ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এবং সরকারের চ্যালেঞ্জ

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম

এবারের নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের পর দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, এবারের মতো নির্বাচন ১৯৭৫ সালের পর থেকে দেশে আর কখনো হয়নি। সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। ক্ষমতায় থাকা দল নির্বাচনে জেতার পর এ কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। বিরোধীদল কিংবা গণতান্ত্রিক দেশগুলো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, কারচুপি কিংবা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে যতই বলুক, তাতে ক্ষমতাসীন দলের কিছুই যায় আসে না। বিষয়টি এমন, হেরে গেলে সেই দল বা প্রার্থী এ ধরনের কথা বলবে এবং নানা অজুহাত দেখাবে, এটাই বাস্তবতা। তবে এ অজুহাত ও অভিযোগের সত্যি সত্যি কোনো ভিত্তি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দূরে থাক, স্বীকার করা হবে না নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সে বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত ও ‘হানিমুন মুডে’ থাকে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অভিনন্দন ও ফুলের মালা পরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এবার দলটি দ্রুত সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনের তিন দিনের মাথায় মন্ত্রীসভা গঠন ও শপথ নিয়েছে। মন্ত্রীরা অফিস করা শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে, তার পেছন ফিরে তাকাবার সময় নেই। নির্বাচন যেমন হয়েছে এবং যে যা বলুক, তা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধীদলগুলো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা নিয়ে রাজনীতি, আন্দোলন করবে, তা করতে থাকুক। তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে, তা জানা আছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এদিকে মনোযোগ দেয়ার কিছু নেই। অনেকটা উট পাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে ঝড় উপেক্ষা করার মতো। এই ঝড় উপেক্ষা করা গেলেও নতুন সরকারের সামনে যে প্রবল ঘূর্ণিঝড় অপেক্ষা করছে এবং তা মাকাবেলা করতে হবে, সেটা অনেকটা নিশ্চিত করে বলেছেন পর্যবেক্ষকরা।

দুই.
নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইশতেহার ঘোষণার সময় সরকারের অতীতের ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে। তবে বিগত দেড় দশক ধরে কি কি ভুল করেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলেনি। নির্দিষ্ট করে বললে জনগণ বুঝতে পারত এবং তাদের চোখে পড়া ভুলের সাথে মিলিয়ে নিতে পারত। এ নিয়ে নির্বাচনের আগে গণবিতর্কের মুখোমুখি হওয়ার আয়োজন করতে পারত। তাতে ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে অনেক যুক্তিযুক্ত কথা উঠে আসত এবং তা থেকে যেমন দিকনির্দেশনা পাওয়া যেত, তেমনি ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকত। শুধু ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য বলা বিষয়টি অনেকটা দায়সারার মতো। এতে বোঝা যায়, ক্ষমতাসীনদলের কাছে যেটা সঠিক মনে হবে এবং অন্যের কাছে তা যতই ভুল হোক, তা আমলে না নিয়ে নিজের মতো করেই সরকার পরিচালনা করবে। এটা গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বিগত দেড় দশকে ক্ষমতাসীনদলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশে-বিদেশে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, বৃহৎ বিরোধীদল এবং তার একমাত্র প্রতিপক্ষ বিএনপির রাজনীতি কঠোর হস্তে দমন করা, দলটির নেতাকর্মীকে খুন, গুম, হামলা-মামলা, গ্রেফতার ও সাজা দেয়া, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, দলীয়করণ, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার হরণ, গণতন্ত্রের সংকোচন ইত্যাদি । ক্ষমতাসীনদল নির্বাচনের আগে এসব অভিযোগের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারত। আবার তার দেড় দশকের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ও তুলে ধরতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও বিরোধীদলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। দুই প্রার্থী মানুষের সামনে হাজির হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদলের প্রেসিডেন্টের সরকার পরিচালনার নীতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অভিযোগ তোলেন। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টও তার যুক্তি দিয়ে সেসব অভিযোগের জবাব দেন। এই বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তো বটেই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষও দেখে এবং বুঝতে পারে, কোন প্রার্থী বিতর্কে বিজয় হলো, কে হারল এবং নির্বাচনে কার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তা আগাম ধারণা করতে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের বিতর্ক কখনো হয়নি। উল্টো নির্বাচন ব্যবস্থা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সবসময়ই অভিযোগ উঠে। বিগত দেড় দশক ধরে নির্বাচন ব্যবস্থা এমনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, একজন অতি সাধারণ মানুষও নিশ্চিত করে বলে দিতে পারে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে ক্ষমতাসীনদলের বিজয় অনিবার্য। ফলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভোটদানের আগ্রহ হারিয়ে গেছে। কেবল ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দলের প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ব পালন করার জন্য ভোটকেন্দ্রে যায়। আবার ক্ষমতাসীনদলের অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে এমন মনোভাবও সৃষ্টি হয়েছে, দল এমনিতেই জিতবে। কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই। ফলে ক্ষমতাসীনদলের অভিপ্রায় অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনকে ভোটের হার বেশি দেখানোর কৌশল নিতে হয়, যাতে বলা যায়, বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছে। যেমন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে, তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক ও প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশন চূড়ান্তভাবে জানিয়েছে, ৪১.৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। অথচ নির্বাচন শেষ হওয়ার এক ঘন্টা আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনের সচিস বলেছেন, ভোট দিয়েছে ২৭.১৫ শতাংশ। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভোট দিয়েছে ৪০ শতাংশ। সাথে এ কথাও বলেছেন, এ হার কমও হতে পারে, বেশিও হতে পারে। তার এ বক্তব্য থেকেই ভোটের হার নিয়ে সংশয় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথম যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৭ ঘন্টায় যেখানে ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেখানে বাকি এক ঘন্টার মধ্যে কি করে ১৪.৬৫ শতাংশ ভোট পড়ে? ভোটের এই হিসাবটি গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করলে পাঠকরা বুঝতে পারবেন কিভাবে গড়মিল হয়েছে এবং শেষ এক ঘন্টায় ১৪.৬৫ শতাংশ ভোট পড়া কতটা অসম্ভব। এবার মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল, ১১ কোটি ৯০ লাখ ৬১ হাজার ১৫৮ জন। এ হিসাবে, শেষ এক ঘন্টায় ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯৫১ জনের বেশি ভোট দিয়েছে। মোট ভোটকেন্দ্র ছিল প্রায় ৪০ হাজার ১৮৩টি ও ভোটকক্ষ প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। অর্থাৎ প্রতি ভোট কক্ষে শেষ এক ঘন্টায় ভোট দিয়েছে গড়ে ৭৫ জন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, একজন ভোটারের একটি ভোট দিতে সময় লাগে গড়ে ৩ মিনটের মতো। সে হিসাবে, ৭৫ জন ভোটারের ভোট প্রদানের জন্য ৭৫ঢ৩ = ২২৫ মিনিট বা ৩ ঘণ্টা ৭৫ মিনিট সময় প্রয়োজন। অর্থাৎ ভোট শেষ হতে রাত ৮টা বেজে যাওয়ার কথা। এ হিসাবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এবারের ভোটে নির্বাচন কমিশন যে হার দেখিয়েছে, তা বাড়িয়ে দেখিয়েছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ার পর বাকি ১৪৭ আসনে নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচনেও ভোটের হার প্রায় ৪০ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। অর্থাৎ ১৪৭ আসনেই ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল, যা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিশ্বাসযোগ্য। এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ৪১.৮ শতাংশ ভোট দেখানো হয়েছে। কাজেই দলীয় সরকারের অধীনে কেমন নির্বাচন হয় এবং তা যে ভোটের হার বেশি দেখিয়ে হয়, তা এ হিসাব থেকে বোঝার বাকি থাকে না। এই বাড়িয়ে দেয়া ভোটের হারের মধ্যে যারা ভোট দেননি তাদেরকে এক ধরনের অপবাদ দেয়া হয়েছে। ভোট দেননি, অথচ তাদের ভোট দেখানো হয়েছে।

তিন.
প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনও যেকোনো সরকারের নৈতিকতার জন্য চ্যালেঞ্জের। কারণ, তার গায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যর্থতার অপবাদ লেগে থাকে। সরকার যতই উন্নয়ন দিয়ে এ অপবাদ ঘুচাতে চাক না কেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তার ব্যর্থতা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশে এর নজির রয়েছে। এখনও সুষ্ঠু ও বিতর্কিত নির্বাচন করতে না পারা সরকারগুলোর উদাহরণ দেয়া হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের সময়ও দেশে উন্নয়ন হয়েছিল। তিনিও রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা করার মতো আরও অনেক যুগান্তকারি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তারপরও তার এই উন্নয়নের কথা উচ্চারিত না হয়ে, তার স্বৈরশাসন এবং একতরফা নির্বাচন করার কথাই বেশি উচ্চারিত হয়। তার বিরুদ্ধে উচ্চরিত ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান মুছে ফেলা যায়নি। ফলে এ প্রজন্ম তো বটেই আগামী প্রজন্মের মনেও তার এবং তার মতো শাসকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে যাবে। ইতিহাসে তারা স্বৈরশাসনের রেফারেন্স হিসেবে থেকে যাবেন। বর্তমান ক্ষমতাসীনদল যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন তার অধীনে ধারাবাহিকভাবে যেসব প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, তাও আগামী প্রজন্মের কাছে নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবে। তারা এটাও জানবে, দলটি দেশের সিংহভাগ ভোটারকে বাইরে রেখে নির্বাচন করেছিল, যাতে সে নিজেও যেমন বদনামের ভাগিদার হয়েছিল, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছিল। এটা যেকোনো গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দলের জন্য অসম্মান ও অশ্রদ্ধার। আইয়ুব খানের শাসনামলের সাথে তুলনা করে এখন যেমন বলা হয় তার আমলেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল, তবে তিনি ছিলেন অত্যাচারি শাসক। ক্ষমতাসীনদলকে নিয়ে ভবিষ্যতে এমন কথা বলা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ‘বিনাভোটের নির্বাচন’, ‘রাতের ভোট’ এবং ‘ডামি নির্বাচন’Ñএই নেতিবাচক তকমাগুলো ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে। নির্বাচন যেমনই হোক, এখন নতুন সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো তাকে মোকাবেলা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, অর্থনীতি, রাজনীতি ও কূটনীতির চ্যালেঞ্জ। এই তিন চ্যালেঞ্জের মধ্যেই নানা সংকট রয়েছে। প্রথমত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় নেই। বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বর্জন ও আন্দোলনে রয়েছে এবং এর সাথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে যে মতামত ব্যক্ত করেছে, সেটা ডিমে ‘তা’ দেয়ার মতো হয়ে রয়েছে। ফলে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নির্বাচন অগ্রহণযোগ্যতার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে অনিবার্যভাবেই পড়বে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত দুই বছর ধরে অর্থনীতির প্রায় সবসূচক নি¤œগামী। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, আমদানি-রফতানি ব্যয় বৃদ্ধি ও সংকোচন, রিজার্ভ খাদের কিনারে থাকা, ব্যাংকে তারল্য সংকট, বেকারত্ব বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সে ভাটা, জ্বালানি সংকট থেকে শুরু করে সামষ্টিক অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দরিদ্র অতিদরিদ্রে, নি¤œবিত্ত দরিদ্রে এবং মধ্যবিত্ত নি¤œবিত্তে পরিণত হচ্ছে। অনেকে তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা খাবার খাচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে মানুষের মধ্যে নীরব হাহাকার চলছে। ক্ষমতাসীনদল তার নতুন নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে অন্যতম অগ্রাধিকার দিয়েছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, বছরের শুরুতেই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকারের পক্ষে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না তিন কারণে। প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমাতে হবে। সরকারের পক্ষে তা করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার, তবে মার্কিন ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে এলসি খুলতে পারছে না। ডলারের বাড়তি দামের কারণে খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু পণ্যে উচ্চ শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে। ফলে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, সরকারের পক্ষে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এর সাথে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতি জড়িয়ে আছে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পোশাক কিনে যুক্তরাষ্ট্রে। অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উপর যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল এবং নির্বাচনের পরও তার অবস্থান বদলায়নি বলে জানিয়েছে। তার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মিত্র দেশগুলো একমত পোষণ করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দেশগুলো পোশাক ও অন্যান্য রফতানি পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অন্যদেশগুলোতে পোশাক রফতানি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। নির্বাচন নিয়ে দেশগুলোর অসন্তুষ্টিই যে এর কারণ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। রফতানি খাতে এটা বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দেবে। বলা বাহুল্য, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশগুলোর সাথে একধরনের শীতল কূটনৈতিক সম্পর্ক চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রীতিমতো টানাপড়েন চলছে। তার মিত্র দেশ এবং জাতিসংঘও বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে। কূটনৈতিক এই টানাপড়েন সরকার কিভাবে সামাল দিয়ে স্বাভাবিক করবে, তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। সামাল দিতে না পারলে এর বহুবিধ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।

চার.
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়া যে কোনো দেশের জন্য অশনি সংকেত। সঠিক সময়ে, সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে তা সমাধান করতে না পারলে, সে দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হয়। আমাদের দেশ এখন এই ত্রিশূলের সামনে রয়েছে। এই ত্রিশূলে বিদ্ধ হওয়া ঠেকাতে সরকারকে তিনটি কন্টাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হবে। এটা সহজ কোনো পথ নয়। প্রথমেই অর্থনৈতিক ধস ঠেকানোর কাজে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থনীতি কেন ক্ষয়ে যাচ্ছে, তার কারণগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের যে চক্র গড়ে উঠেছে, তা নির্মূল করতে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। সরকারের জন্য এ কাজ করা কঠিন এ কারণে যে, তাকে কেন্দ্র করে যে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণী গড়ে উঠেছে, তার উপর সে অনেকটা নির্ভরশীল। তারা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে হলে এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারকে ‘অলিগার্ক’ চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ও রফতানিতে সিংহভাগ অবদান রাখা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে অর্থনৈতিক ধস ঠেকানো যাবে না। শুধু একটি বলয়ের ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে, ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধীদলগুলোকে কিভাবে আস্থায় নেয়া যায়, সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা জরুরি। উপেক্ষা, পাত্তা না দেয়া কিংবা দমননীতি অবলম্বন করলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, এর সাথে আন্তর্জাতিক মহলও জড়িয়ে আছে। এটা ভাবার কারণ নেই, আন্তর্জাতিক মহল শুধু সরকারকেই গুরুত্ব দেবে, বিরোধীদলগুলোকে গুরুত্ব দেবে না। এটা বোঝা যায়, বিরোধীদলগুলোর অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির সাথে তাদের মতামত মিলে যাওয়া থেকে। ফলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ও বিরোধীদলগুলোর সাথে কিভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার উপায় সরকারকে অবলম্বন করতে হবে। তা নাহলে, যেসব চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে রয়েছে, তা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ অফিসার নিহত অপর এক ঘটনায় নিহত ২

ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ অফিসার নিহত অপর এক ঘটনায় নিহত ২

আখাউড়ায় রেলওয়ের জায়গা থাকা ৪০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

আখাউড়ায় রেলওয়ের জায়গা থাকা ৪০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে