ভেজাল রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

Daily Inqilab মীর আব্দুল আলীম

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ-ব্যাধি আমাদের পেয়ে বসেছে। হঠাৎ করে কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হার্ট বিকল হচ্ছে, ফুসফুস ঝাজরা হয়ে যাচ্ছে। ভেজাল আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে পঁচে যাচ্ছে আমাদের দেহ। রোগী বেড়েছে; রোগের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হাসপাতালও। প্রতিদিন মানুষ লাশ হচ্ছে।
প্রতিনিয়তই খাবারের সাথে বিষ আমাদের পেটে পড়ছে। আমরা খাবার খাব, আর সেই খাবার হবে বিশুদ্ধ; বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। এটাতো আমাদের অধিকার। আমরা কি বিশুদ্ধ খাবার পাচ্ছি? মাছে, ভাতে, আমে, জামে, কোথায় নেই বিষ? এক বিখ্যাত কলামিস্ট তার লেখায় লিখেছিলেন, ‘আমরা প্রতি জনে; প্রতি ক্ষণে; জেনে শুনে করছি বিষ পান।’ প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খাদ্যে ভেজালের শাস্তি ৭ থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড। ক’জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে? বোধকরি একজনকেও না। তাই ভেজালকারবারীরা ভেজাল মিশাতে সাহস পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যে ভেজাল নেই বললেই চলে। আমাদের পাশের দেশ ভারত, ভুটানেও ভোক্তা অধিকার আইন খুবই কার্যকর। সেসব দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি হয়। আর ভেজাল পণ্য বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্যের কঠোর আইন আছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ঠিকভাবে ফলোআপ করে না। শুধু লোক দেখানো অভিযান চলে মাঝেমাঝে। কেউ ধরা পড়লে আইনের ফাঁকফোঁকড়ে আবার বেরিয়ে যায়। শাস্তি হয় না। তাই তারা ভেজাল মেশাতে সাহস পায়। 
ভেজাল খাদ্যের বিষই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিচ্ছে। কেবল হাসপাতালগুলোতে গেলেই বুঝা যায়, কত প্রকার রোগই না এখন মানবদেহে ভর করে আছে। আসলে আমরা জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি। না খেয়ে উপায়ইবা কী? অবশ্য উপায় একটা আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে হয়তো নিস্তার মিলবে। কিন্তু তাতো হবার নয়। তাই আমে, জামে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ মেশানো খাবারই স্বপরিবারে গিলে চলেছি দিনরাত। আমরা যা খাচ্ছি তার অধিকাংশেই কোননা কোনো বিষ মিশানো। তরতাজা মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছি বাসায়, সে মাছে হরমোন, অ্যান্টিবায়টিকসহ নানা ক্ষতিকারক উপাদান  রয়েছে। মাংস কিনছি সেটা গরু, ছাগল কিংবা মুরগিÑ সব কিছুই এখন মোটাতাজা করতে গিয়ে নানা ক্ষতিকর উপাদান তাতে যুক্ত হচ্ছে। দেশি মোরগ-মুরগির নামে বাজার থেকে যা কিনছি, তাও দ্রুত বড় করতে ওজন বাড়াতে অ্যান্টিবায়টিকসহ ক্ষতিকর খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। চাল কিনছি তা নাকি বিষাক্ত ক্রোমিয়াম যুক্ত। সাধের জন্য চিকন চাল খাব, তাও মোটা চাল কেটে নাকি চিকন করে আমাদের খাওয়ানো হচ্ছে। শরীর তাজা করতে ফল খাব সেখানেও কোনো না কোনো বিষ মিশানো। 
ভেজাল আমাদের জীবনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। তেল, মসলা, লবণ, মুড়ি, চিনি, মাছ, দুধ, ফলমূল, সবজি, গুঁড়াদুধ, কেশতেল, কসমেটিকস সর্বত্রই ভেজাল। ফলের জুস, কোমল পানীয়Ñ এসবের বেশির ভাগই কৃত্রিম কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফল প্রথমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়, পরে ফরমালিন দিয়ে প্রিজারভ করা হয়। দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবারের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বিরিয়ানি, জিলাপি, জুস, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে সস্তা দামের টেক্সটাইলের রং ব্যবহার করে থাকে, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। খাবারে কৃত্রিম রং এবং জুসে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং ইথোফেন ব্যবহার করে আম, কলা, পেঁপে, আনারস, বেদানা, ডালিম, আপেলসহ এমন কোনো ফল নেই যা পাকানো না হয়। 
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। এদেশের মানুষরূপী কিছু মানব বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলছে। দেশে ভেজালদাতার জন্য আইন প্রণয়ন হয়েছে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড? তবে এ আইনের প্রয়োগ নেই। ভয়ংকর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা না গেলে দেশে ভেজালসন্ত্রাস কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না। মানবঘাতক তথা খুনীদের জন্য দ্রুত বিচারের ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকে ভেজাল খাদ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অবিলম্বে। এত মানুষ ভেজাল খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে; আর মারা যাচ্ছে যার দায় সরকারকেই নিতে হবে। 
ভেজালকারবারীরা ইতোমধ্যে ২ কোটি মানুষকে কেবল কিডনি রোগে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ হাজার লোক ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে জীবন ধারণ করছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৫০ হাজার। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ক্যান্সারসহ কোননা কোনো রোগে আক্রান্ত আর আরও ২ কোটি মানুষ। প্রতিনিয়ত ভেজাল দ্রব্য খেয়ে কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে বাকি ১৪ কোটি মানুষ। এসব তথ্য জনমনে আতংক তৈরি করে বৈকি! কেবল ক্যান্সারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ২৭৩ জনের মৃত্যু হয় বলে খোদ তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ক্যান্সার সম্পর্কিত গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৯১ হাজারের অধিক মানুষই মৃত্যুবরণ করে। এদিকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৬০ ভাগ ক্যান্সার রোগী প্রায় ৫ বছরের মধ্যে মারা যায়। দেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার বর্তমানে প্রায় ৮ ভাগ এবং এই সংখ্যা ২০৩০ সালে ১৩ ভাগে উন্নীত হবে। দেশের উন্নয়নের কথা শুনছি, হচ্ছেও। জঙ্গি দমন করেছে সরকার, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে, স্বপ্নের পদ্মাসেতু হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা, বিভাগীয় শহর এমনকি উপজেলা পর্যায়েও ফ্লাইওভার হয়েছে, দেশের বিভিন্ন নদী পথের ফেরি বদলে সেতু হয়েছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে মানব উন্নয়নও। বলতেই হয় বহির্বিশ্বেও দেশের মর্যাদা বেড়েছে। এতসব কাদের জন্য? এদেশের মানুষের জন্যইতো? দেশের মানুষ সুস্থ না থাকলে, বেঁচে না থাকলে এসবে ফায়দা কী? মানুষকে সুস্থ রাখতে সরকার কঠোর হচ্ছে না কেন? এ ব্যাপারেতো রাষ্ট্রের কোনো দুর্বলতা থাকার কথা নয়। তাহলে এ জায়গাটাতে সরকারের এতো কৃপণতা কেন?
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মীরসরাই

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মীরসরাই

কুষ্টিয়ায় বিয়ের গাড়ি আটকে ভাঙচুর , আটক ৪

কুষ্টিয়ায় বিয়ের গাড়ি আটকে ভাঙচুর , আটক ৪

খুলনায় কাটলো তাপদাহ, নামলো বৃষ্টি

খুলনায় কাটলো তাপদাহ, নামলো বৃষ্টি

সিরিজ নিশ্চিতের অভিযানে শান্ত-হৃদয়রা

সিরিজ নিশ্চিতের অভিযানে শান্ত-হৃদয়রা

গ্রামে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

গ্রামে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

দেশে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার

দেশে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার

১ আগস্ট থেকে সরাসরি জেদ্দায় ফ্লাইট শুরু ইউএস-বাংলা’র

১ আগস্ট থেকে সরাসরি জেদ্দায় ফ্লাইট শুরু ইউএস-বাংলা’র

বিজয়ের সেঞ্চুরিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আবাহনী

বিজয়ের সেঞ্চুরিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আবাহনী

পিকে হালদারসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

পিকে হালদারসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

বড় জয়ে ডিপিএল অভিযান শেষ মোহামেডানের

বড় জয়ে ডিপিএল অভিযান শেষ মোহামেডানের

গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ

গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ

ঝড়ে ১০ তলা থেকে দেয়াল ভেঙে পড়লো টিনশেড ঘরে, নারীর মৃত্যু আহত ৮

ঝড়ে ১০ তলা থেকে দেয়াল ভেঙে পড়লো টিনশেড ঘরে, নারীর মৃত্যু আহত ৮

টাঙ্গাইলে ধানক্ষেত থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার

টাঙ্গাইলে ধানক্ষেত থেকে মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার

গণতন্ত্রকে ম্যাচুরিটি দেওয়ার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে: ওবায়দুল কাদের

গণতন্ত্রকে ম্যাচুরিটি দেওয়ার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে: ওবায়দুল কাদের

মির্জাপুরে সন্ত্রাসী হামলায় আ.লীগ নেতাসহ আহত ৩

মির্জাপুরে সন্ত্রাসী হামলায় আ.লীগ নেতাসহ আহত ৩

সাকিবের মাইলফলকের দিনে রাজার রেকর্ড বোলিং

সাকিবের মাইলফলকের দিনে রাজার রেকর্ড বোলিং

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সন্ত্রাসী হামলার হুমকি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সন্ত্রাসী হামলার হুমকি

সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে: ফায়ার সার্ভিস

সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে: ফায়ার সার্ভিস

মির্জাগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি মনিরুল, সম্পাদক প্রিন্স

মির্জাগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি মনিরুল, সম্পাদক প্রিন্স