে। দেশের রাজনীতির সাথে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং কূটনীতিও যুক্ত হয়ে গেছে। বিষয়টি উপলব্ধি করে যথোচিত উদ্যোগ-পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। এমন সুষম পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে দেশ সর্বপ্রকার শঙ্কামুক্ত ও মানুষ স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল
ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা
মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা
বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা