ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

জো বাইডেনের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ট্রাম্পের আত্মঘাতী রাজনীতি প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারনার অন্যতম শ্লোগান ছিল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। ট্রাম্পের নির্বাচনী অ্যাডভাইজাররা এই শ্লোগানটি বেছে নিয়ে মার্কিন জনগনকে প্রলুব্ধ করে সফল হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে লিবারেল মার্কিন জনগণের মধ্যে যত সংক্ষোভই থাকুক না কেন, এতসব বিতর্কিত অবস্থানের পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার চমক সম্পর্কে বিশ্ববাসির জন্য ভাববার বিষয়। নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে বিদায় হওয়ার পর ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাঠে আবারো বিজয়ের ডঙ্কা বাজানোর হিম্মত অর্জন মার্কিন গণতন্ত্র ও সা¤্রাজ্যের দৈন্যদশাকেই তুলে ধরছে। হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে আসীন হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনিক সিদ্ধান্তটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রত্যাশিত, অনেক সময় ও কাঠখড় পুড়িয়ে অর্জন করা টিপিপি (ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ) বহুপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর ফাইলে সই করা। এটি তার নির্বাচনী অঙ্গিকার ছিল। ঠিক একইভাবে ট্রাম্প তার নির্বাচনের আগে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করে প্রথাবিরোধী বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বিশ্বকে হতবাক করেছিলেন। ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্তে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাভক্ষতির হিসেবে উল্টে গেলেও এবং তাৎক্ষণিক বলে দেয়া সম্ভব না হলেও, এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায় যে, ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নেতৃত্বের স্থানটিকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে দেয়া নেতৃত্বের স্থানটি কিন্তু শূন্য থাকেনি। টিপিপি এবং প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর ফলে এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্বের স্থানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক বৈরি প্রতিপক্ষ চীনের জন্য নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরী করেছে। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চীনা নেতারা কোন সময়ক্ষেপন করেননি। প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার সাথে সাথে এই ইস্যুতে প্রথমবারের মতো চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি অভূতপূর্ব বোঝাপড়ার সূত্রপাত হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন নতুন প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উভয়পক্ষ নিবিড়ভাবে কাজ করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে, যা; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে অভিন্ন স্বার্থে সম্মিলিত প্রয়াসে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি নব্য প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিল।

প্যারিস এগ্রিমেন্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হঠতে ট্রাম্পের হঠকারি সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনবিসি টিভিতে আন্দ্রে মিশেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জন কেরি বলেছিলেন, ট্রাম্প আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগান দিয়ে আমেরিকাকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে শুরু করেছেন। তার ভাষায় ‘পুট আমেরিকা লাস্ট’। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা ১৯৬ জাতির ক্লাইমেট এগ্রিমেন্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘটনাকে ‘অ্যাবডিকেশন অফ আমেরিকান লিডারশিপ’ এবং ‘শেইমফুল মোমেন্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ২০১৫ সালের প্যারিস অ্যাকর্ড থেকে সরে যাওয়া নয়, এর মানে হচ্ছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে কিউটো প্রটোকল থেকে শুরু হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি ও অঙ্গিকার থেকে সরে দাঁড়ানো। সাবেক সেক্রেটারি অফ স্টেট জন কেরির ভাষায়, হি হ্যাজ মেইড আজ অ্যান এনভায়রনমেন্টাল পেরিয়াহ ইন দি ওয়ার্ল্ড’ অ্যান্ড আই থিঙ্ক ইট ইজ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ মুভস আই হ্যাভ এভার সিন বাই অ্যানি প্রেসিডেন্ট ইন মাই লাইফটাইম। তবে দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনে যে এগ্রিমেন্ট চূড়ান্ত হয়েছিল তা কার্যকর হয়েছিল ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে। চুক্তির শর্ত অনুসারে, এটি কার্যকর হওয়ার তিন বছরের মধ্যে তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের আগে এ চুক্তির বাইরে যেতে পারবে না। ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুন:নির্বাচিত হতে না পারার নেপথ্য কারণও মূলত এসব হঠকারিতা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। ২০২০ সালে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর জো বাইডেন যেসব সিদ্ধান্ত কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার গ্যাঁড়াকল সৃষ্টি করেছেন, তার অন্যতম হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি এবং কৌশলগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া। তার চেয়ে বড় বিপর্যয় হচ্ছে, গাজায় গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিখ-ী ভূমিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপসহ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে যে বিতর্ক ও অভিযোগ শোনা গিয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচারিক ও প্রশাসনিক মাত্রায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ইমপিচ্ড হওয়ার পর হয়তো এ ধরনের অভিযোগে ট্রাম্পকে ইমপিচ বা বরখাস্ত হওয়ার কাছাকাছি অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। রাশিয়ার সাথে গোপণ সম্পর্ক ইস্যুতে সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার মাইকেল ফ্লিন বরখাস্ত হওয়ার পর তার এবং ট্রাম্পের কথিত রাশিয়ান কানেকশান এবং নির্বাচনে তার প্রভাব সম্পর্কে এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কোমির তদন্ত কাজ বন্ধের নির্দেশ এবং শেষ পর্যন্ত কোমিকে বরখাস্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এবং বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার অভিযোগে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেসম্যানরাই প্রথম তার অপসারনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জাস্টিন আমাশ মন্তব্য করেছিলেন, তদন্ত কাজ বিরত রাখতে বা ব্যাহত করতে কোমিকে বাধ্য করার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে তা ট্রাম্পের জন্য অভিসংশনের যোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে, সিএনএন কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আরেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান কার্লোস কারবেলো বলেছিলেন, কোমিকে তদন্তকাজে বাধা দিয়ে বিচার বাধাগ্রস্ত বা প্রভাবিত করার অভিযোগ যদি সত্য হয়, তা নিক্সন এবং বিল ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে যে রকম অভিসংশন প্রক্রিয়া গৃহিত হয়েছিল একই প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের অভিসংশন হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল।

ট্রাম্পের রিপাবলিকান পূর্বসুরী জর্জ বুশ ‘ওয়ার অন টেরর’ শুরু করার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এবং ইউনিপোলার শক্তি হিসেবে তার পতন ত্বরান্বিত হতে থাকে। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসনে শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যয় ও সীমাহীন রক্তপাতের মধ্য দিয়ে একদিকে পুরো বিশ্বকে আরো সন্ত্রস্ত, রক্তাক্ত ও অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে, অন্যদিকে এসব যুদ্ধায়োজনে কোথাও মার্কিনীদের সামরিক বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত না হওয়ায় বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিনীদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, অনাস্থা ও ঘৃণা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিরসনে মার্কিনীদের সামরিক, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ধারনা তৈরী হয়েছে। জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের মত বিশ্ব ফোরামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য বজায় রাখলেও প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে ভুল নীতির কারণে তা এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে সাত দশক ধরে শর্তহীনভাবে সমর্থন ও সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা এবং ফিলিস্তিনী ও আরবদের উপর ইসরাইলের ধারাবাহিক আগ্রাসন, বর্বর হামলা ও অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখার পরও মার্কিন প্রভাবিত বিশ্বসম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততার মধ্যে হেজবুল্লাহ ও হামাসের হাতে বিশ্বের অজেয় সামরিক শক্তির দাবিদার ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)’র বারবার মার খাওয়ার বাস্তবতা থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের আগ্রাসি মানোভাবে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বিশ্ব সংস্থাগুলোকে শান্তি, শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ও সার্বজনীন নিরাপত্তার বিষয়ে পক্ষপাতহীন কাজে লাগানোর উদ্যোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো নেয়নি। এগুলো সবসময়ই জায়নবাদি ইসরাইল, কর্পোরেট মুনাফাবাজ ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের (এমআইসি) স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। যে ওয়ার ইকোনমিকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থার নীলনকশা গ্রহণ করেছিল আজকের দুনিয়া তারই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। এখানে তাদের সেই নীলনকশা বিশ্বকে যেমন চরমভাবে অনিরাপদ, অস্থিতিশীল ও রক্তাক্ত করে তুলেছে, এই নীতি তাদের জন্যও বুমেরাং হয়েছে। জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নিজেদের বশংবদ লোকদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে সামরিক আগ্রাসন, গৃহযুদ্ধ, গোয়েন্দা তৎপরতায় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ছড়িয়ে তারা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে চাইলেও তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকা ফার্স্ট শ্লোগান তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জনগনের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বসম্প্রদায়ের সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগগুলো থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। সাংহাই কো-অপারেশন, ব্রিকস’র মতো নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফোরামের মধ্য দিয়ে চীন, রাশিয়া, ইরান, মধ্যএশিয়াসহ বিশ্বের সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো যখন নতুন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্ভাবনাময় উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন একদিকে আগ্রাসী অন্যদিকে আত্মকেন্দ্রিক, রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। টিপিপি ও ক্লাইমেট এগ্রিমেন্ট থেকে পিছিয়ে যাওয়া, মুসলমান দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা জারির মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

একটি ভ্রান্তিকে আরেকটি ভ্রান্তি দিয়ে অপসারণের চেষ্টা কখনো সুফল বয়ে আনেনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠকারিতা এবং জায়নবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর, ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের কমিটমেনট থেকে পিছু হটা কিংবা ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পরিনতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেও ভাল হয়নি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ’র ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বসম্প্রদায় যখন নতুন করে এসডিজি বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল নির্ধারনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন পথরেখায় মিলিত হতে সচেষ্ট, ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন তার সব দরোজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওয়ার ইকোনমির উপর জোর দিতে গিয়ে মার্কিনীরা তাদের ট্রাডিশনাল বাণিজ্যিক সক্ষমতা হারিছে। চীন-মার্কিন সম্পর্কের পারস্পরিক নির্ভরতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুঁজিবাদি বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের হিসাব নিকাশকে একটি সরল ভারসাম্যে প্রতিস্থাপিত করেছে। একদিকে চীনের কাছে আমেরিকার ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং আমেরিকার বিনিয়োগ এবং কনজিউমার সার্ভিস চীনের উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে চীনের বিনিয়োগ ও বিশাল জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের স্বার্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গতিশীলতা চীনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়। অর্থনীতির এই সরল ভারসাম্যের ভেতর থেকেও চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদি দুনিয়ার দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত ভুল নেতৃত্বের কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভার, বিশালত্ব ও ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র বৃটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তিগুলোকে সাথে নিয়ে এতদিন পুঁজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে সক্ষম হলেও এখন চীন-রাশিয়ার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কাছে মার্কিন নেতৃত্ব অনেকটা খেলো হয়ে পড়ছে। রাশিয়া ও ইরানের সমর প্রযুক্তির ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা, দক্ষিন চীন সাগরে আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অথবা পরমানবিক শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলা কোন ক্ষেত্রেই কৌশলগত সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন উত্তর কোরিয়াকে ভয় দেখাতে প্রথমবারের মত এন্টি আইসিবিএম বা আন্ত:মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে, তখন উত্তর কোরিয়ার নেতারা দাবী করছে, তাদের পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র হামলা ঠেকানোর সক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। মার্কিন ভূখ-ে বৃষ্টির মত পরমাণু বোমা হামলার হুমকি দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। এখন লোহিত সাগরে হুথির হামলা মোকাবেলায়ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা ধরা পড়ছে। সেখানে উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়া ও ইরানের কৌশলগত ঐক্য মোকাবেলা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব বলেই প্রতিয়মান হচ্ছে।

মার্কিনীদের অব্যাহত হুমকির মুখে গত কয়েক বছরে অর্ধশত ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপন করেছে উত্তর কোরিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখ-ে উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক বোমা হামলা চালানোর মত সক্ষমতা আছে কিনা, তা নিয়ে যে সংশয় এতদিন ছিল, তা এখন আশঙ্কায় পরিনত হয়েছে। ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অন্তত এক দশক এগিয়ে আছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কুপোকাত করেছে। ২০২০ সালে রাশিয়া সাড়ে ৪ হাজার মাইলের বেশি গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক জিরকন মিসাইল টেস্টের মধ্য দিয়ে মিসাইল প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহুদূর এগিয়ে থাকার প্রমান পাওয়া যায়। এ ধরনের প্রযুক্তি সক্ষমতা অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কমপক্ষে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন। এখন ইরানের হাতে তারচেয়েও শক্তিশালী হাইপারসনিক মিসাইল থাকার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল পুরো মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারে, তাহলে রাশিয়া বা চীনের প্রযুক্তি নিয়ে উত্তর কোরিয়া, ইরানের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে হিজবুল্লাহ, হামাস আমেরিকা বা ইসরাইলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। গত ৫ মাসের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে তা প্রমাণিত হয়েছে। কারণ দেশ-কাল পাত্র ভেদে শক্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ভারসাম্য ভেঙ্গে দেয়ার ন্যাক্কারজনক উদাহরণগুলো আমেরিকাই প্রথম সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে গণহত্যার পক্ষে জো বাইডেনের বিতর্কিত ভূমিকা তার জনসমর্থনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জো বাইডেন সম্ভবত ২০২০ সালের ট্রাম্পের পরিনতি ভোগ করতে যাচ্ছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিন জনগণের হাতে ভাল কোনো বিকল্প নেই। একটি ভাল বিকল্প থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা সম্ভবত ট্রাম্প-বাইডেন উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করত। রিপাবলিকান প্রাইমারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিস্ময়করভাবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিকি হেলির চেয়ে ২ শতাধিক ডেলিগেট ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। আমেরিকা আবারো ট্রাম্পের যুগে ফিরে গেলে তা মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ