মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে জায়নবাদ বিরোধী গণবিপ্লব

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০১ মে ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৪, ১২:১১ এএম

এ সপ্তাহে প্রকাশিত মার্কিন লেখক-গবেষক ক্রিস হেজেস’র লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘রিভল্ট ইন দ্য ইউনিভার্সিটিজ’। গাজায় হামাস নির্মূলের নামে সাত মাস ধরে চলা গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছে। বিশেষত, ইসরাইলের আত্মরক্ষার নামে জায়নবাদী ইসরাইলী বাহিনীর প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শর্তহীন সমর্থন-সহযোগীতার কারণে যুদ্ধ একটি প্রলম্বিত হত্যাযজ্ঞে রূপ নেয়ার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা জনগণ এখন আর একটি গণহত্যার দায়ভার বহন করতে ইচ্ছুক নয়। এমনকি ইসরাইলের সাধারণ বাসিন্দারাও এখন কষাই নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধের দায় নিতে প্রস্তুত নয়। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক দুঃসাহসী অভিযানের পর থেকে জিম্মি উদ্ধার ও হামাস নির্মূলের নামে গাজায় নির্বিচার বোমা বর্ষণ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সাধারণ ইসরাইলী নাগরিকরা নেতানিয়াহুর পদত্যাগ ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে রাস্তায় নামে। নেতানিয়াহুর হামাস নির্মূলের বাগাড়ম্বর ইতোমধ্যে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে। সাত মাসে প্রায় ১৫ হাজার শিশুসহ ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং প্রায় ৭৫ হাজার মানুষকে পঙ্গুত্ব এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেও তারা হামাসের হাতে আটক একজন ইসরাইলী বন্দীকেও মুক্ত করতে পারেনি। অবশেষে দেড়মাস আগে দেয়া হামাসের প্রস্তাব মেনে নিয়ে একটি নতুন বন্দি বিনিময় ও যুদ্ধ বিরতির আলোচনা চলছে বলে জানা যাচ্ছে। অন্যদিকে গাজা উপত্যকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত, ১০ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির শেষ আশ্রয় রাফাহ এলাকায় বড় ধরনের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইলী সেনাবাহিনী। এখানে যে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান-আগ্রাসন আরো বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারে। পুরো উত্তর ও দক্ষিণ গাজাকে ধ্বংসপুরিতে পরিণত করেও যখন হামাস নির্মূল তো দূরের কথা, এতটুকু দুর্বলও করতে পারেনি, সেখানে রাফায় সামরিক অভিযান চালানোর মানে হচ্ছে, অহেতুক যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা। গণবিক্ষোভ ও জনরোষে গদি হারানোর ভয়ে আক্রান্ত নেতানিয়াহু নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে প্রলম্বিত করতে চাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। শুধু গদি হারানোই নয়, নেতানিয়াহু এখন গ্রেফতার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। ইসরাইলী পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের আলোকে সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যরা সম্প্রতি একটি গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। তারা ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং সেনা প্রধান হার্জি হালভির বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মাত্রা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। গাজায় গণহত্যা এবং ইসরাইলের সামরিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতা এখন এক চূড়ান্ত পরাজয় ও পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ডিপস্টেটের স্টাবলিশমেন্টের নিষেধাজ্ঞা, প্রতিবন্ধকতা ও নিপীড়ন উপেক্ষা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইনে যোগ দেয়া এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরাইলে বিনিয়োগ ও সহায়তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার মধ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিংশ শতকের দুইটি বিশ্বযুদ্ধে সাবেক বিশ্বব্যবস্থার মূল্যবোধসহ সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার মধ্যদিয়ে নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসরাইল নামের একটি অবৈধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের মত বেড়ে ওঠার খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে। গাজা যুদ্ধে ইসরাইলী গণহত্যার দৃশ্য বিগত ৭৫ বছর ধরে চলা জায়নবাদী নিপীড়ন ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের স্মৃতিকেই যেন আরো জীবন্ত করে তুলেছে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র একটি হেজিমনিক এজেন্ডা সামনে রেখে ইসরাইল নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবকে নিজেদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। ভোগবাদী জীবনদর্শন এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদী চিন্তাধারার রাজনৈতিক-অর্থনীতির আলোকে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব মূলত জায়নবাদী লবির করতলগত হয়ে পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর কাদের প্রভাব বেশি? এমন প্রশ্নের জবাবে সকলেই একবাক্যে ইসরাইলপন্থী লবি ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর কথা বলবেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিও সাক্ষাতকারে অস্ট্রেলিয়ার এক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে জায়নবাদী লবির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার কথা উঠে আসে। বিশ্বের একনম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের উপর ইসরাইলী লবির প্রভাব একটি প্রবাদতুল্য অভিধায় উপনীত হয়েছে। তারাই দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ইসরাইলকে একটি মারকুটে অজেয় শক্তির তকমা সাঁটিয়ে বসে আছে। পারমাণবিক মারণাস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সক্ষমতা প্রমাণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় নিজের ভাণ্ডারে নেয়ার পর থেকে সামরিক শক্তিই যেন বিশ্বের কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। বিশাল মধ্যপ্রাচ্যের উপর ইসরাইলের অনৈতিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আধিপত্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠিকে নির্মূল এবং ক্রমবর্ধমান ভূমি দখলের পৈশাচিক তৎপরতার বিরুদ্ধে হামাস-হেজবুল্লাহর অভাবনীয় অসম সাহসী প্রতিরোধের মুখে গত ২ দশকে ইসরাইলী বাহিনী বার বার লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলেও তাদের আগ্রাসী ভূমিকা ক্রমেই বেশি অবমাননাকর, রক্তাক্ত ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রত্যাঘাত করেছিল। ইসরাইলের সীমান্ত প্রাচীর, নিরাপত্তাব্যুহ এবং অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা ভেঙ্গে শত শত হামাস যোদ্ধা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে দুই শতাধিক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে আটক করে গাজায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ইসরাইলের জন্য একটি অনিবার্য আতঙ্ক ও ট্রমা সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন নিয়েও হামাসকে নির্মূল করতে না পারা, গাজা সিটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা এবং নিজ বাহিনীর ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণের পর নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলের শীর্ষ নেতারা বিশ্বসম্প্রদায়ের চোখে ভিলেন, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের বিচারের রায়ে তারা এখন গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। ইসরাইলের জায়নবাদী নেতাদের জন্য অতীতে আর কখনো এমন দুঃস্বপ্নের দুঃসময় আসেনি। তারা নিজ জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, যাদের উপর ভর করে তারা দীর্ঘদিনে দানবীয় সামরিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল সেই পুরনো পরীক্ষিত বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের টানপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনি সংহতির শক্তি বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার বাস্তবতা জায়নবাদী ইসরাইলের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পঁচাত্তর বছর ধরে বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা ও সংহতির ডায়াসপোরা এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

সাত মাসের যুদ্ধে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তুপের কাছাকাছি স্থানগুলোতে যে সব নতুন নতুন গণকবর আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেখানে একসাথে শত শত ফিলিস্তিনিকে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি জীবন্ত মানুষকে মাটি চাপা দেয়ার প্রামাণ্য অভিযোগও উঠে আসছে। ২০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হলেও তারা প্রাণভয়ে নিজের মাটি ত্যাগ করেনি। অন্যদিকে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই লাখ লাখ ইহুদি ইসরাইল ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। শুধু অক্টোবর মাস নাগাদ এ সংখ্যা ছিল ৫ লাখের বেশি। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে লেবাননের হেজবুল্লাহ যোদ্ধাদের ধারাবাহিক আক্রমণে সীমান্তবর্তী কয়েকলাখ ইহুদি সেটেলার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এরা আর এসব বাসস্থানে ফিরে আসতে চায়না বলে জানা যাচ্ছে। ইসরাইলে এবং পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত অর্থডক্স ইহুদিরা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা জায়নবাদী ইসরাইলের অস্তিত্বকে মানতে নারাজ। তারা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা হরণ ও ভূমি দখল করে জায়নবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বিরোধী। এদের মধ্যে অনেক বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটি রয়েছেন। নোবেল লোরিয়েটসহ এমন শতাধিক ব্যক্তিত্ব ২০০৮ সালে ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎযাপন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন এবং আরব প্রতিবেশীদের সাথে ইসরাইলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কার্যকর উদ্যোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা ছাড়া ইসরাইলের স্বাধীনতা মানতে রাজি নন। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ওয়াশিংটনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ক্যাপিটাল হিলে প্রতিবাদ সমাবেশ করে কয়েকশত ইহুদি গ্রেফতার বরণ করেছিলেন। একজন মার্কিন বিমান সেনা অ্যারন বুশনেল ওয়াশংটনে ইসরাইল দূতাবাসের ফটকের সামনে ফিলিস্তিনের মুক্তির দাবি উচ্চারণ করতে করতে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মাহুতি দিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আর্কষণ করেছিলেন। এভাবেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আগুন পশ্চিমা বিশ্বে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে। গত সপ্তায় কলাম্বিয়ার আইভি ইউনিভার্সিটিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ দমনে মার্কিন পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে আটক করলে বিক্ষোভ আরো প্রবল আকার ধারণ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাবু গেঁড়ে আরো সংঘবদ্ধ বিক্ষোভের ডাক দিলে তা সারা দেশে শত শত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লেখক-কলামিস্ট ক্রিস হেজেস ফিলিস্তিনি সংহতির এই অভূতপূর্ব গণজোয়ারকে ফিলিস্তিনের পক্ষে ‘ইউনিভার্সিটি রিভ্যুলেশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাত দশক ধরে জায়নবাদী কর্পোরেট মিডিয়া এবং থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের মধ্যে তথাকথিত এন্টি সেমিটিজম ও ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের তকমা ঝুঁলিয়ে এক ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক গ্যাঁড়াকলে বেধে রেখেছিল। হামাস যোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত, ফিলিস্তিনের নারী, শিশু ও সর্বস্তরের মানুষের অচিন্তনীয় আত্মত্যাগ বিশ্ববিবেকের উপর করাঘাত করেছে। শুধু মুসলমানরা নয়, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী সব মানুষ এখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন।

কামান-বন্দুকের মুখে আরব মুসলমানদের কাছ থেকে জমি ও বসতবাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলমানের রক্তের উপর একটি অবৈধ জায়নবাদী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয়া কঠিন হলেও বেশিরভাগ আরব মুসলমান দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের পাশে ইসরাইলকে মেনে নিতে এখনো রাজি হওয়া মুসলমানদের ত্যাগ ও উদারতার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু জায়নবাদীরা এখনো স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রকল্প গণহত্যার গণকবরে ধামাচাপা দিতেই সবকিছু করে যাচ্ছে। নিওকন ফ্যাসিবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের মার্কিন মধ্যস্থতা ও প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমের উপর ইহুদিদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে সেখানে মার্কিন কনসুলেট ভবন স্থানান্তরের নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছিলেন। এটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আরব-ইসরাইল সমস্যার দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক সমাধানের কফিনে শেষ পেরেক। বৃটিশদের ফর্মুলায় ইসরাইল নামক রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা ও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। পঁচাত্তর বছর ধরেই ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, আগ্রাসন ও গণহত্যা চালিয়ে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে জনমানব শূন্য করতে চেয়েছে। পশ্চিমাদের শঠতা এবং আরব রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বার বার সম্মিলিত আরব বাহিনী জায়নবাদী ইসরাইলের সাথে হেরে গেলেও জানবাজ হামাস-হেজবুল্লাহ, হুতি ও ইরানের আইআরজিসির সমন্বিত আক্রমণে এবার ইসরাইলের মরণ ঘন্টা বেজে উঠেছে। ইউরোপ থেকে উড়ে আসা ইহুদিরা ইসরাইল ত্যাগ করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই কমছে ইহুদির সংখ্যা। এরপরও যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী নেতানিয়াহু রাফায় নতুন অভিযান ও গণহত্যার প্লট তৈরী করেছে। ওরা ইসরাইলের ধ্বংসের ঝুঁকি নিতে রাজি থাকলেও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি মানতে রাজি নয়। তবে ইতিহাস কখনো পরাজিতদের কথায় চলে না। ইসরাইল এবার পরাজিত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রীক সমাধানের পথে না হাটলে একক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রেই আবার ইহুদিদের বসবাস করতে হবে। অতীতে শত শত বছর ধরে ইহুদিরা মুসলমান শাসকদের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ণ নিরাপত্তায় বসবাস করার নজির রয়েছে। আশি বছরের ইহুদি রাষ্ট্রে বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের ন্যূনতম মানবিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ হয়নি। এটাই ঐতিহাসিক পার্থক্য। গত দশকের মাঝামাঝিতে লেবাননের হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ইসরাইলের ইহুদিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ইসরাইল ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই আপনারা ইসরাইল ত্যাগ করুণ। জায়নবাদ আপনাদের এবং আমাদের কমন শত্রু। বাইবেলে ৮ দশকের মধ্যে ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার ভবিষ্যদ্বানি করা হয়েছে। জায়নবাদিদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল ও ভঙ্গুর। তারা ইসরাইল ত্যাগ করছে। করতেই থাকবে। পশ্চিমা বিশ্বে এবারের গণহত্যা ও জায়নবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে অবস্থান করছে ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে গণবিপ্লবে ইহুদি-খৃষ্টানরাও সামিল হয়েছে। জায়নবাদ-ফ্যাসিবাদ সকলের কমন শত্রু। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদ জায়নবাদেরই দোসর। জায়নবাদের সাথে যেমন ইহুদি ধর্মের কোনো মিল বা সমর্থন-সাজুয্য নেই। তেমনি পৌরাণিক সনাতন ধর্মের সাথে হিন্দুত্ববাদের কোনো মিল বা সমর্থন নেই। গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমাবেশে যোগ দিয়ে কানাডিয়ান লেখিকা-অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইন ইহুদিদের জায়নবাদ ত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। ১০ মিনিটের বক্তব্যে নাওমি ক্লেইন জুদাইজমের প্রতিটি মূল্যবোধের সাথে জায়নবাদের বৈপরীত্য তুলে ধরেন। ইহুদিবাদের নামে জায়নবাদের মিথ্যা প্রতিমার পূজা বন্ধ করে ফিলিস্তিনের সাথে অভিন্ন মূল্যবোধ ধারণ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে বরণ করে নেয়ার আহ্বান জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জায়নবাদ বিরোধী বিডিএস আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। ভারত ও ইসরাইল বয়কটের প্রায় একই রকম আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। গাজার শিশুদের রক্তবীজে এক নতুন বিশ্বের জন্ম হতে চলেছে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নেটদুনিয়ায় আলোড়ন

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নেটদুনিয়ায় আলোড়ন

ঢাকায় ৩১ মে ইসলামী আন্দোলনের গণমিছিল

ঢাকায় ৩১ মে ইসলামী আন্দোলনের গণমিছিল

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জন দাবিতে লিফলেট বিতরণ

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জন দাবিতে লিফলেট বিতরণ

ইরানের প্রেসিডেন্ট মুসলিম উম্মাহর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

ইরানের প্রেসিডেন্ট মুসলিম উম্মাহর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

চাঁদপুরে তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান হলেন যারা

চাঁদপুরে তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান হলেন যারা

লক্ষ্মীপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

লক্ষ্মীপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সেলফি তোলার ধুম ২ মার্কিন তরুণীর

মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সেলফি তোলার ধুম ২ মার্কিন তরুণীর

সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল বানাতে বানাতে নিজেকে গুলি ১৭ বছর বয়সী র‍্যাপারের

সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল বানাতে বানাতে নিজেকে গুলি ১৭ বছর বয়সী র‍্যাপারের

দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে : সিইসি

দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে : সিইসি

ইরানকে আনুষ্ঠানিক সমবেদনা জানালো আমেরিকা

ইরানকে আনুষ্ঠানিক সমবেদনা জানালো আমেরিকা

মাগুরার শ্রীপুরে আওয়ামী লীগের দু’নেতার সমর্থকদের সংঘর্ষ বাড়ি-ঘর ভাঙচুর-লুটপাট

মাগুরার শ্রীপুরে আওয়ামী লীগের দু’নেতার সমর্থকদের সংঘর্ষ বাড়ি-ঘর ভাঙচুর-লুটপাট

যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি উলটে ৩ ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীর মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি উলটে ৩ ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীর মৃত্যু

চুয়াডাঙ্গায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলাকালীন বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৭ জনকে দন্ডাদেশ ও জরিমানা

চুয়াডাঙ্গায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলাকালীন বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ৭ জনকে দন্ডাদেশ ও জরিমানা

তুরস্কের ড্রোন যেভাবে রাইসির হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়

তুরস্কের ড্রোন যেভাবে রাইসির হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়

বিরলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হলেন যারা

বিরলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হলেন যারা

বৈধতা না দিলেও আইসিসি’কে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র: রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত

বৈধতা না দিলেও আইসিসি’কে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র: রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সময় বাড়াতে চিঠি দেওয়া হয়েছে: প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সময় বাড়াতে চিঠি দেওয়া হয়েছে: প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী

স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অভিনিবেশ ও কর্মস্পৃহা সভা আগামীকাল

স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অভিনিবেশ ও কর্মস্পৃহা সভা আগামীকাল

কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নাছির উদ্দীন, ভাইস চেয়ারম্যান সুইপ্রু মারমা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী বিউটি হোসেন

কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নাছির উদ্দীন, ভাইস চেয়ারম্যান সুইপ্রু মারমা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী বিউটি হোসেন

ইব্রাহিম রায়িসি ও তার সফরসঙ্গীদের শাহাদাত: ইরানের সর্বোচ্চ নেতার শোকবার্তা

ইব্রাহিম রায়িসি ও তার সফরসঙ্গীদের শাহাদাত: ইরানের সর্বোচ্চ নেতার শোকবার্তা