অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে
০৭ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০৮ এএম
জাতীয় একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, পুরোনো ঢাকার পর রাজধানীর বনশ্রীতে আগুনের ঝুঁকি সবচাইতে বেশি। সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, বনশ্রী ডি ব্লকের ৮ নাম্বার রোডের রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচুড়া কন্ডেমিনিয়ামে রয়েছে তিনটি ১০তলা ভবন। এসব ভবনে ৯০টি পরিবারের প্রায় সাড়ে ৮শ মানুষ বসবাস করে। এই ভবনের মূল ফটকে বিশাল ক্যামিকেল গোডাউন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেও তারা কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি। বাসিন্দাদের আরো অভিযোগ, ভবনটি প্রতিষ্ঠার পর ফায়ার সার্ভিসের কোনো ব্যক্তি এখানে অসেনি। এই হচ্ছে আমাদের আবাসিক ভবনগুলোর অবস্থা। ন্যূনতম নিরাপত্তা নোই কোথাও। এমন ভবনগুলোতে আগুন লাগলে কী হবে? শতশত মানুষ লাশ হবে আর আমরা আহ্ উহ্ করবো। এতোটুকুই।
সরকার যদি রাজধানীবাসিকে নিরাপদ করতে চায় ফায়ারসার্ভিসকে গতিশীল করতে হবে। আগুন লাগলে ছুঁটে যাবে এমনটা যেন না হয়। প্রতিটি ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা আছে কিনা তার তল্লাশি যেন আগেই করা হয়। প্রতিটা ভবনে কিংবা কয়েকটা ভবন মিলে যেন বাসিন্দাদের আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক কি করতে হবে তাঁর ট্রেনিং দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাতীয় একটি দৈনিকে বলেছেন, ‘আমরা ভবনের মালিককে নোটিশ দিতে পারি। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই। আমাদের আইনের মধ্যে যা যা করা সম্ভব, তা-ই করছি।’ কথাটা পড়ে হতভম্ব হয়েছি। এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কী করে এমন বক্তব্য দিতে পারেন? কেউ আইন না মানলে তাকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন যে; নোটিশ দেওয়ার পরেও কাজ না হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এইসব ভবনের একটির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে বাকিগুলো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে এজন্য ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কথা বলছে, কিন্তু কীভাবে বছরের পর বছর ঝুঁকিপূর্ণ, নিয়মবহির্ভূত এসব ভবন টিকে আছে? রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিসের যেসব আইন রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলে এসব ভবন এখনও টিকে আছে। ফায়ার ব্রিগেডের যে আইন আছে সেখানে মামলা করার বিধান আছে এবং ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে তারা সেটাকে সিল করে দিতে পারে, যাতে কেউ ওই ভবন ব্যবহার করতে না পারে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দুর্ঘটনা ঘটলে তারা সেসব ভবন থেকে লোকজন উদ্ধার করে। সরকার থেকে রাজউককে এই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে, কেউ নিয়মের বাইরে কিছু করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। রাজউক সেই কাজটা করছে কি? প্রথমে নোটিশ দেয়া হয়, তারপর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা, তারপর উচ্ছেদের মাধ্যমেও তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা। তারা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করতো রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কমে যেত। ঢাকা শহরে ঝুঁকিপূর্ণ বা নিয়মবহির্ভূত কতগুলো ভবন রয়েছে তার হিসাব রাজউকের কাছে নেই। থাকলেও বিশেষ কারণে হয়তো চুপ থাকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আফসানা হকের পত্রিকায় দেওয়া একটি বক্তব্য বেশ ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণের প্রস্তুতিটা স্কুল পর্যায় থেকে চালু করতে হবে। আজকে যদি ফায়ার ড্রিলের কথা বলা হয়, ফায়ার সার্ভিস বা ডিফেন্স যদি সেই ব্যবস্থা নেয়, তাহলে ক’জন এর জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত? এই কাজটা করা আমাদের জন্য জরুরি। এই মানসিক প্রস্তুতিটাও আমাদের মধ্যে নেই। আমার মনে হয় একটা ছোট বাচ্চা যখন স্কুলে যায় তার লেখাপড়া বা দৈনন্দিন চর্চার মধ্যে এই বিষয়টাও নিয়ে আসা উচিত। স্কুল থেকে অগ্নিনির্বাপণের বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে আনা হলে অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে অভিভাবকরা সচেতন হবেন।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয় অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৫৪ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এটা ফায়ার সার্ভিসের তথ্য, তবে বেসরকারি তথ্য মতে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিমাণ হয়তো দ্বিগুণ হবে।
‘খরচ বাঁচাতে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম কিনতে অনীহা’র বিষয়টি খুব বেশি সামনে আসছে। এফবিসিসিআই এর চেয়ারম্যান মো. নিয়াজ আলী চিশতির দেওয়ার পত্রিকার বক্তব্যে জানা যায়, ‘প্রয়োজনীয় এসব সরঞ্জামের শতকরা ৯৫ ভাগ আমদানি করতে দিতে হয় উচ্চ কর। দাম বাড়ার কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অনেকেই এসব পণ্য নতুন করে কিনতে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। যার ফলে অগ্নিনির্বাপণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আবার, অনেকেই মনে করেন, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম লাগানো নেহাতই অপচয়। এর ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই বেইলি রোডের মতো ভয়াবহ আগুনের ঘটনা।’ তাঁর মতে, কার্বন ডাই অক্সাইড, ফোম, ড্রাই পাউডারসহ অন্যান্য আগুন প্রতিরোধী গ্যাস ও রাসায়নিক আমদানিতে আলাদা অনুমতির দরকার হয়। যে কারণে এসব পণ্য আমদানিকারকদের অযথা হয়রানির শিকার হতে হয়। এসকল ঝামেলা থেকে বাঁচতে তারা ভবনে অগ্নিনির্বাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ফলে দিনদিন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। এ বিষয়টি সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনো স্থাপনায় আগুন বড় আকারে জ্বলে উঠলে সর্বোচ্চ মানের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায়ও সেখানে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের মৃত্যু ও আহত হওয়া এড়ানো দুরূহ হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্থাপনার পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থার নকশা করা ও তা যথাযথ পরিপালন করা এবং সেটা নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সেই স্থাপনা ব্যবহারকারীদের জীবন ও সম্পদের অগ্নিনিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব। সবার এ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে পরিকল্পিত নগরায়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হোক।
গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্টসার্কিট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশে বা মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতনতা হলেই অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত বা ক্ষতির হার কমে যেত। অগ্নি প্রতিরোধ সামগ্রীর মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনো সামগ্রী বদলানো হয় না। আবার ভালো মানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করলেও দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। কিছু অর্থ খরচ কম করার জন্য আমরা অনেক সময় নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করি। কিন্তু একটু সচেতন হলেই দুর্ঘটনার হার বা ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো যেত।
লেখক: সাংবাদিক, কেবিনেট চেয়ারপার্সন (পরিবেশ), লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫/এ-১)
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ - সিলেটে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন
বার্সায় থাকার ব্যাপারে এখানো আত্মবিশ্বাসী শাভি
প্রতিকূলতার মুখে ফ্রান্স ছাড়ছেন মেধাবী মুসলিম পেশাজীবীরা
অসুস্থ সউদী বাদশাহ, নেয়া হয়েছে হাসপাতালে
জুজুৎসু সম্পাদক নিউটনসহ ২ জন রিমান্ডে
কিরগিজস্তানে কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর মেলেনি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ইশরাক হোসেনের জামিন আবেদন বাতিল, কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ
টেকনাফে র্যাবের অভিযানে কোটি টাকার আইসসহ আটক-১
অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে চালকরা
রামপালে ভুল চিকিৎসায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রসূতি
হামাসের হাতে বন্দিদের মুক্তির জন্য বিশেষ বৈঠকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ
নিজ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে ইউরোপ: রাশিয়া
ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে সশস্ত্র বিক্ষোভের আশঙ্কা
মাগুরার শ্রীপুরে নবী করিম সা. সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে জনগনের বিক্ষোভ অভিযোগকারী আটক
মেট্রোরেলে ভ্যাট এনবিআরের ভুল সিদ্ধান্ত: ওবায়দুল কাদের
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাচনে ৭৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ
আবারো পেছালো রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন
নেত্রকোণায় নো হেলমেট, নো ফুয়েল কার্যক্রম শুরু
সিঙ্গাপুরে মাথাচাড়া করোনার! আক্রান্ত প্রায় ২৬ হাজার
তিন জিম্মির পর গাজায় আরো এক জিম্মির লাশ উদ্ধার