ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক ও বাস্তবতা

Daily Inqilab অধ্যাপক নাসির উদ্দিন খান

২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম

শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। সুশিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করে। শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ নাগরিক গড়ে উঠে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে থাকে। সেই শিক্ষার ভিত যদি দুর্বল হয়, জাতিসত্ত্বাবিরোধী হয়, নৈতিকতাহীন নিরেট বস্তুবাদী হয়, তাহলে জাতি ভুল পথে পরিচালিত হয়। আদর্শ শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে দেশের মানুষের বোধ-বিশ^াস, ধর্মীয় আদর্শের প্রতি লক্ষ রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও শিক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কখনোই সেভাবে লক্ষ করা যায়নি। শিক্ষাখাতে বার্ষিক বাজেট সবচেয়ে কম। শিক্ষকদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা কতটা নাজুক তা শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা বিকশিত হবার পরিবর্তে অনেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এমতাবস্থায় নীতি-নৈতিকতার প্রধান চালিকাশক্তি ধর্মীয় শিক্ষাকে পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করাসহ নানারূপ অসঙ্গতিপূর্ণ বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। 
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে, যা ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮২ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালে এম.এ. বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। শিক্ষা কমিশনের জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রয়োগ ও বাতিল দেখতে দেখতে জাতি আজ ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ ভিনদেশের শিক্ষাক্রম অনুকরণ করে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের উদ্যোগ জাতির সঙ্গে উপহাস বৈ কিছু নয়। ২০১০ সালে সংসদে পাশ হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতির সাথে ২০২১ সালের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বাস্তবে কোনো মিল নাই। সরকার জাতিকে তথ্য দেয় এক রকম কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। তাই সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘সংসদে আলোচনা ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়েছে।’ এটি একটি স্বার্থান্ধ জ্ঞানপাপী চক্রের ষড়যন্ত্র। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন তার ফেইজবুক পেইজে বলেছেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে যারা বলছেন তাদের সবাই হয় এই সরকারের দলদাস, না হয় সুবিধাভোগী আর না হয় সুবিধা-প্রার্থী।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মন্ত্রী, আমলা এবং দলীয় বড় নেতাদের মধ্যে যারা এই নতুন কারিকুলামের ভূয়সী প্রশংসা করছেন তাদের একজনের সন্তানও নতুন কারিকুলামে বা বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না।’ এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা জানে, এই কারিকুলামে পড়ালেখা করে মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত এবং কৃষকের সন্তানেরা অর্থাৎ ৯০% মানুষের সন্তানেরা শ্রমিক ও কেরানী ছাড়া আর কিছুই হতে পারবে না। গত ১৬ জানুয়ারি দৈনিকশিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত একটি কলামে মাসুম বিল্লাহ লিখেছেন, ‘অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ভাষার চেয়ে সাহিত্য বেশি।’ আমরা মনে করি, অনার্স-মাস্টার্স লেভেলের গল্প ও কবিতার পাঠ অষ্টম শ্রেণিতে নিয়ে আসা হয়েছে। এই বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য এই সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করতে পারা ততটা সহজ নয়। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ, যোগ্য, নৈতিকতাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো সরকারই আন্তরিক ভূমিকা পালন না করে, বার বার শিক্ষাকে বিতর্কের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে আজও দেশের মানুষ শিক্ষাব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শংকিত।
কয়েক বছর পূর্বে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে নতুন কিছু করার চেষ্টা চালানো হলেও সেটা কার্যত ব্যর্থ। কেন ব্যর্থ হলো, সেটার যৌক্তিক বিশ্লেষণ করা হয়নি। ‘ইউনেস্কো’ শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৫.৫% বরাদ্দের পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশ সরকার দেয় ১.৭৬%, যা পৃথিবীতে শিক্ষায় কম বরাদ্দ দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরমধ্যে আবার প্রতিনিয়ত কারিকুলাম পরিবর্তনের নামে শিক্ষাখাতের বাজেটের অপব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না দিয়ে এবং শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বাস্তবায়ন করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে না বলেই সচেতন শিক্ষাবিদদের অভিমত।
এমতাবস্থায় আমরা জাতীয় চেতনা ও দায়িত্ববোধ থেকে নতুন কারিকুলামের বাস্তবতা এবং স্পর্শকাতর বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরছি:১. বাস্তবায়নে অনুপযোগী: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, পরিবেশগত কারণ, শিক্ষা পদ্ধতির ধরন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানসম্মত অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন উপযোগী নয়।
২. বিজ্ঞান শিক্ষার সংকোচন: শিক্ষা কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষার মারাত্মক সংকোচন দৃশ্যমান। জীবনজীবিকা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, শিল্পসংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো চার-চারটা বিষয়ের পৃথক পাঠ্যবই থাকবে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত, অথচ ফিজিক্স-ক্যামিস্ট্রি-বায়োলজী মিলিয়ে একটা মিকচার থাকবে ৯ম-১০ম শ্রেণীতে সবার পড়ার জন্য। আর কোনো অপশন থাকবে না! অপশনগুলো খোলা রেখেই এটা করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি। এই কারিকুলাম বাস্তবায়িত হলে বৈশি^ক মানদ-ে পেশাভিত্তিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে।
৩. ধর্মশিক্ষাকে চূড়ান্তভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে: ধর্মশিক্ষা মানুষকে নীতি-নৈতিকতা শেখায়। স্রষ্টার পরিচয় লাভ হয়। অথচ নতুন কারিকুলামে ধর্মশিক্ষাকে নানাভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় পরিচয়ে সন্তানরা বেড়ে উঠে। সেজন্য ধর্মশিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করার কথা থাকলেও উল্টো মাধ্যামিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা থেকে ধর্ম শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে। সংকুচিত ও উপেক্ষিত ধর্মশিক্ষার কারণে ধর্মহীন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। আগামী প্রজন্ম ধর্মহীন-খোদাদ্রোহী হিসেবে গড়ে উঠুক, তা শিক্ষানীতি-২০১০ এর ৭ অধ্যায়ে বর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপন্থীও বটে। ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করার হীন চিত্রগুলো এতটা ব্যাপক, যেগুলো এখানে যুক্ত করলে প্রবন্ধের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই এ বিষয়ে সামান্য কিছু তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করছি। 
ক. ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ইবতেদায়ী প্রথম শ্রেণীর ইংলিশ ফর টু ডে বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরস্পর কথোপকথনের সময় সালাম বিনিময় ছিল। কিন্তু, ২০২৩ সালে সালাম মুছে ‘গুড মর্নিং’ শব্দ দেয়া হয়েছিল এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষেও তা অপরিবর্তীত রাখা হয়েছে। 
খ. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় দেশীয় সংস্কৃতির নামে মঙ্গল শোভাযাত্রা আর ঢোল-তবলা উপস্থাপন করা হয়েছে। গ. ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১০ পৃষ্ঠায় ইসলামের বিধান একাধিক বিবাহকে অন্ধকার প্রথা হিসেবে বলা হয়েছে।
ঘ. এছাড়া ৭ম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১৮ পৃষ্ঠা, ৯৫ ও ৯৬ পৃষ্ঠা, চতুর্থ শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠাসহ অনেক ক্ষেত্রেই ডিইসলামাইজেশন করা হয়েছে। ঙ. ৬ষ্ঠ শ্রেণির (স্কুল ও দাখিল মাদরাস) স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় ‘স্ট্যান্ডিং এলবো টু নী ক্রানসেজ’ নামক ব্যায়ামের পদ্ধতি শিখাতে গিয়ে মেয়েদের ৩টি দৃষ্টিকটু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা অন্যান্য ধর্মতো বটেই ইসলাম ধর্মের শালীন পোশাকের বিপরীত চিত্রই প্রকাশ করেছে। সচেতন অভিভাবক কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে পারেননি।
চ. ৬ষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৯৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘আমার মা কপালে চুমু দিলেও, আমি হয়ত আমার বন্ধুকে চুমু দিতে দিব না। তবে সে একই বন্ধুর সাথে হাত ধরে ঘুরতে হয়তো আমার অস্বস্তি লাগবে না’। এখানে মেয়ে নাকি ছেলে বন্ধু তা উল্লেখ করা তো হয়ইনি আবার চুমু খেতে হয়ত না দিলেও হাত ধরে ঘুরতে বের হতে তেমন বাধা নেই। আজকে সমাজে অসংখ্য কিশোর কিশোরী পিতা-মাতার অজান্তে বন্ধুর হাত ধরে নিখোঁজ হয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এটা বাংলাদেশের সভ্য সমাজকে পশ্চিমাদের মতো অসভ্য অবাধ যৌনতার সমাজে পরিণত করার কূটকৌশল বৈ কিছুই নয়।
৪. ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট: সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শরিফার গল্প আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ সালে উক্ত বইয়ের এই বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী ট্রান্সজেন্ডার প্রমোট করার অভিযোগে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কর্তৃপক্ষ সে বিষয়টি আমলে না নিয়ে ২০২৪ সালেও ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়টি বইয়ে উল্লেখ করেছে। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে ট্রান্সজেন্ডারকে তালগোল পাকিয়ে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত সমকামিতার বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি সিলেট থেকে এক মহিলা সমকামী অপর মহিলাকে বিবাহ করার জন্য সাতক্ষীরায় গিয়েছিল। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমে ট্রানজেন্ডারকে সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের ছদ্মাবরণে একটি স্বার্থান্বেষী মহল হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত পারিবারিক প্রথার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।
৫. বিজ্ঞানের নামে অবৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদ প্রমোট: ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের ৭ম শ্রেণীর বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ৪র্থ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘যে জীবগুলো সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়ে হয়ে একে অপরের থেকে এতটাই আলাদা হয়ে গেছে যে, সেগুলো আর একে অপরের সঙ্গে প্রজননে অংশ নিতে পারে না, সেগুলোর আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়’, যা বিবর্তনবাদের মূল কথা। যদিও এ বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে এবং অনেক দেশেই বিবর্তনবাদের থিওরি বাতিল করা হয়েছে। এ দেশের জনগণের ধারাবাহিক আন্দোলন-প্রতিবাদের পরও বিবর্তনবাদের মতো অবৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রমোট আমাদের হতবাক করেছে। 
৬. মাদরাসা (আলিয়া) শিক্ষার স্বকীয়তা বিরোধী কারিকুলাম: এই কারিকুলাম একমুখী হওয়ায় জেনারেল সাবজেক্টগুলি হুবহু স্কুল শিক্ষার সিলেবাস থেকে মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যবই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাঠ্যবইগুলোর বিভিন্ন জায়গায় এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা মাদরাসা শিক্ষার বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত। মাদরাসা শিক্ষার্থী শুধু নয় বরং স্কুল পড়ুয়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্যও এটা বোধ-বিশ্বাসের বিপরীত।
৭. স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার নামে যৌন শিক্ষা: ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে নারী-পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কী নির্গত হয়, কোন অঙ্গের আকার কেমন হয় এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন আকর্ষণ হয় তা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পাঠদানে শিক্ষকরা বিব্রতবোধ করছেন। একই শ্রেণীর বিজ্ঞান ও অনুসন্ধানী পাঠের ১০ম অধ্যায় ‘মানব শরীর’ শিরোনামে ১১১ থেকে ১১২ পৃষ্ঠায় নারী-পুরুষের গোপনীয় অঙ্গগুলো সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়, যা ১১ থেকে ১৩ বছরের কোমলমতি শিশু মনে ভয়ংকর কুপ্রভাব ফেলতে পারে। পাঠ্য বইয়ের বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ ডিসকাশন করতে হয়, গ্রুপ এসাইনমেন্ট করতে হয় এবং সামগ্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ত্রিভূজ পেতে হয়, এভাবে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচনার মাধ্যমে লজ্জার বাঁধন উঠে যাবে এবং যেকোনো অনৈতিক কাজে তাদের অনায়াসে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। 
৮. দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব: বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানসম্মত শিক্ষা। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদী (৬ মাস থেকে ১ বছর) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ৫ থেকে ৭ দিনের একটি ট্রেনিং সেশন শেষে শিক্ষকদের ক্লাসরুমে পাঠানো হয়েছে। চলমান শিক্ষাক্রমে পাঠদান করার মতো দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ উপলদ্ধি করার মতো শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ফলে পাঠদান পদ্ধতি সমালোচিত ও হাস্যকর হিসাবে প্রমাণিত হবে। 
৯. দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিরোধী: শিক্ষার রূপরেখায় বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বোধ-বিশ^াস, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ইত্যাদি উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে ভিনদেশী সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে তীব্র প্রভাব বিস্তার করবে। পাশ্চাত্যের প্রচলিত আদর্শিক মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক স্খলন রীতিমত আঁতকে ওঠার মতো।
১০. ব্যয়বহুল ও বৈষম্যের রূপরেখা: বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিনির্ভর আমাদের অর্থনীতি। অথচ চলমান শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয়ভার অনেক বেশি। এর ফলে শহরে ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষম্য দেখা দেবে, যার কারণে দেশে শিক্ষাগত বৈষম্য বেড়ে যাবে এবং পূর্বের তুলনায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার আরও বৃদ্ধি পাবে। ১১. পড়াশুনা বিমুখ কারিকুলাম: পাঠদান পদ্ধতির জটিলতার কারণে এই কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বিমুখ করবে ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাহীন রেখে দেবে।১২. জটিল মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পরীক্ষাহীন কারিকুলাম: মুখস্থ বিদ্যা বন্ধের অজুহাতে এই কারিকুলাম দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বাইরে রাখা হয়েছে। হঠাৎ করেই পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে গ্রুপ ভিত্তিক মূল্যায়ন ও মূল্যায়নে আনা হয়েছে ত্রিভূজ, বৃত্ত ও চতুর্ভূজ, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের পক্ষপাতদুষ্ট ও নৈতিক স্খলনের আশংকা রয়েছে। 
১৩. অনলাইননির্ভর শিক্ষায় শিশু-কিশোরদের চারিত্রিক বিপর্যয়: এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে অনলাইন ব্যবহার সীমিত করার পরিবর্তে ব্যাপক করা হয়েছে। কোমলপ্রাণ শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ডিভাইস (মোবাইল, ট্যাব) ইত্যাদি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নিষিদ্ধ গেমস, অনলাইন জুয়া, ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটক, পর্ন সাইটসহ নানা অপকর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং, যারা ছিনতাই, খুনে জড়িত হয়ে পড়ছে। যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, কিশোর-কিশোরীর অবৈধ যৌন সম্পর্ক, নেশা, মাদকসহ নানা কাজে নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। অতএব, অনলাইন নির্ভর এই কারিকুলাম অভিভাবকসহ সচেতন মহল কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারছে না। একটি পঙ্গু ও চরিত্রহীন আগামী প্রজন্ম আমরা চাই না। আমরা চাই, শিশু-কিশোরদের অনলাইননির্ভরতা কমিয়ে পাঠ্যবই নির্ভর আগামী প্রজন্ম।
১৪. একমুখী শিক্ষা, নি¤œমানের জনশক্তি ও বেকারত্বের সৃষ্টি: এই কারিকুলাম একমুখী শিক্ষা হওয়ার ফলে বহুমুখী শিক্ষা হারিয়ে যাবে। আবার এই কারিকুলামের কারণে বুদ্ধিদীপ্ত, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল প্রজন্ম তৈরি বাধাগ্রস্থ হবে এবং দেশে বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। উপর্যুক্ত স্পর্শকাতর দিকগুলোর কারণে, দেশের স্বার্থে এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মেধা বিকাশের স্বার্থে আমরা নিচের সুপারিশগুলো উপস্থাপন করছি।
১. বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম ২০২১ বাতিল করা এবং যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক এবং দ্বীনদার শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করা।২. পাঠ্য পুস্তকের সকল বিষয় হতে বিতর্কিত ও ইসলামী আকিদাবিরোধী প্রবন্ধসমূহ বাদ দেয়া। স্কুল ও মাদরাসার সকল পাঠ্যপুস্তকে অনৈসলামিক শব্দ এবং অশ্লীল চিত্রমুক্ত রাখা।৩. ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি স্ব-স্ব ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী এবং পাঠ্যপুস্তকের নামকরণ নিজ ধর্মের নাম অনুসারে করা।৪. মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলাম, শিক্ষানীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট আলেম, দ্বীনদার ইসলামিক স্কলার শিক্ষকদের দ্বারা পরিমার্জন করা ও আলিয়া মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন করা।
৫. নৈতিকতা সমৃদ্ধ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে সকল ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।৬. পূর্বের ন্যায় নবম শ্রেণী থেকে বিভাগ বিভাজনের পদ্ধতি বলবৎ রাখা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক বইসমূহ পৃথক রাখা।
৭. প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাতিল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কোটা থেকে ট্রান্সজেন্ডার বাতিল করা।৮. পাঠ্য সিলেবাসে দেশ, জাতিস্বত্ত্বা ও ইসলামী তাহযীব, তমুদ্দুন বিরোধী সকল অসংগতি দূর করা। ৯. শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও শিক্ষক সুরক্ষা আইন তৈরির মাধ্যমে উপযুক্ত বেতন এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। 
১০. শিক্ষার সকল ব্যয়ভার রাষ্ট্রকর্তৃক বহন করা এবং ইবতেদায়ী মাদরাসাসহ সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।১১. কারিকুলামের অসঙ্গতির কথা বলতে গিয়ে যে সকল শিক্ষক ও অভিভাবককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া। ১২. প্রতি শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।
লেখক: জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সভাপতি। [গত ১৯ জানুয়ারি, সংগঠনের তরফে ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্চিনিয়ার্স মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে নিবন্ধটি পঠিত।]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে