কিশোর গ্যাং রুখতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৬ এএম

কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য সীমা অতিক্রম করেছে। গ্যাং কালচারের এই বিস্তার দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হুমকি। যারা জাতির ভবিষ্যৎ বলে পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যেই যদি প্রায় সব ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তাহলে জাতির আগামী দিনগুলো যে অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি চুরি, ডাকাতি, মাদক কারবার ইত্যাদি ভয়ংকর অপরাধ কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা অবলীলায় সংঘটিত হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র মতে, গত ৫ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে দু’শতাধিক খুন হয়েছে। এই সময়ে অন্যান্য অপরাধ কী পরিমাণে হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। রাজনৈতিক উদ্যোগ, প্রভাব, প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো অপরাধী চক্র গড়ে উঠতে ও টিকে থাকতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষেত্রে একথা সত্য। কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনরা জড়িত আছে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কিশোর গ্যাং আছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে রাজধানীর কিশোর গ্যাংয়ের এলাকাভিত্তিক একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই খবরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স সম্পর্ক বলা হয়েছে, তারা কিশোর নয়, তাদের বয়স ১৯-২০ বছরের মধ্যে। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা এখন ৮০। আট মাস আগে ছিল ৫২। অর্থাৎ এই সময়ে দেড় গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সূত্র মতে, কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলররা জড়িত আছে। তারাই কিশোর গ্যাংয়ের লালন-পালন ও সুরক্ষা করছে। কাউন্সিরদের ৮৫ শতাংশই সরকারি দলের। অর্থাৎ সরকারি দলের ছত্রছায়াতেই কিশোর গ্যাং বহাল তবিয়েতে টিকে আছে। দেশের অন্যত্রও কিশোর গ্যাং গঠন-পালনে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জনসভায় লোক আনা, প্রভাববলয় ঠিক রাখা, প্রতিপক্ষকে দমন করা ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহার করা হয়।

এটা পুনর্বার উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে দণ্ডায়মান আছে ক্ষমতাসীন দল। ফলে এমন কোনো শক্তি নেই, যে কিশোর গ্যাং রুখতে পারে, গ্যাং কালচার ডেড স্টপ করতে পারে। সরকারের কঠোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আগেই স্বীকার করেছে, কিশোর গ্যাং দমন বা নির্মূল করা তার পক্ষ সম্ভব নয়। সরকারের অভয় ও সরকারি দলের পোষকতা থাকলে পুলিশের সাধ্য কী, একে দমন করে। সেটা পুলিশ যেমন বোঝে, অতি সাধারণ মানুষও বোঝে। কাজেই যা কিছু করার সরকারকে এবং সরকারি দলকেই করতে হবে। সম্প্রতি পুলিশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করেছে। এরকম লোক দেখানো আটকে কোনো লাভ হবে না। এর আগেও কিশোর গ্যাংবিরোধী অভিযান ও আটক করা হয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, কিশোররা গ্যাং কালচারে আকৃষ্ট ও অভ্যস্থ হয়ে উঠছে কেন? এর একটা বড় কারণ অভাব, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, যাকে এক কথায় বলা যায় অর্থনৈতিক। দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অধিকাংশই এসেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। অভাব নিম্নবিত্ত পরিবার তো বটেই, মধ্যবিত্ত পরিবারকেও পথে বসিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়, এসব পরিবারের সন্তানেরা নিরূপায় হয়ে পড়েছে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের অভাবও প্রচণ্ড। সহজে জীবনধারণ ও যাপন করার মতো কাজের সংস্থান দেশে নেই। বেকারের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন একটা অবস্থা হয়েছে, কিশোর-যুবকরা অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার জন্য মৃত্যুর মুখে পা দিতেও পিছপা হচ্ছে না। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব ইত্যাদি কিশোরদের গ্যাং কালচারে প্রলুব্ধ করছে সঙ্গতকারণেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া আর যে কারণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাহলো, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষার শোচনীয় ঘাটতি। পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ পরিবার ও সমাজকে আগে যে সুরক্ষা দিতো, সেই সুরক্ষা এখন নেই। কারণ, ওই মূল্যবোধই নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাঠ্যবই থেকে চক্রান্তমূলকভাবে ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে শিশু বয়সে মক্তবে-মাদরাসায় পবিত্র কোরআন পাঠ, নামাজ-রোজা ও আদব কায়দা শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, এখন তা নেই। পরিবারে এসব শিক্ষার যে সুযোগ ছিল তাও নেই। ফলে ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ যে কোনো অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এ সাহায্য থেকে বঞ্চিত এখনকার কিশোররা। পরিবার হলো সব শিক্ষার ভিত্তিভূমি। শিশু-কিশোরের লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব পালন করে মাতা-পিতা বা অভিভাবক। আজকাল অধিকাংশ মাতা-পিতা ও অভিভাবক এ দায়িত্ব পালন করে না। সন্তান-সন্ততি কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, খেয়াল করে না।

বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে মাদকাসক্তি কিশোর-যুবকদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। জুয়াও তাদের গিলে খাচ্ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্তিও ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সামাজিক মাধ্যম তাদের এসব কাজে প্রভাবিত করছে, প্ররোচিত করছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এ দেশের হুন্ডুরাস, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশের মতো হতে খুব বেশি দিন লাগবে না। বলা বাহুল্য, এর চেয়ে গুরুতর অশনিসংকেত আর কী হতে পারে! শিশু-কিশোর-যুবকদের বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে, জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে এখনই সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিচিন্তকদের মতে, কিশোরঅপরাধ দমনে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক পোষকতা পরিহার করতে হবে, অর্থনীতিকে সব বিত্তের মানুষের কল্যাণদায়ী করে তুলতে হবে। বেকারত্ব দূর করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী পাঠ্য বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। পরিবার ও সমাজকে আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। শিশু-কিশোরদের লালন-পালন ও সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা নিতে হবে। এসব ব্যবস্থা নেয়া হলে আশা করা যায়, কিশোরঅপরাধসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। পরিবারে, সমাজে, দেশে শান্তি ও স্থিতি নিশ্চিত হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বসতে হবে। তাদের সুচিন্তিত অভিমত ও পরামর্শ অনুয়ায়ী একটি পথরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গ্রামে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

গ্রামে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

সিরিজ নিশ্চিতের অভিযানে শান্ত-হৃদয়রা

সিরিজ নিশ্চিতের অভিযানে শান্ত-হৃদয়রা

খুলনায় কাটলো তাপদাহ, নামলো বৃষ্টি

খুলনায় কাটলো তাপদাহ, নামলো বৃষ্টি

কুষ্টিয়ায় বিয়ের গাড়ি আটকে ভাঙচুর , আটক ৪

কুষ্টিয়ায় বিয়ের গাড়ি আটকে ভাঙচুর , আটক ৪

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মীরসরাই

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মীরসরাই

শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

নিজ কক্ষে মিললো আওয়ামী লীগ নেতার ঝুলন্ত লাশ

নিজ কক্ষে মিললো আওয়ামী লীগ নেতার ঝুলন্ত লাশ

বজ্রপাতে তিন জেলায় ৪ জনের মৃত্যু

বজ্রপাতে তিন জেলায় ৪ জনের মৃত্যু

মধুখালি ডুমাইনের পঞ্চপল্লীতে দুই সহোদর হাফেজ খুন,স্বজনরা উল্টো আতঙ্কে কেটে গেল ১৮ প্রহর

মধুখালি ডুমাইনের পঞ্চপল্লীতে দুই সহোদর হাফেজ খুন,স্বজনরা উল্টো আতঙ্কে কেটে গেল ১৮ প্রহর

প্রশ্ন : প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ঋণ নিয়ে হজ্জ করা প্রসঙ্গে।

প্রশ্ন : প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ঋণ নিয়ে হজ্জ করা প্রসঙ্গে।

আমেরিকা ও ইউরোপের বহিষ্কৃত ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেবে ইরান

আমেরিকা ও ইউরোপের বহিষ্কৃত ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেবে ইরান

একটানা ৩৭ দিন তাপপ্রবাহে অতিষ্ট চুয়াডাঙ্গাবাসীর ভাগ্যে অবশেষে মিললো স্বস্তির শিলা বৃষ্টি

একটানা ৩৭ দিন তাপপ্রবাহে অতিষ্ট চুয়াডাঙ্গাবাসীর ভাগ্যে অবশেষে মিললো স্বস্তির শিলা বৃষ্টি

বজ্রপাতে মাদারীপুরে পৃথক স্থানে দুই জন নিহত

বজ্রপাতে মাদারীপুরে পৃথক স্থানে দুই জন নিহত

শম্ভুগঞ্জ ইউসি উচ বিদ্যালয়র সভাপতি মোক্তার হোসেনর বিরুদ্ধ দূর্নীতির অভিযাগ: ছয় সদস্যের পদত্যাগ

শম্ভুগঞ্জ ইউসি উচ বিদ্যালয়র সভাপতি মোক্তার হোসেনর বিরুদ্ধ দূর্নীতির অভিযাগ: ছয় সদস্যের পদত্যাগ

সিলেটে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি : বাড়ছে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পরিমান

সিলেটে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি : বাড়ছে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পরিমান

অপহরণের ১৩ ঘণ্টা পর চুয়েট স্কুলছাত্র উদ্ধার

অপহরণের ১৩ ঘণ্টা পর চুয়েট স্কুলছাত্র উদ্ধার

বরগুনায় গণমাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধে কর্মশালা

বরগুনায় গণমাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধে কর্মশালা

গৌরনদীতে লোডশেডিং ও তীব্র গরমে কদর বেড়েছে হাতপাখার

গৌরনদীতে লোডশেডিং ও তীব্র গরমে কদর বেড়েছে হাতপাখার

নির্বাচনে প্রার্থীর পক্ষে টাকা বিতরণ করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

নির্বাচনে প্রার্থীর পক্ষে টাকা বিতরণ করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

ইসরাইলের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় পদযাত্রা

ইসরাইলের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় পদযাত্রা