টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের জিআই পণ্য হতে পারে না

Daily Inqilab ইনকিলাব

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম

সম্প্রতি ভারত ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’কে পশ্চিমবঙ্গের জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার এই স্বীকৃতি বা দাবি যে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায্য, তাতে সন্দেহ নেই। এনিয়ে দেশের পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। একটি পণ্যকে জিআই পণ্য হতে হলে তাকে ভৌগোলিকভাবে চিহ্নত হতে হবে। পণ্যের সঙ্গে এলাকার নাম সংযুক্ত হওয়াও একটা শর্ত। এই হিসাবে টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হতে পারে না। এই নামে পশ্চিমবঙ্গে কোনো এলাকা বা স্থান নেই। টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলা। সেখানে উৎপাদিত শাড়ি টাঙ্গাইল শাড়ি হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। এটা বাংলাদেশের জিআই পণ্য। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে আয়োজিত ‘টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি: প্রক্রিয়া পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক এক সভায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, টাঙ্গাইল শাড়ির দাবির ক্ষেত্রে ভারত অসত্য তথ্য ব্যবহার করেছে। ভারত যে তথ্য দিয়েছে, তাতে বলেছে, বসাক তাঁতীরা পশ্চিমবঙ্গে এ শাড়ি তৈরি করে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তো সব বসাক চলে যায়নি। তাদের পাশাপাশি এখানকার মুসলমানরাও এ শাড়ি তৈরি করে। তিনি আরো বলেছেন, ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির যে বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, সেটিকে তারা আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ি থেকে আলাদা বলেছে। তাহলে তাদের সেভাবেই নামকরণ করতে হবে। তাছাড়া ওখানে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্থান নেই। এসব বিবেচনায় ভারতের দাবি যুক্তিযুক্ত নয়। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রসঙ্গক্রমে মসলিন শাড়ির বিষয়টি সামনে এনেছেন। বলেছেন, মসলিন ঢাকার ভৌগোলিক পণ্য হলেও ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ ‘বেঙ্গল মসলিন’ নাম দিয়ে এর জিআই সত্ত্বের আবেদন করেছে। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রেও অসত্য তথ্যের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। মসলিন ঢাকাতে উৎপন্ন এক বিস্ময়কর মিহিতন্তুর কাপড়, যা ‘ঢাকাই মসলিন’ নাম ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। বেঙ্গল মসলিন নামে কোনো কাপড়ের অস্তিত্ব নেই। কোনো কালেই ছিল না।

টাঙ্গাইল শাড়ি কিংবা ঢাকাই মসলিন বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। জিআই পণ্য হিসাবে এদের ষোলআনা অধিকার বাংলাদেশের প্রাপ্য। ভারত তা পেতে পারে না। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশে জিআই পণ্য সম্পর্কিত বিষয়াদি যে কর্তৃপক্ষ দেখাশুনা করে, তার অযোগ্যতা ও অকর্মণ্যতার কোনো তুলনা হয় না। পশ্চিমবঙ্গ টাঙ্গাইল শাড়ি ও মসলিনের দাবি করে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যে আবেদন জানিয়েছে, সেটা গোপন বিষয় নয়। এ সংক্রান্ত তথ্য জানা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ-খবর রাখলে নিশ্চয় আগেই জানতে পারতো। সেক্ষেত্রে যথাসময়ে আপত্তি বা প্রতিবাদ জানতে পারতো। বাংলাদেশের অনুকূলে স্বীকৃতি লাভের পদক্ষেপ নিতে পারতো। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে। তথাকথিত বেঙ্গল মসলিনের স্বীকৃতি প্রদানও প্রক্রিয়াধীন। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ কী করতে পারে দেখতে হবে। সিপিডির ওই সভায় ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মসলিনের বিষয়ে ভারতের কাছে এখনই আপত্তি জানাতে হবে। আর টাঙ্গাইল শাড়ির বিষয়ে বাংলাদেশের উচিত দ্রুত ভারতের আদালতে মামলা করা। ভারতের নিজস্ব আইনে সেই মামলা করার সুযোগ আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পণ্য হিসাবে পরিগণিত দুটি গুরুত্বর্পূ ‘ঐতিহ্য’ ও ‘সংস্কৃতি’র অধিকার বা দাবি ছেড়ে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে। ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য যত রকমের উপায় ও পথ আছে, তা কাজে লাগাতে হবে। দু’ দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে এনিয়ে কথাবার্তা হতে পারে। দু’ দেশের সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত, দু’ সরকারই এ দাবি করে থাকে। তাই, ভারতের অযৌক্তিক দাবি থেকে সরে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে অনুরোধ জানাতে পারে। গত কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলেও সরকারের অবস্থান খোলাসা হয়নি। দেশের মানুষ সেটা ভালোভাবে নিচ্ছে না।
একটি পণ্য প্রথম কোথায় উৎপন্ন বা উৎপাদিত হয়েছে। সেটা পণ্যের মান ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য দরকারি। এই ধারণা থেকে পরবর্তীকালে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানই যে কোনো পণ্যের জন্য কোনো দেশকে একক বা যৌথভাবে জিআই স্বীকৃতি প্রদান করে। দৈদেশিকভাবেও বিভিন্ন দেশের পণ্যের জিআই স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে যথেষ্ট সক্রিয় ও সতর্ক নয়, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষকে সজাগ ও গতিশীল করতে হবে। ডব্লিউআইপিও এর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২০২৫ সাল থেকে পণ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কড়াকড়ি পালন করা হবে। করোনার কারণে সেটা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০৩০ সালের পরে কোনো দেশের জিআই পণ্যের উৎপাদন অন্য দেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। উৎপাদন করতে পারবে, তবে অনুমতি নিতে হবে এবং এজন্য ওই দেশকে অর্থও দিতে হবে। ধরা যাক, ভারতে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া টাঙ্গাইল শাড়ি যদি একই নামে বাংলাদেশ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে চায় তবে ভারতের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে এবং তাকে অর্থ দিতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, টাঙ্গাইলের শাড়ি শুধু বাংলাদেশেই জনপ্রিয় নয়, বিদেশেও তার বিপুল চাহিদা আছে। ভারতেও এই শাড়ি রফতানি হয়ে থাকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি ভারতের অধিকারে চলে গেলে এ শাড়ি উৎপাদন, রফতানি সবকিছুই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। এ ধরনের আশংকার প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন দেশ তাদের উৎপাদিত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যের দৈশিক ও আন্তর্জাতিক জিআই স্বীকৃতি অর্জনের উদ্যোগ ও চেষ্টা জোরদার করেছে। আমাদেরও সেটা করতে হবে। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক স্বার্থেই এর অপরিহার্যতা প্রশ্নাতীত।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী