মানবাধিকার লংঘন রোধ করতে হবে
১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক বিরোধী দল, গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপ প্রভৃতি বরাবরই সোচ্চার। তারা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশ বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত রেখেছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে, এমন আশা মহলগুলোর ছিল। তাদের এই ধারণাও দৃঢ়মূল ছিল যে, ওই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের অর্থবহ উন্নয়ন ও অগ্রগতি হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকারের লংঘন শূন্য বা প্রায় শূন্য অবস্থানে নেমে আসবে। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আগের দু’ নির্বাচনের মতই। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা শুধু বাড়েনি, বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক বিরোধীদলগুলো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা, গ্রেফতার-সাজা ইত্যাদির তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ নির্বাচন ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের পূর্বতন অবস্থানই ব্যক্ত করেছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোও তাদের মতই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। লক্ষ করা গেছে, গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিরোধীদলগুলোর বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর প্রচ- দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। ঢালাওভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা দেয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীর কারণে কারাগারে স্থান সংকুলান হয়নি। তাদের খাওয়া-দাওয়া-থাকা-শোয়াসহ নিত্যকর্মের অকল্পনীয় অসুবিধা হয়েছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মারাও গেছে। এখনও তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কারাবন্দি নেতাকর্মীরা এখনো দমবন্ধকরা জীবনযাপন করছে বলে অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, সমস্ত মৌলিক মানবাধিকার অধিকার হরণ করে নিপীড়নের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রয়োগ করা হয়েছে। তিনি কারগারকে হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারাগারে কয়েক সপ্তাহে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যার কথাও উল্লেখ করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, এ যাবৎ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার আচরণ ও চন্ডনীতি প্রয়োগের অনেক সমলোচনা হয়েছে। তাদের বেপরোয়া ভূমিকা এবং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করার প্রবণতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত রোববার ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা সেটা মানছে না। অভিযুক্ত আসামিকে মিডিয়ার সামনে হাজির করে তাদের আপরাধের বিবরণ দেয়া হচ্ছে। দায়ী করা হচ্ছে। পরে তদন্তে তাদের অনেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছে। মানবাধিকার আইনজীবী জি আই খান পান্না বলেছেন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা এরকম নিউজ ব্রিফিং করতে পারে না। এটা সাবজুডিস ও মানবাধিকার লংঘন। গত রোববারই বিভিন্ন দৈনিকে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. নাজমুল মৃধা তার বাবার জানাজায় অংশ নিয়েছে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায়। ওই সময় হাতকড়া খুলে দেয়া হলেও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয়া হয়নি। মো. নাজমুল মৃধা ছাত্র, কোনো বিপদজনক অপরাধী নয়। এই বিবেচনাটুকুও আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা করতে পারেনি। এর আগেও ডান্ডাবেড়ির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে আইনী নির্দেশনা আছে। সেটা অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না। যেমন এক্ষেত্রেও হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলেছে, ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সহিংসতা চালানো হয়েছে। উল্লেখ করেছে, বিএনপির ৮ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে সরকার। মানবাধিকার প্রসঙ্গে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে অন্তত ৬০০ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু ফেরত এসেছে, কিছু বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে এবং এখনো ১০০’র মতো নিখোঁজ রয়েছে। সংস্থাটি এও উল্লেখ করতে ভোলেনি যে, গুম, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার খুব কমই তদন্ত হয়েছে। এসব কারণে ২০২১ সালে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর তুলে নিয়ে যাওয়া কমে যায়। ওদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ৬টি নাগরিক সংগঠন। সংগঠনগুলো হলো : এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন, ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, এশিয়ান ডেমোক্রেসি নেটওয়ার্ক, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিজ প্রজেক্ট (অস্ট্রেলিয়া) এবং অ্যান্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক। তারা বিবৃবিতে বলেছে, নির্বাচন যথাযথ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকÑ কোনোটাই হয়নি। তারা আরো বলেছে, নির্বাচন সামনে রেখে যথোচ্ছভাবে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ এবং রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের ঘটনা ঘটেছে, যা উদ্বেগজনক, ভয় দেখানো, পরোয়ানা ছাড়া হয়রানি, গ্রেফতার, বিরোধী রাজনীতিক ও তাদের সমর্থকদের ওপর সহিংসতা হয়েছে, যার দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
আগেই বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক বিশ্ব তার নীতি অবস্থান বহাল রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হয়নি। সহিংসতার কথাও বলা হয়েছে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের অভিমতেও ভিন্নতা নেই। লক্ষ করার বিষয়, গণতান্ত্রিক বিশ্ব এবং মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোর অভিমতের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উল্লেখে আগেই বলা হয়েছে, মানবাধিকার লংঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখনো সে নিষেধাজ্ঞা বহাল। অন্যদিকে নির্বাচনে বাধাদান সংক্রান্ত বিষয়ে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যা রাজনীতিকসহ বিচারবিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য বলে উল্লেখ করা হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে এবং মানধাধিকার পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি না ঘটলে বাণিজ্যসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আসতে পারে বলে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেরকম কিছু হলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর মধ্যেই একটি নেতিবাচক খবর এসেছে। কংগো থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহার করা হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশের সদস্যও আছে। প্রত্যাহতদের অন্যত্র বহাল করা হবে কিনা, জানা যায়নি। তারা ফেরৎ এলে তাদের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি, সন্দেহ নেই। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। এমন কোনো সূচক নেই, যা আশাব্যঞ্জক। রিজার্ভ সংকট, ডলার সংকট, আমদানি-রফতানি হ্রাস, রেমিট্যান্সে পতন, জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অবনতিশীল নাগরিক জীবনযাপন ইত্যাদি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। এই প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা এলে বিপর্যয়ের শেষ থাকবে না। এমতাবস্থায় পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিকল্প নেই। সরকারকে বিষয়টি আমলে নিতে হবে। অবাধ গণতন্ত্রচর্চা, রাজনৈতিক সহনশীলতা প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সব ধরনের মানবাধিকার লংঘন রহিত করতে হবে। সর্বত্র আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬
সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল