মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর পরাজয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্ন

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

জনগণের মধ্যে প্রত্যাশার স্বপ্ন থাকলে এবং রাজনৈতিক সাংগঠনিক তৎপরতা থাকলে কোনো জনসমর্থনহীন শাসক ও তার ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণী শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর ভর করে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনা। জনগণের নীরব প্রতিবাদ একসময় গণবিস্ফোরণে পরিনত হতে খুব বেশি সময় লাগে না। এ জন্য কখনো কখনো পূর্ব নির্ধারিত কোনো নেতৃত্বেরও প্রয়োজন পড়ে না। বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে ১৯৪৮ সালে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মিয়ানমারের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। দীর্ঘ ৭৬ বছর পেরিয়ে এসেও মিয়ানমারের মানুষের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বাদ পূরণ হয়নি। দেশের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের কাছে কোটি কোটি মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার তথা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামগ্রিক বিকাশের পথপরিক্রমা কিভাবে অবরুদ্ধ হতে পারে, বার্মা বা মিয়ানমার তার জ্বলন্ত উদাহরণ। শুধু মিয়ানমার নয়, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিরোধী ডগমা, আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি, সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষ ও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত ও আক্রান্ত হয়ে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার নিগড়ে বন্দি হয়ে আছে। শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের নামই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচন ব্যবস্থা, জনমত গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশনের আলোকে মানবিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও অধিকারের সংরক্ষণে আইনের শাসন নিশ্চিত করা ছাড়া গণতন্ত্রের বিকাশ নিশ্চিত করা অসম্ভব। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সামরিক বাহিনীকে পরিচালনার পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ, নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্যের মেলবন্ধন না থাকলে সামরিক শক্তি জনগণের পরিপন্থী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে, দেশের জনগণও রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা বাহিনী গঠন করে গৃহযুদ্ধের আঞ্জাম দিতে পারে। এটি হঠাৎ করে বার দিনক্ষণ ঠিক করে ঘটেনা, দীর্ঘদিনের নিপীড়ন-বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অস্তিত্বের সংকটের ধারাবাহিকতায় তা ক্রমশ শক্তিশালী ও তীব্রতর বাঁচামরার লড়াইয়ে পরিণত হতে দেখা যায়। জায়ানবাদী ইসরাইলীদের হাতে ফিলিস্তিনি জনগণের বাস্তুচ্যুতি-স্বাধীনতার লড়াই, মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভ এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ মানুষের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস প্রায় একই সময়ের। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে দুইশ’ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তে বৃটিশরা সামিাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে মাত্র ১০ ভাগ ইহুদি জনগোষ্ঠির জন্য সামরিক শক্তির জোরে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি স্থায়ী সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্য বজায় রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নেয়। এটি এখন মানবমুক্তি ও সমগ্র মানব সভ্যতার বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, রাজনীতি ও দেশভাগের ক্ষেত্রে বৃটিশদের অবিমৃশ্যকারী ভূমিকার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে জাতিগত সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উত্থান এবং আন্ত:সীমান্ত ও আন্তরাষ্ট্রীয় বিভেদ শান্তি ও সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে একেকটি জাতির উপর অ্যাপল অব ডিসকর্ড বা সোর্ড অব ডেমোক্লিস হয়ে ঝুলে আছে।

সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র হচ্ছে গণমানুষের অভিপ্রায়ের ফসল। এক সময় সে অভিপ্রায়ের নেতৃত্বে যুদ্ধজয়ী রাজা-বাদশা, স¤্রাট-সেনাপতিদের প্রতাপ প্রতিপত্তি প্রকাশিত হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, শিল্পবিপ্লব ও ঔপনিবেশোত্তর বিশ্বে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বিকাশের ধারাবাহিকতায় পুরনো সা¤্রাজ্যগুলো ভেঙ্গে নতুন নতুন রাষ্ট্র ও জনমতের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থার সমুহ সম্ভাবনাকে নিজেদের কব্জায় রাখতে পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তি ও নব্য সা¤্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র আঞ্চলিক সংঘাত ও বিরোধের বিষয়গুলোকে জিইয়ে রাখতে বা অমিমাংসিত রাখতেই যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা নাহলে, গায়ের জোরে সৃষ্ট ইসরাইলীদের দ্বারা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন আবাসভ’মির স্বীকৃতির জন্য সাড়ে ৭ দশক ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের কোনো কারণ ছিল না। নিপীড়নের বুলডোজারের চাকায় ধ্বংসযজ্ঞ, টার্গেটেড কিলিং ও গণহত্যার চরম মুহূর্তে জীবন বাজি রেখে হামাস-হেজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদের রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প এবং ৭ অক্টোবরের মত অভিযানের মধ্য দিয়ে ইতিহাস পাল্টে দেয়ার নতুন পটভূমি সৃষ্টি হতো না। গাজা উপত্যকায় রাষ্ট্রহীন বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের উপর দুই দশকের অবরোধ এবং প্রতিদিন শত শত বিমান হামলা চালিয়ে হাজার বছরের পুরনো এই জনপদটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে, প্রায় ১৩ হাজার শিশুসহ ২৮ হাজার মানুষকে নির্বিচার হত্যা ও ৭০ হাজার মানুষকে আহত ও চিকিৎসাবঞ্চিত করে, ২০ লাখের বেশি মানুষকে খাদ্য, পানি ও বেঁচে থাকার ন্যুনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার পরও হামাস-হেজবুল্লাহসহ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে মার থেকে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছে জায়নবাদী ইসরাইলীরা। ইতিহাসের এ এক বিষ্ময়কর রূপান্তর। পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে হাজার হাজার মানুষের মিছিল এবং ইসরাইলকে বয়কট, প্রত্যাখ্যান ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক বিচারের সম্মুখীন করতে একটি নিরঙ্কুশ জনমত গড়ে উঠতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্নভঙ্গ ও রোহিঙ্গা গণহত্যার কুশীলব সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা আঞ্চলিক বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হাতে মার খেয়ে জান্তা সরকারের অনুগত বাহিনী পরাজিত হতে হতে এখন দেশ ছাড়তে শুরু করেছে। মিয়ানমারের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা এখন জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে মার খেয়ে জান্তা বাহিনীর শত শত সদস্য প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন ভারত, বাংলাদেশ, চীন, থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকায় ঢুকে পড়ছে। এক সময়ের মুঘল সা¤্রাজ্য ও বৃটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকার ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে প্রতিটি জাতির ভূরাজনৈতিক সংকটের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলো সরাসরি আক্রান্ত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। আরাকান, কাশ্মির, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, কুর্দিস্তান ও সেভেন সিস্টার্স এর রাজনৈতিক সমস্যা ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার বাংলাদেশের গ-ি ছাড়িয়ে ইরান,আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। আরাকান বা রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকট যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশকে সরাসরি আক্রান্ত করছে।

পূর্ব-পশ্চিমের আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্ব আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিরোধগুলোতে নিজ নিজ পন্থা ও পরিকল্পনায় জ্বালানি যুগিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সা¤্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় রাশিয়ার নিরব থাকার হয়তো কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমাদের অপতৎপরতার কারণে ২০১৪ সালে রাশিয়াকে ক্রিমিয়া দখলে নিয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনভুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেখানেও ক্রিমিয়ার জনগণের রাজনৈতিক সমর্থন রাশিয়ার পক্ষে থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের নিরব দশর্কের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা, ন্যাটো ও পেন্টাগনের অস্ত্রের ভান্ডার জেলেনস্কির কিয়েভ সরকারের জন্য অবারিত হস্তে খুলে দেয়ার পরও রাশিয়াকে ইউক্রেন দখল থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিবেশিরা এবং ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ জনমত পশ্চিমাদের বিপক্ষে থাকায় তাদের বিপুল সমরসজ্জা তেমন কোনো কাজে আসেনি। ইরানের সরবরাহ করা সস্তা দামের গাইডেড ড্রোন দিয়ে কোটি ডলারের পশ্চিমা অস্ত্রভা-ার তছনছ করে দিয়ে দখলদার রাশিয়ান বাহিনীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থনপুষ্ট জান্তা সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে রাখাইন, চিন, কাচিন, শান, মান্দালয়, মন, কায়া রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর গৃহযুদ্ধ এখন চুড়ান্ত পরিণতি লাভ করতে শুরু করেছে। মিয়ানমারের রাজনীতিকে চীনের বহুমাত্রিক ভূমিকা থাকলেও অগণতান্ত্রিক জান্তা সরকারের প্রতি তার সমর্থন অনেকটা স্পষ্ট। রোহিঙ্গা সংকট ও প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পদক্ষেপের উপর যখন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নির্ভর করছিল, তখন চীন, রাশিয়া ও ভারতকে জান্তা সরকারের পক্ষে প্রায় অভিন্ন অবস্থান নিতে দেখা গেছে। একটি পরিকল্পিত গণহত্যার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে নির্মূল করা হচ্ছে, মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। জান্তার সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মুখে ধুলো দিয়ে চীন-রাশিয়া ও ভারতের গণবিরোধী অবস্থান উপমহাদেশে একটি পরিকল্পিত গণহত্যাকে উৎসাহিত করছে। এখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অবস্থান ও বিভিন্ন পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট অন্যদের ভ’মিকা পরিববর্তনে তেমন কোনো কাজে আসেনি। তারই অনিবার্য পরিনতি হিসেবে এখন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের চরম পরাজয়ের পাশাপাশি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় অখ-তা ও নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিরোধে শক্তিশালী কোনো পক্ষের ইন্ধন থাকলে যে কোনো রাষ্ট্রের পতনের জন্য কোনো বহি:শক্তির আগ্রাসনের প্রয়োজন পড়ে না। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

স্বাধীন বার্মার ৭৫ বছরের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি সময় সামরিক শাসনের অধীনে কাটিয়েছে। ভারত-চীনের মত দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মাঝখানে অবস্থান এবং ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় মিয়ানমারের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা খবরদারি করা কৌশলগতভাবে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে সাফল্যজনক তেমন কিছুই করতে পারেনি। দশকের পর দশক ধরে বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চীন-রাশিয়ার সমর্থনে কোনো রকমে টিকে থাকতে পারলেও দেশটির সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ জনগণের ভাগ্যন্নোয়নে কোনো কাজে লাগেনি। তবে মিয়ানমারের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতি রেখে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী অ্যাপারেটাসগুলোর ধারাবাহিক তৎপরতা কখনো বন্ধ হয়নি। এসব তৎপরতার বাঁধা ডিঙিয়ে মিয়ানমারের মত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করা অসম্ভব। ¯œায়ুযুদ্ধের সময় মিয়ানমারের সামরিক শাসন পশ্চিমাদের কাছে তেমন গুরুত্ব না পেলেও ¯œায়ুযুদ্ধোত্তরকালে ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের প্রথম গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি(এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে সামরিক শাসন অব্যাহত রাখে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে অং সান সুচিকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার চাপে ২০ বছর পর ২০১০ সালে জান্তা সরকার একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে নিজেদের বিজয় দাবি করলেও দেশের জনগণ ও বিরোধীদলগুলো ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপের মুখে মাঝে মধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্মোচন ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করলেও নির্বাচনে সেনা সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় ও বিরোধীদলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ইঁদুর-বেড়াল খেলা মিয়ানমারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাগ্যকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের চাপ ও উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত দেশটির গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোর বিজয়ে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। মিয়ানমারকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের শুরু হিসেবে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত বার্মা অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বার্মিজ সামরিক জান্তা সরকার বা স্ট্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ কাউন্সিল (এসএসি)’র স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দলগুলোর চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এটি এক যুগান্তকরী অনুমোদন। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলগুলো এই অনুমোদনের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর পক্ষের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে বিপুল শক্তি ও গতি সঞ্চারিত হয়ে জান্তা সরকার এখন চরম পরিনতির দিকে এগিয়ে চলেছে।

পশ্চিমা সমর্থনের কারণে নয়, জনগণের সমর্থন ও গণতন্ত্রের জন্য বিপুল ত্যাগ ও জনবাজ লড়াই তাদেরকে বিজয়ী শক্তিতে পরিনত করেছে। তবে ভূরাজনীতির পরাশক্তি কুশীলবদের খেলা এখন এক জটিল আবর্তে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মিয়ানমারের পর দাবার গুটি বাংলাদেশের দিকেই ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। বার্মা অ্যাক্টের মত বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক তৎপরতার সাথে দেশের বিরোধীদল ও গণতন্ত্রকামী মানুষের আগ্রহ ও সমর্থন লক্ষ্যণীয়। বিরোধীদলের প্রায় সব শীর্ষনেতাসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী আটক, গুম-খুন, নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বাইরে রেখে বারবার একপাক্ষিক, অস্বচ্ছ ও অগণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা সব সময়ই শাসক ও রাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। পরিবর্তিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের সমর্থনকে অগ্রাহ্য করে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসক ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী