ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষায় জাতীয় লক্ষ্য, ইসলামি মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৬ এএম

ঐতিহাসিক কারণেই এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। অভাব, দারিদ্র্য ও ক্রমবর্ধমান সামাজিক-অর্থনৈতিক নিপীড়ণের মধ্যেও মানুষ তার রাজনৈতিক প্রত্যাশাকে পরিত্যাগ করেনা। প্রবল স্বৈরশাসনের কবলে অধিকার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপকেও গ্রাহ্য করেছে বারবার। দ্বাদশ শতকে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় থেকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত আমাদের দীর্ঘ আট শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির বহুমুখী প্রবঞ্চনায় আমাদের আজকের প্রজন্ম ক্রমেই রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে সম্ভবত এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মানদ- হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদী জীবনধারা এবং নিয়ন্ত্রিত বিনোদন ও প্রচারযন্ত্রের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষকে ক্রমে রাজনীতি বিমুখ করে তুলেছে। তারই ঢেউ আমাদের সমাজে আরো গভীর রাজনৈতিক শূণ্যতার জন্ম দিয়েছে। সাতচল্লিশ এবং একাত্তুরের স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ ছিল অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন, অধিকারের প্রশ্নে প্রতিবাদমূখর ও অগ্নিগর্ভ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের মূল অনুঘটক ছিল বাঙ্গালী মুসলমান সিপাহী জনতা। এ জন্য পরবর্তী শত বছর ধরে তাদের অনেক বেশি ত্যাগ শিকার করতে হয়েছে। হাজার হাজার আলেম ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসকের পুলিশি বিচারে প্রাণ দিতে হয়েছে। একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল বাঙালী মুসলমানের আত্মপ্রত্যয়ের চুড়ান্ত প্রান্তসীমা। হাজার বছরে এ জাতি একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হলো। বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসনে যেসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাংখার অপূর্ণতা ছিল, একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে তা অর্জনের পথ সৃষ্টি করার প্রত্যয়ে একটি অসামরিক, শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠিকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জীবন দিতে যুদ্ধে নামার প্রেরণা যুগিয়েছিল। লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল আকাংখা ও প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত, বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম করা। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু শাসকদের প্রতি ঘৃনা সৃষ্টি করেনি, গতানুগতিক রাজনীতির প্রতি মানুষকে বিমুখ করে তুলেছে। বাপ-দাদার মুখে শোনা ইতিহাসের গল্প ও নিজেদের মধ্যে জেগে ওঠা বোধবুদ্ধির অভিঘাতে নতুন প্রজন্ম ক্রমেই একটি রাজনীতি বিমুখ, ভোগবাদী ও হতাশাবাদী প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠেছে। ইতিহাসকে খ-িত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মানদ-ে সীমাবদ্ধ করে ফেলার কারণে তাদের সামনে কোনো মেন্টর নেই। এরা যেনতেন প্রকারে দেশ ত্যাগ করেই যেন মুক্তি পেতে চায়। দুই শত বছরের লৌহপ্রাচীর ঔপনিবেশিক শাসনেও যাদের পূর্ব পুরুষরা নিরাশ হয়নি, মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই স্বশাসিতস্বাধীন দেশের তরুন প্রজন্মকে কিভাবে হতোদ্যম-হতাশ করে নিজীর্ব-নিস্ক্রিয় শক্তিতে পরিনত করা হল তার প্রেক্ষাপট খুঁজে দেখা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর এবং শিক্ষাঙ্গণের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে হীন দলীয় ক্ষমতার মানদ-ে সীমিত ও পঙ্গু করে দেয়ার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।

পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর থেকে আমাদের শিক্ষার কোনো জাতীয় লক্ষ্য নেই। মন্দের ভালো হিসেবে পাকিস্তানের দুই দশক ধর্মীয় জাতিসত্তার নিরীখে একটি চেতনা জাগ্রত করার সচেতন প্রয়াস থাকলেও একাত্তর পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ও রাজনীতিতে সেক্যুলারিজমের নামে যে ধারণা প্রচার করা হয়েছে, তা মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধ প্রয়াস। সেই কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে আওয়ামী মহাজোট আমলের কবির চৌধুরীদের শিক্ষা কমিশন হয়ে বর্তমানে জাফর ইকবালদের শিক্ষা কারিক্যুলাম বিতর্কে শিক্ষা নিয়ে অব্যাহত এক্সপেরিমেন্ট থেকেই বোঝা যায়, শিক্ষা নিয়ে আমাদের শাসকশ্রেণীর কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান নেই। দেশীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত শিক্ষাকে পাল্টে দিয়ে ইংরেজী মাধ্যমে ভোগবাদী চেতনায় একটি নতুন শিক্ষিত শ্রেনী গড়ে তুলেছিল যারা বর্ণে ভারতীয় হলেও ইংরেজের প্রশাসনের জন্য স্থানীয় জনবল গড়ে তোলার পাশাপাশি মননে-সংস্কৃতিতে তারা হবে আধা ইংরেজ। মুসলমানরা বৃটিশদের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে গেলেও ইংরেজের মতলবি শিক্ষার দ্বারা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে ভুলিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি বলেই প্রায় দুইশ বছর ধরে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের অগ্রণী ভ’মিকায় দেখা গেছে। ইংরেজরা যেমন নিবর্তনমূলক পুলিশ অ্যাক্ট ও ভোগবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয়দের স্বাজাত্যবোধকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িক সম্পীতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য, জাতিরাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জাতীয় সংহতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীত চিত্রই প্রতিফলিত হচ্ছে। একটি জাতির আত্মবিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কারিক্যুলাম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়। দশকের পর দশক ধরে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে চলমান এক্সপেরিমেন্ট জাতিকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দিয়ে শাসকরা আত্মতুষ্টিতে বিভোর হলেও এই শিক্ষাব্যবস্থা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল গড়ে তোলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে লাখ লাখ কর্মী এসে আমাদের কর্মসংস্থানের খাতগুলোর উপরিস্তরের বড় অংশ দখল করে নিচ্ছে। দেশের তরুনরা দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে বিদেশে গিয়ে গতর খেটে যে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে, দেশে উচ্চ বেতনের পদগুলো দখল করে কয়েক লাখ ভারতীয় কর্মী তার বড় অংশ ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর দেশের হাজার হাজার রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রতি বছর বিদেশের মাটিতে নানা রকম সংকটের মুখে মানসিক চাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক্সপেরিমেন্ট ও পশ্চাৎপদতা ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অনুকুল। এটা ইতিমধ্যে প্রমানিত হয়েছে।

প্রাথমিক স্তরের নতুন শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি বা অনাস্থার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রভাব দেখে সরকারের সংশ্লিষ্টরা একে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার বলে অভিহিত করছেন। শিক্ষা কারিক্যুলামের পরিবর্তন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এ নিয়ে নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ, সচেতন অভিভাবক, নাগরিক সমাজ তথা অংশীজনদের সাথে যথেষ্ট আলোচনা, মতবিনিময় ও অরিয়েন্টেশন না হওয়া এবং নতুন শিক্ষা কারিক্যুলামে একেবারেই অপরিচিত ধারা চালু করার সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে মিথ্যাচার কিংবা প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়ার মত প্রতিক্রিয়াশিলতা কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। গত দেড় দশকে বার বার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলা শিক্ষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল কার্যক্রম কার্যত ব্যর্থ হওয়ায় নাগরিক সমাজের এই ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে ‘চুন খেয়ে মুখ পুড়ে দই দেখেও ভয়’ বাগার্থের অনুরূপ বলে গণ্য করা হবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। প্রাথমিক শিক্ষা কারিক্যুলাম পরিবর্তনের বর্তমান প্রক্রিয়ায় শিশুদের মুখস্ত বিদ্যার গতানুগতিক পদ্ধতি বদলে দিয়ে হাতে কলমে শেখার লক্ষ্য নির্ধারণ কিছুটা গ্রাহ্যতা পেলেও শিশু শিক্ষার চিরায়ত মানদন্ড রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। সেই ইংরেজ আমলে ভোগবাদী শিক্ষাকে আকৃষ্ট করতে কেউ একজন ছড়া লিখেন, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। আবার আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিপীড়িত-ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে শিশুদের জন্য ছড়া লিখেছেন, ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি.. আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। আমাদের সমাজ যতই ডিজিটাল বা প্রযুক্তিগত স্মার্টনেস অর্জন করুক, শিশু-তরুনদের মানবিক ও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলতে হলে জাতীয় কবির ছড়া কবিতা, রণসঙ্গীত মুখস্ত করা ও সকাল বেলার পাখি হওয়ার তাৎপর্য তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। কথিত যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগের মধ্য দিয়ে শিক্ষায় কোচিং বাণিজ্য , মুখস্ত বিদ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করা গেলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সম্পদ, অবকাঠামো, দক্ষ শিক্ষক ও জনবলের চাহিদা পুরণের ব্যবস্থা না করেই উন্নত রাষ্ট্র ফিনল্যা-ের আদলে শিক্ষা কারিকুলাম সাজানো কতটা লক্ষ্যাভিসারি হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিজ্ঞান অনুসারে একটি আদর্শ ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২০ বা তার নিচে হওয়া বাঞ্ছনীয় সেখানে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০ এর উপরে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা যোগ্যতা ভিত্তিক কারিকুলামে শিক্ষিত নন। তাদেরকে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালানোর উপযোগী করে গড়ে তোলা আর একজন শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়রে সক্ষম হওয়ার মত দক্ষতা ও প্রজ্ঞা অর্জন করা এক কথা নয়।

আমাদের গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা কি ব্যর্থ? কোন অর্থে কোন প্রেক্ষাপটে ব্যর্থ? কবে থেকে এই ব্যর্থতা আঁচ করা গেল? শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামের বড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। দেশে অন্তত এক ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকশত কারিগরি,পলিটেকনিক ও বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হলেও দেশের তৈরী পোশাক খাত, আইটি সেক্টরসহ প্রধান কর্মসংস্থান ও রফতানিমুখী খাতসমুহের গুরুত্বপূর্ণ পদে এদের চাকরি না হয়ে ভারতীয় কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। সাধারণ একটি ধারণা হচ্ছে, মূলত ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা ও কমিউনিকেশন স্কিলে ঘাটতির কারণে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সেক্টরে আমাদের শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। এটি কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষতার সংকট। তবে আমাদের সামগ্রিক সমাজ বাস্তবতায় দক্ষতার চেয়েও সততার সংকট আরো তীব্র ও গভীর। অশিক্ষিক কৃষক, অদক্ষ শ্রমিক দেশে-বিদেশে দিনরাত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি, খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদনশীলতাকে সচল রাখলেও আমাদের সার্টিফিকেটধারি উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণীর দুর্নীতি, লুটপাট, দখলবাজি ও অর্থপাচারের বেপরোয়া তৎপরতায় দেউলিয়া হয়ে পড়ছে দেশ। সুবিধাভোগী উচ্চশিক্ষত শ্রেণী থেকে রাজনীতির উচ্চ পদ, সচিব-আমলা, এমপি-মন্ত্রী, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে কিভাবে লুটপাট-দখলবাজি ও লুটতরাজে লিপ্ত হচ্ছে তার ফিরিস্তি নতুন করে দেয়ার কিছু নেই। দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে তাদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী। সরকারের একজন মন্ত্রীর বিদেশে দুই শতাধিক বাড়ি তথা তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপণ করার পরও তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়নি। আমাদের সর্বগ্রাসি সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ ও অর্থনৈতিক সংকটের মূল গ্রন্থি এখানেই নিহিত। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে এটা যতটা না প্রযুক্তিগত, প্রায়োগিক ও পদ্ধতিগত, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের নিরীখে। শিক্ষায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কর্মমূখী দক্ষতার অভাব থাকলেও পেশাজীবনের ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা পুরণ করা সম্ভব। কিন্তু শিক্ষা জীবনের শুরুতে ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিক মর্যাদা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে মেলবন্ধন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার প্রেরণা না থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজের অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা ঠেকানো অসম্ভব। দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষ ভ’মিকা, সুশাসন, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ও শিক্ষাঙ্গনে সুশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত না করে শুধু কারিকুলাম ও শিক্ষা পদ্ধতি বদল করে সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা, বিচারহীনতা, গণতন্ত্রহীনতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ছাপ শিক্ষাব্যবস্থাকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রত্যাশিত উন্নয়ন আশা করা যায়না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে