মি’রাজুন্নবী (সা.)

Daily Inqilab ড. মুহাম্মাদ আসাদ্ল্লুাহ আল-গালিব

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম

‘ইসরা’ অর্থ নৈশ ভ্রমণ এবং ‘মি‘রাজ’ অর্থ সিঁড়ি। মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ পর্যন্ত বোরাক্বের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্বল্পকালীন নৈশ ভ্রমণকে ‘ইসরা’ এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশের সীমানা পেরিয়ে আল্লাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎকে মি‘রাজ বলা হয়। যেহেতু মি‘রাজের ঘটনাটিই মুখ্য, সেকারণ পুরা সফরটিই ‘মি‘রাজ’ নামে পরিচিত হয়েছে। হযরত ওমর, আলী, ইবনু মাসঊদ, জাবের, আয়েশা প্রমুখ ২৫জন ছাহাবী কর্তৃক বুখারী ও মুসলিম সহ প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। অতএব মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য ঘটনা, যা মাত্র একবার হয়েছিল এবং এটি হিজরতের এক বছর পূর্বে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সজ্ঞানে হয়েছিল। হাফেজ ইবনু কাছীর বলেন, মি‘রাজের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ ঐকমত পোষণ করে। আর এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে যিন্দীক্ব ও মুলহিদগণ। তারা এর মাধ্যমে আল্লাহ্র নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তার নূরকে পূর্ণতা দান করবেন। যদিও কাফেররা এটি অপছন্দ করে। (ছফ ৬১/৮)।

মি‘রাজ ছিল নবীজীবনের এক অলৌকিক ও শিক্ষাপ্রদ ঘটনা, যার মাধ্যমে শেষনবীকে পরকালীন জীবনের সবকিছু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করানো হয়। এর ফলে তাঁর মধ্যে যেমন বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় এবং হৃদয়ে প্রশান্তি জন্মে, তেমনি মুমিন হৃদয়ে পরকালীন মুক্তির জন্য উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়।

পবিত্র কুরআনে সূরা বনু ইস্রাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ পর্যন্ত ৬ আয়াতে মি‘রাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। বাকী বিশদ ঘটনাবলী সহীহ হাদীসসমূহে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘পরম পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রির একাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত, যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা বরকতম-িত করেছি, যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)। উক্ত আয়াতে চারটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে।

১. ইসরা ও মি‘রাজের পুরা ঘটনাটি রাত্রির শেষাংশে স্বল্প সময়ে একবার মাত্র সম্পন্ন হয়েছিল, যা ‘লায়লান’ শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে।

২. ঘটনাটি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ঘটেছিল, যা ‘বে‘আবদিহী’ শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে। কেননা রূহ ও দেহের সমন্বিত সত্তাকে ‘আব্দ’ বা দাস বলা হয়। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নযোগে বা রূহানী কোন ব্যাপার হ’লে কেউ একে অবিশ্বাস করত না। এখানে ‘তাঁর দাস’ বলে রাসূল (সা.)-কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেননা আল্লাহ্র দাস হওয়ার মধ্যেই মানুষের সর্বোচ্চ সম্মান নিহিত রয়েছে। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এটি ছিল প্রত্যক্ষ দর্শন, যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখানো হয়েছিল’। (বুখারী হা/৪৭১৬, ৩৮৮৮)।

উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ঘোড়া বা উটে যাতায়াতে দু’মাসের পথ, যা এক রাতেই ভ্রমণ করে মি‘রাজ থেকে ফিরে এসে সকাল বেলা যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) লোকদের কাছে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন সবাই একে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে লাগল। অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন, এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব পেয়ে তারা চুপ হ’ল বটে। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। কিন্তু হযরত আবুবকর (রা.) একথা শোনামাত্র বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং বলেন, ‘আমি তাকে এর চাইতে অনেক বড় বিষয়ে সত্য বলে জানি। আমি সকালে ও সন্ধ্যায় তার নিকটে আগত আসমানী খবরসমূহকে সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি’। এ দিন থেকেই তিনি ‘সিদ্দীক্ব’ বা সর্বাধিক সত্যবাদী নামে অভিহিত হ’তে থাকেন’ (সহীহাহ হা/৩০৬)।

যদিও নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। কিন্তু স্বপ্নে হ’লে এটি কোন বড় বিষয় হ’ত না। সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছিল বলেই লোকেরা এটাকে অবিশ্বাস করেছিল। আর একারণেই বহু মুসলমান তাঁকে মিথ্যা নবী মনে করে ‘মুরতাদ’ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত ‘আব্দ’ বা বান্দা বলতে দেহ ও আত্মাকে মিলিতভাবে বুঝানো হয়েছে। তৃতীয়ত তাঁকে বোরাকে আরোহণ করানো হয়েছিল। আরোহণ করার জন্য দেহ প্রয়োজন। আত্মা কখনো আরোহণ করে না।

এটি ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা। সেকারণ শুরুতে ‘সুবহানা’ বিস্ময়সূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাপার হ’লে তো এটা মোটেই বিস্ময়কর হ’ত না। এজন্যই আল্লাহ এটাকে ‘মানুষের জন্য ফিৎনা বা পরীক্ষা স্বরূপ’ বলেছেন। (ইসরা ১৭/৬০)। অর্থাৎ উক্ত ঘটনায় অনেক নও মুসলিম ‘মুরতাদ’ হয়ে যাবার ফিৎনা (সহীহাহ হা/৩০৬)।

৩. বায়তুল মুক্বাদ্দাসের আশপাশ ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তিনসহ পুরা সিরিয়া অঞ্চলকে বরকতম-িত এলাকা বলা হয়েছে। এখানে আধ্যাত্মিক বরকত হ’ল এই যে, হযরত ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকূব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আ.)সহ বনু ইস্রাঈলের হাজার হাজার নবীর আবাসভূমি হ’ল এই এলাকা। আর দুনিয়াবী বরকত এই যে, শাম এলাকার মাটি মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে উর্বর ও সুজলা-সুফলা। এতদ্ব্যতীত এ অঞ্চলের অন্যান্য বরকত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

৪. আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শনসমূহের কিছু অংশ স্বচক্ষে দেখিয়ে দেন। যার মধ্যে ছিল, (১) মক্কা থেকে বোরাকে সওয়ার হওয়ার পূর্বে সীনা চাক করা এবং তা যমযম পানি দিয়ে ধুয়ে সেখানে নূর দিয়ে ভরে দেওয়া। অতঃপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস গিয়ে সেখান থেকে ঊর্ধ্বারোহণের পূর্বে তাঁকে দুধ ও মদ পরিবেশন করা। কিন্তু তিনি দুধ গ্রহণ করেন। তখন জিব্রীল বলেন, ‘আপনি স্বভাবধর্ম প্রাপ্ত হয়েছেন’। (২) অতঃপর রাসূল (সা.) প্রথম আসমানে আদম, দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইদ্রীস, পঞ্চম আসমানে হারূণ, ষষ্ঠ আসমানে মূসা এবং সপ্তম আসমানে ইব্রাহীম (‘আলাইহিমুস সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তবে আদম ও ইব্রাহীম (আ.) ব্যতীত অন্যদের আসমানের ব্যাপারে বর্ণনাগত ভিন্নতা রয়েছে। পিতা আদম ও পিতা ইব্রাহীম তাঁকে বলেন, ‘সৎকর্মশীল পুত্র ও সৎকর্মশীল নবীকে অভিনন্দন’। অতঃপর ইদ্রীস, মূসা ও ঈসাসহ অন্য নবীগণ বলেন, ‘সৎকর্মশীল ভাই ও সৎকর্মশীল নবীকে অভিনন্দন’। (আহমাদ হা/১৭৮৬৯; বুখারী হা/৩৩৪২)। (৩) তিনি ফেরেশতাদের কলম দিয়ে লেখার খসখস শব্দ শুনতে পান। (৪) ছয়শো ডানাবিশিষ্ট জিব্রীলকে তিনি তার নিজস্ব রূপে নিকট থেকে দেখেন। (৫) সিদরাতুল মুনতাহার কুলগাছ দেখেন, যার পাতাগুলি হাতির কানের মত বড় বড়। (৬) সপ্তম আসমানে বায়তুল মা‘মূর মসজিদ দেখেন। যেখানে প্রতিদিন সত্তুর হাজার ফেরেশতা সালাত আদায় করে। কিন্তু পুনরায় আর সুযোগ পায় না। (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৮৬২)।
(৭) তিনি হাউজ কাওসার, জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। তিনি জান্নাতের নে‘মতরাজি ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। যেমন, অন্য হাদীসে এসেছে, ক্বিয়ামতের দিন জনৈক ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর তার নাড়ী-ভুঁড়ি বেরিয়ে যাবে। তখন সে তার চারপাশে ঘানির গাধার মত ঘুরতে থাকবে। তখন জাহান্নামীরা সেখানে জমা হয়ে বলবে, তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতে ও অসৎকাজে নিষেধ করতে? জবাবে সে বলবে, আমি তোমাদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতাম। কিন্তু আমি নিজে তা করতাম না। তোমাদেরকে অসৎকাজের নিষেধ করতাম। কিন্তু আমি সেটা করতাম’। (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫১৩৯ ‘ন্যায়ের আদেশ’ অনুচ্ছেদ)।

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) একদিন সাহাবীদের সামনে নিজের স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করে বলেন, দু’জন ব্যক্তি (অর্থাৎ জিব্রীল ও মিকাঈল) এসে আমাকে একটি পবিত্র ভূমিতে নিয়ে যায়। অতঃপর দেখলাম সেখানে একজন ব্যক্তি বসে আছে ও আরেকজন ব্যক্তি মাথা বাঁকা লোহার সাঁড়াশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে তার গালে সাঁড়াশি ঢুকিয়ে দিয়ে গাল চিরে মাথার পিছনে নিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর আরেক পার্শ্বে সাঁড়াশি ঢুকিয়ে গাল চিরে মাথার পিছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আগের চেরা গালটি জোড়া লেগে যাচ্ছে। পুনরায় সেই গালটি চেরা হচ্ছে। এইভাবে তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত করা হবে। আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে, ফেরেশতাদ্বয় বলেন, ঐ ব্যক্তি মিথ্যাবাদী। সে মিথ্যা বলত এবং তার নিকট হ’তে মিথ্যা রটানো হ’ত। এমনকি তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। অতএব তার সাথে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঐরূপ আচরণ করা হবে’। (বুখারী হা/১৩৮৬; মিশকাত হা/৪৬২১ ‘স্বপ্ন’ অধ্যায়; রাবী সামুরাহ বিন জুনদুব (রা.)।

(৮) অতঃপর রাসূল (সা.)-কে তাঁর জন্য নির্ধারিত সুপারিশের স্থান ‘মাক্বামে মাহমূদ’ দেখানো হয়। তখন তিনি বলবেন, আমাকে ওখানে যেতে দেওয়া হোক। জিব্রীল বললেন, আপনার আয়ুষ্কাল এখনও কিছু বাকী আছে। (বুখারী হা/১৩৮৬; মিশকাত হা/৪৬২১ ‘স্বপ্ন’ অধ্যায়; রাবী সামুরাহ বিন জুনদুব (রা.)। (৯) অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলে চারদিকে আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং জিব্রীল তাকে ছেড়ে যান। এরি মধ্যে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি অহি-র মাধ্যমে কথা বলেন। (১০) তিনি আল্লাহকে স্বরূপে দেখেননি। তাঁর ‘নূর’ দেখেছিলেন। (মুসলিম হা/১৭৮)। তবে তাঁকে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতীগণ পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় স্পষ্ট দেখবেন। (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৬৫৫)। অতঃপর মুসলিম উম্মাহ্র জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়। পরে মূসার পরামর্শক্রমে তাঁর বারবার যাতায়াত ও উপর্যুপরি অনুরোধে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়, যা প্রতি ওয়াক্তের নেকী ১০ গুণ হিসাবে পঞ্চাশ ওয়াক্তের নেকীর সমান। এভাবে তাঁর সঙ্গে সরাসরি আল্লাহ কথা বলেন আকাশে। আর মূসার সঙ্গে কথা বলেন যমীনে, তূর পাহাড়ে (আ‘রাফ ৭/১৪৩-৪৪)। যেমন তিনি কথা বলেছিলেন ইব্রাহীমের সাথে (বাক্বারাহ ২/২৬০; আন‘আম ৬/৭৫)। (১১) সিদরাতুল মুনতাহায় আল্লাহ্র সাথে কথা বলার পর তিনি নেমে আসেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে নবীগণের সালাতে ইমামতি করেন। অতঃপর বোরাকে আরোহণ করে রাত্রি কিছু বাকী থাকতেই মক্কায় মাসজিদুল হারামে ফিরে আসেন (বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬৪, ১৭৮; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৪ ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ)। পুরা ঘটনাটিই ঘটে অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে, যা ছিল মানবীয় জ্ঞানের বহির্ভূত। অথচ বাস্তব সত্য, যা মক্কার মুশরিক ও শত্রুনেতাদের দ্বারা সত্যায়িত।

এভাবে মে‘রাজের মাধ্যমে আল্লাহ শেষনবীর মধ্যে ‘আয়নুল ইয়াক্বীন’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দর্শনলব্ধ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেন। যা অন্য কোন নবীর বেলায় করেননি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দলীল।

সূরা ইসরার শুরুতে মি‘রাজ সম্পর্কিত বর্ণনার পরপরই বনু ইস্রাঈলের অধঃপতন সম্পর্কিত বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, ঈমানী বিশ্বে বনু ইস্রাঈলের দীর্ঘ নেতৃত্বের অবসান এবং মুহাম্মাদী নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল, যা ১৩ নববী বর্ষের যেকোন এক রাতে হয়েছিল বলে একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অতঃপর হিজরত শুরু হয়েছিল ১৪ নববী বর্ষের ২৭ ছফর বৃহস্পতিবার।

মে‘রাজের সঠিক তারিখ উম্মতের নিকটে অস্পষ্ট রাখার তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, তারা যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিগত উম্মতগুলির ন্যায় অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয়ে পড়ে। বরং মে‘রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। অতঃপর মে‘রাজের অমূল্য তোহফা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহ্র আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করে।

কি কি নিয়ে আসেন : মি‘রাজে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তিনটি বস্তু প্রদান করা হয় : (১) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (২) সূরা বাক্বারাহ্র শেষ দু’টি আয়াত (৩) উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে যারা কখনো শিরক করেনি, তাদেরকে ক্ষমা করার সুসংবাদ’। (মুসলিম হা/১৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬৫)।

মি‘রাজের শিক্ষা ও তাৎপর্য : মক্কা থেকে বায়তুল মুক্কাদ্দাসে নৈশ ভ্রমণ করানোর তৎপর্য এটাই হ’তে পারে যে, (১) ইব্রাহীমী দাওয়াতের দু’টি প্রধান কেন্দ্র কা‘বা ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস দুই স্থানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এখন থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর উম্মতের উপরেই ন্যস্ত করা হবে, যা ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরীতে সম্পন্ন হয়। যদিও পাশ্চাত্য বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাইরে থেকে ইহুদীদের এনে ফিলিস্তিনের একাংশ থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা মুসলমানদের বের করে দিয়েছে এবং সেখানে ইহূদীদের জবরদস্তি বসিয়ে দিয়ে তাকে ‘ইস্রাঈল রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে ১৯৪৮ সালে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অস্থায়ী বিষয়, যার অবসান সত্বর হবে ইনশাআল্লাহ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তাদের উপর লাঞ্ছনা অবধারিত করা হয়েছে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, কেবলমাত্র আল্লাহ্র অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। আর তারা নিজেদের উপর আল্লাহ্র ক্রোধকে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা অবধারিত হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ্র আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কেননা ওরা অবাধ্য হয়েছিল এবং সীমালংঘন করত’। (আলে ইমরান ৩/১১২)। ‘আল্লাহ্র অঙ্গীকার’ অর্থ তাদের নারী-শিশু এবং সাধক ও উপাসকরা, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। আর ‘মানুষের অঙ্গীকার’ অর্থ মুসলমান বা অন্যদের সাথে সন্ধিচুক্তি দ্বারা। যেমন তারা এখন টিকে আছে কতিপয় পরাশক্তির উপর ভর করে। যারা সারা পৃথিবীর মানুষের ঘৃণার পাত্র। কারণ ওরা পথভ্রষ্ট। ওরা শেষনবীকে পেয়েও তাঁকে মানেনি এবং ইসলাম কবুল করেনি। সূরা ফাতিহায় ওদেরকে ‘অভিশপ্ত’ ও পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে। এদের সমর্থন ছিন্ন হলেই ইস্রাঈল পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। কিন্তু মি‘রাজের স্মৃতিধন্য ফিলিস্তীন ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ। অতএব হিজরতের পূর্বে মি‘রাজ ঘটনা ছিল পরবর্তীকালে মাদানী জীবনের নব অধ্যায়ের সূচক ঘটনা এবং ইসলামী বিজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

অতঃপর তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তি মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়। অতঃপর উমাইয়া, আব্বাসীয়, স্পেনের উমাইয়া ও মিসরের ফাতেমীয় খেলাফত সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। সবশেষে তুরস্কের ওসমানী খেলাফত মাত্র ১০০ বছর আগে ১৯২৪ সালে শেষ হয়। অতএব মুসলমান আবারও তার হারানো খেলাফত ফিরে পাবে, যদি তাদের নেতৃত্ব সত্যিকারভাবে ইসলামের পথে ফিরে আসে।

(২) ইতিপূর্বে ইব্রাহীম ও মূসাকে দুনিয়াতেই আল্লাহ স্বীয় কুদরতের কিছু নমুনা দেখিয়েছেন। (আন‘আম ৬/৭৫, ত্বোয়াহা ২০/২৩)। কিন্তু কেবলমাত্র মুহাম্মাদ (সা.)-কে আখেরাতের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখানোর মাধ্যমে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তিনিই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। অন্য কেউ এই সুযোগ পাননি এবং পাবেনও না কোনদিন। (৩) অহি-র মাধ্যমে প্রাপ্ত অদৃশ্য জগতের যেসব খবর নবীদের মাধ্যমে জগদ্বাসীর নিকটে পৌঁছানো হয়, সেই সব খবরের সত্যতা স্বচক্ষে যাচাইয়ের মাধ্যমে শেষনবীসহ বিশ্ববাসীকে পরকালের জবাবদিহিতা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে। (৪) এর দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, আখেরী জামানায় মানব জাতির জন্য অনুসরণীয় সর্বশেষ দ্বীন হ’ল ইসলাম ও সর্বশেষ নবী হ’লেন মুহাম্মাদ (সা.)। (৫) মি‘রাজের ঘটনায় একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহ সাত আসমানের উপর আরশে উন্নীত। কিন্তু তাঁর ইল্ম ও কুদরত সর্বত্র বিরাজিত। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন। (শূরা ৪২/১১)। (৬) মি‘রাজে নিজ সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে আল্লাহ মানব জাতির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের যে তোহফা প্রদান করেন, তার দ্বারা একথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভীতিপূর্ণ ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সৎ মানুষ তৈরি হ’তে পারে এবং প্রকৃত অর্থে সামাজিক শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব হ’তে পারে। (৭) মি‘রাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হ’ল, মানুষকে আল্লাহ্র অনুগত দাস হওয়ার চেষ্টা করা। কেননা আল্লাহ্র সর্বাধিক দাসত্বের মধ্যেই মানুষের সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদা নিহিত। আর এজন্যেই আল্লাহ জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫৫/৫৬)। আল্লাহ আমাদেরকে পূর্ণভাবে তার দাসত্ব করার তাওফীক দান করুন-আমীন!

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে দেশটির পতাকা উত্তোলন ছাত্রলীগের

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে দেশটির পতাকা উত্তোলন ছাত্রলীগের

মিল্টন সমাদ্দার মাদকসেবী, তার টর্চার সেলে অত্যাচারের মাত্রা অমানবিক: ডিবি

মিল্টন সমাদ্দার মাদকসেবী, তার টর্চার সেলে অত্যাচারের মাত্রা অমানবিক: ডিবি

সম্পদ অর্জনে এমপিদের চেয়ে চেয়ারম্যানরা এগিয়ে : টিআইবি

সম্পদ অর্জনে এমপিদের চেয়ে চেয়ারম্যানরা এগিয়ে : টিআইবি

দেখতে ঢেউটিনের মতো মনে হলেও এটা ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক!

দেখতে ঢেউটিনের মতো মনে হলেও এটা ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক!

বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের: রিজভী

বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের: রিজভী

ইউপি চেয়ারম্যানকে ‘ডিও লেটার’ বন্ধের হুমকি এমপি একরামের স্ত্রীর

ইউপি চেয়ারম্যানকে ‘ডিও লেটার’ বন্ধের হুমকি এমপি একরামের স্ত্রীর

মাগুরায় বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান

মাগুরায় বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান

২৫ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্ম জয়ন্তী

২৫ বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্ম জয়ন্তী

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও ইজরায়েলের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় পদযাত্রা

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও ইজরায়েলের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় পদযাত্রা

বরগুনায় 'গণমাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা' শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

বরগুনায় 'গণমাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা' শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

আসছে ঘূর্ণিঝড়, দেশজুড়ে কালবৈশাখীর সতর্কতা

আসছে ঘূর্ণিঝড়, দেশজুড়ে কালবৈশাখীর সতর্কতা

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২ ইউনিয়নে প্রখর রোদ আর তীব্র গরম।।দুর্বিষহ চরবাসীর জীবন

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২ ইউনিয়নে প্রখর রোদ আর তীব্র গরম।।দুর্বিষহ চরবাসীর জীবন

বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর প্রাণী অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছে ব্রিটেনে

বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর প্রাণী অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছে ব্রিটেনে

পিরিয়ডে হেভি ফ্লো নিয়ে হ্যাসেল-ফ্রি থাকতে, কী করবেন

পিরিয়ডে হেভি ফ্লো নিয়ে হ্যাসেল-ফ্রি থাকতে, কী করবেন

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন চেয়ারম্যান পদে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন চেয়ারম্যান পদে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

বিশ্বে অস্থিরতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে চীন

বিশ্বে অস্থিরতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে চীন

ইসরায়েলে মার্কিন গোলাবারুদের চালান আটকে দিল বাইডেন প্রশাসন

ইসরায়েলে মার্কিন গোলাবারুদের চালান আটকে দিল বাইডেন প্রশাসন

আল-জাজিরা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জাতিসংঘের

আল-জাজিরা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জাতিসংঘের

স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, ছেলেকে কুমির ভর্তি নদীতে ফেলে দিলেন মা

স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, ছেলেকে কুমির ভর্তি নদীতে ফেলে দিলেন মা

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাক্ষাত

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাক্ষাত