সমাজ এতটা নির্লিপ্ত হয়ে গেলো কীভাবে?
২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৩ এএম
৮০ ও ৯০’র দশকে দেশে যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, সাইক্লোন বা প্রচন্ড শীতে বিত্তশালী মানুষেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানও এমন মানবিক কাজে পিছপা হতো না। দেশের ছোঁ, বড় ও মাঝারি কর্পোরেট হাউসও এগিয়ে আসতো উদারচিত্তে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ঘরহারা মানুষের পাশে দাঁড়াতো খাদ্য, ঔষধ ও ঘর নির্মাণের সামগ্রী নিয়ে। ১৯৮৮ সালের ভায়বহ বন্যার সময় দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ হাতে রুটি ও খাবার স্যালাইন তৈরি করে অকাতরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে। বড় বড় কর্পোরেট হাউস ঘরহারা মানুষের ঘর তৈরি করে দিয়েছে, ঔষধ কোম্পানিগুলো বিনা পয়সায় ঔষধের ব্যবস্থা করেছে। চিকিৎসকগণ তাদের ইন্টার্নদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্লান্তিহীন মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করেছে। রাজনীতিবিদরা সার্বক্ষণিকভাবে এলাকায় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ৮০ বা ৯০’র দশকের চেয়ে দেশে আজ ধনীর সংখ্যা বেড়েছে, কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। কিছু রাজনীতিবিদ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপিদের সহায়-সম্পদ বেড়েছে। তাদের স্ত্রীদের কেউ কেউ আবার কৃষিকাজে বিপ্লব ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাদের মধ্যে কিছু বেগম কানাডা, আমেরিকা, দুবাই ও মালয়েশিয়ায় আলীশান বাড়ির মালিক হয়েছেন। ফুল টাইম ব্যবসায়ী ও পার্ট টাইম রাজনীতিবীদরা গোটা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে আবার দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে সে দেশের ১০০ ধনীর তালিকায় নাম লেখিয়েছেন। সাবেক একজন মন্ত্রী তো যুক্তরাজ্যে আড়াই শতাধিক বাড়ি নির্মাণ করে রেকর্ড করেছেন। যাক সেসব কথা, যা বলছিলাম, এই মুহূর্তে দেশব্যাপী প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহ বিরাজমান। শিক্ষার্থীদের মাঝে এ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তাদের সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপ। ভার্চুয়াল জগতে নিমগ্ন তাদের মনোজগৎ। এসব নিয়ে ভাববার মতো সময় তাদের নেই। একটি প্রজন্ম ফেসবুকের বা প্রযুক্তির যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেখবার যেন কেউ নেই। প্রায় ২৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমনটি আগে কখনো দেখিনি। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা যতটা না শিক্ষকের লেকচার শুনতে আগ্রহী, তার চেয়ে হাজার গুণ আগ্রহী মোবাইলে স্ক্রিনের প্রতি। মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে। শুধু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতেই নয়, কোমলমতি শিশু, তরুণ-তরুণীদের হাতেও অ্যান্ড্রয়েড ফোন। অজস্ত্র এডাল্ট সাইট উম্মুক্ত। ইচ্ছে করলেই তারা ঘুরে আসতে পারে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বানানো যে কোনো মুভি, নাটক ও ডকুমেন্টারি থেকে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে একটি নির্দিষ্ট বয়সের ছেলে মেয়েদের জন্য এসব সাইটে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকলেও আমাদের দেশে তা অবারিত। আমি মোটেই প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নই, তবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার। প্রয়োজনে নিয়ম করে বিটিআরসির মাধ্যমে তরুণদের জন্য এসব ক্ষতিকর সাইটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দরকার।
এবার ফিরে আসা যাক মূল কথায়। চলমান শীতে দেশের বিত্তশালীরা প্রায় নিশ্চুপ। তারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এমনটি শোনা যাচ্ছে না, দেখাও যাচ্ছে না। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। রাজনীতিবিদের গরম কাপড় নিয়ে তাদের এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। প্রচন্ড শীতে উত্তরাঞ্চলের দিনমজুররা সাময়িক কাজ হারিয়েছে। তাদের খাদ্য সাহায্য দরকার। অথচ, ভরা মৌসুমে বিনা কারণে যেসব চাল ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করলো তারাও এক বস্তা চাল নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এমনটি শোনা যায় না। চালকল মালিক সমিতি গত ১৫/২০ দিনে মানুষকে জিম্মি করে যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিলে দেশের অধিকাংশ মানুষ খুশি হবে। এদিকে রোজা আসার আগেই রোজার মাসের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নতুন করে ভোক্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এমনিতেই উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপন ব্যয় সবার জন্য সহনীয় মাত্রায় রাখতে বিক্রেতারা স্বেচ্ছায় হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য বিক্রি করে থাকে। অথচ, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে ঠিক তার উল্টো। মুনাফাখোররা ওৎ পেতে বসে থাকে রোজা ও ঈদের জন্য।
চলমান শৈত্য প্রবাহের সময় তাদের অনেকেই হাতগুটিয়ে বসে আছে। বড় বড় কর্পোরেট হাউস যে খুব একটা কিছু করছে তাও নয়। বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সিএসআর কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালে অসহায় মানুষের কষ্ট লাঘব হতো। তবে সেটা যে একেবারেই হয়নি তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে আমার জানা মতে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও টিএমএসএস, ব্রাক ব্যাংক, কিছু সামাজিক সংগঠন ও দানশীল ব্যক্তি কম্বল নিয়ে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত উত্তরাঞ্চলের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পু-্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের সরকারি, বেসরকারি অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের শিক্ষার্থীরা এমন মানবিক কাজে এগিয়ে আসতে পারে। শুধু অন্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমরা নিজেরাও আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে আমাদের আশেপাশে বসবাসকারী অসহায় মানুষের পাশে খাদ্য ও শীতবস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে অন্যকে দাঁড়াতে উৎসাহিত করতে পারি।
এক সময় দেশের বিত্তবান মানুষরা নিজের টাকায় দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে শিক্ষাপ্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও আজ হঠাৎ করে কোটিপতি বনে যাওয়া মানুষের অনেকেই তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষাবিস্তারে নয় বরং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে টাকা ইনকামের হাতিয়ার হিসেবে। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় দেড় শতাধিক মেডিক্যাল কলেজ। অথচ প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহে কাহিল মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে দেশের কোথাও কোনো মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়েছে বলে শুনিনি। প্রচন্ড শীতে উত্তরাঞ্চলের মানুষের শীতজনিত রোগ বালাই বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮০’র দশকের পর নিত্যনতুন বহু ঔষধ কোম্পানি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কনকনে ঠান্ডার প্রকোপে দেশের স্কুলের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় স্কুল বন্ধও করা হয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো ঔষধ কোম্পানি ফ্রি ঔষধ দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বলে শোনা যায়নি। আজ আর দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা হয় না, অথচ নামে বেনামে লাইসেন্স ছাড়া প্রশাসনের নাকের ডগায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতাল। তবে সেসব করা হয়েছে সেবা করার জন্য নয়, অনেকাংশে মুনাফা করার জন্য।
মাত্র ৩ দশকে সমাজটা কেন যে এমন নির্লিপ্ত হয়ে গেল, তা ভাবতে গেলে কষ্ট হয়। একই বিল্ডিংয়ে বসবাস করেও আমরা একে ওপরের পরিচয়টাও ভালোভাবে জানি না। পড়শির সাথে দেখা হয় কালেভদ্রে। অন্যদিকে সমাজটা মোটাদাগে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ধনী আর গরিবের ব্যবধান দিনদিন প্রকট আকার ধারণ করছে। শহর ও গ্রামের ব্যবধানটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত বলে দেশে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। রাজনৈতিক বিভাজন এতটাই বেড়েছে যে, কেউ কারো মুখটাও আর দেখতে চায় না। স্বার্থের কাছে নীতি নৈতিকতা আজ অনেকটাই পর্যুদস্ত। দুর্যোগ দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের এই নির্লিপ্ততা কোনভাবেই মানবিক ও কল্যাণমূলক সমাজের জন্য সহায়ক নয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে