ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

বিএনপিকে বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার হয় না

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ এএম

একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রুর দরকার হয় না।’ বন্ধুকে ছারখার করে ছাড়ে। সেটা ধনী কিংবা দরিদ্র যে দেশ হোক। ধনী দেশের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজের নীতি বাস্তবায়ন করলেও দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশের সাথে তার বন্ধুত্ব হয় ওই অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য। দেশটিকে সে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে যেসব পরাশক্তি তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে বা উঠেছে, সেসব দেশের প্রভাব ঠেকিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা সে অঞ্চলের এক বা একাধিক দেশকে বেছে নেয়। আফ্রিকা, এশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশে তার এমন ঘাঁটি রয়েছে। সেসব দেশ ‘আমেরিকা বলে কথা’ এমন গদগদ হয়ে তাকে স্বাগত জানায়। এর বিনিময়ে আমেরিকা যতটুকু না সাহায্য-সহযোগিতা করে, তার চেয়ে বেশি যে সে স্বার্থ হাসিল করে নেয়, এ বিষয়টি বুঝতে পারে না। তার মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে গিয়ে সেই প্রতিপক্ষের সাথে যে সুসম্পর্ক থাকে, তা যে যুক্তরাষ্ট্র নষ্ট করে দেয় বা দিচ্ছে, সেটা বেমালুম হয়ে যায়। আমেরিকা তার শত্রুকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ওই শত্রুর বন্ধু দেশের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি করে দেয়। ফলে দেশটি ‘কূল রাখি, না শ্যাম রাখি’ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক সম্পর্ক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আমেরিকা কোনো দেশকে কত সময় তার স্বার্থে ব্যবহার করবে এবং ব্যবহার করে ছেড়ে যাবে, তা একান্ত তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বন্ধু সেজে সে যত সময় দেশটিতে থাকে, তার যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তার বহু উদাহরণ বিশ্বে রয়েছে। আমেরিকা যেখানে হাত দিয়েছে, সেখানে ধ্বংস ছাড়া কিছু হয়নি। বন্ধু হয়ে কোনো দেশকে নিজের স্বার্থ হাসিল ছাড়া উন্নতি করতে সহায়তা করেছে, এমন নজিরও খুব একটা নেই। ‘যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রুর দরকার হয় না’, কথাটি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উপমহাদেশে ভারত যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন নেই। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, হয় তার করতলে থাকতে হবে, না হয় তাকে ছাড়তে হবে, যার সাম্প্রতিক নজির মালদ্বীপ। মালদ্বীপ বুঝতে পেরে ভারত থেকে দূরে সরে গেছে কিংবা ইন্ডিয়াকে আউট করে দিয়েছে। তদ্রুপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান তার প্রভাববলয় থেকে দূরে সরে গেছে। চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারত কুলিয়ে উঠতে পারে না। ভারত থেকে দেশগুলোর সরে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা ভারতকে বন্ধুরূপী শত্রু মনে করে, যে নিজ স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে আমরা শুধু দেখি বন্ধুত্বের নামে সে কেবল নিয়েই গেছে। বিনিময়ে কিছু দেয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে, আমাদের সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে। এতে যে দেশের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে বা যাচ্ছে, সরকার তা বুঝেও না বোঝার নীতি অবলম্বন করে চলেছে।

দুই.
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই মুসলমানদের শত্রু মনে করে। ইসলামের প্রসার ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রাকে দেশটি খ্রিস্টান ও শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির জন্য হুমকি মনে করে। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসবাদ কিংবা অন্যকোনো ছুঁতোয় সবার আগে মুসলমানদের দায়ী করে। ইসলামের বিরুদ্ধে তার এই ‘প্রপাগান্ডা’ বেগবান করে নাইন-ইলেভেনে তার নিজে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে। সে ঘটনায় আল কায়দাকে দায়ী করে সারাবিশ্বে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ রফতানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ওয়েন স্ট্যাট স্কুল অফ ল’র আইনের অধ্যাপক খালেদ আলি বেদুন একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, আমেরিকানদের কল্পনায় ‘ইসলামোফোবিয়া’ ঢুকিয়ে দেয়া। কারণ, মুসলমানদের সহজে স্কেপ গোট বা ‘বলির পাঠা’ বানানো যায়। যখনই তারা কোনো সন্ত্রাসবাদের চিন্তা করে, তখন তাদের মনে প্রথমেই আসে মুসলমানদের কথা। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইসলামোফোবিয়া’ বিশ্বব্যাপী রফতানি করে। যেমনটি ঘটছে চীন, মিয়ানমার ও ভারতে। এসব দেশে মুসলমানদের ওপর ‘ক্র্যাকডাইন’ চালানো হয় এবং হচ্ছে। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যুক্তরাষ্ট্র মুসলমানদের কি চোখে দেখে। আমরা যদি বিগত কয়েক দশকের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, যুক্তরাষ্ট্র ইসলামোফোবিয়ার নামে মুসলমানদের দমানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলমান দেশকে কিভাবে ধ্বংস ও অশান্ত করেছে। মানব বিধ্বংসী ভা-ার রয়েছে বলে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত ও হত্যা করে পুরো দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফীকে হত্যা করে দেশটিকে ধ্বংস করেছে। ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে সিরিয়া ও আফগানিস্তানকে তছনছ করে দিয়েছে। লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা ও উদ্বাস্তু করেছে। ২০১০ সালে আরব বসন্তের ধোঁয়া তুলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে তুলেছিল। আর এখন গাজায় ইসরাইলি বাহিনীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে বর্বর গণহত্যা চালাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে তার যে কর্মকা- চালাচ্ছে, তার প্রায় শতভাগই মুসলমান বিদ্বেষপ্রসূত। অন্যদিকে, নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সামরিক ও আধিপত্যবাদী জোট গঠন করেছে। যেমন, ন্যাটো, কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক কিংবা ফাইভ আইজ ইত্যাদি। এসব জোটে মুসলমান দেশ নেই বললেই চলে। এসব জোটের মাধ্যমে সে বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তার আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলমানদের অন্যতম বাধা মনে করে। ফলে কিভাবে মুসলমানদের দমিয়ে রাখা যায় বা তার বশংবদে পরিণত করা যায়, এ নীতি বাস্তবায়ন করছে। কখনো নিজে সরাসরি যুক্ত না থেকে মুসলমানদের মধ্যকার বিভিন্ন মতবালম্বীদের উসকে দিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখে। অর্থাৎ মুসলমান দিয়ে মুসলমান হত্যার কূটচালের নীতি অবলম্বন করে থাকে। যেমনটি ঘটিয়েছে ইরাকে শিয়া-সুন্নীর মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে। আবার কখনো সে নিজেই বিপথগামী একশ্রেণীর মুসলমান দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে। আইএস তার অন্যতম নজির। বলা হয়ে থাকে, আইএস যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলমানদের বিশ্বে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সে নিজে যেমন টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে নাইন-ইলেভেন সৃষ্টি করেছে, তেমনি আইএস সৃষ্টি করে দমানোর নামে হামলা চালিয়ে মুসলমান দেশকে ধ্বংস করেছে। এখন ইসরাইলকে মুসলমান হত্যায় সরাসরি সহযোগিতা করছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সুদীর্ঘ কর্মকা- থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, সে তার আধিপত্য ও খবরদারি করার জন্য নানা উসিলায় নিজেই শত্রু সৃষ্টি করে। কারণ, তার শত্রু না থাকলে তার আধিপত্যও থাকে না। এজন্য, পারমানবিক অস্ত্রের কথা বলে ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশে সে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সন্ত্রাসের কথা বলে মুসলমান ও ইসলামকে শত্রু বানিয়েছে।

তিন.
নানা কারণে বাংলাদেশের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নজর রয়েছে। সংকুচিত গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যর্থতা, কর্তৃত্ববাদ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যা, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চলমান রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধীদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। দেশের সিংহভাগ মানুষও তাদের পক্ষে। মানুষের এই মনোভাবের সাথে তাল মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর তাকিদ এবং চাপ দিতে থাকে। এ নিয়ে দেশটি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের ওপর ভিসানীতি আরোপ করার নীতি নিয়েছে। এসব কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই নিজেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিকদলসহ বিপুল জনসংখ্যার কাছে নিজেকে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। সরকারের চেয়ে বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপির সাথে বেশি যোগাযোগ রাখে। বিএনপিও তার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। , যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ কঠিন পদক্ষেপ নেবে এবং এতে সরকার বেকায়দায় পড়ে পদত্যাগে বাধ্য হবে, এমন প্রত্যাশা জাগে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের তরফে ঘন ঘন প্রেস ব্রিফিংয়েও এমন বক্তব্য দেয়া হয়, যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক সরকারের বিরুদ্ধে সে কিছু একটা করতে যাচ্ছে। এসব ব্রিফিং সরকারিদলের নেতাকর্মীদের উপরও প্রভাব ফেলে। তাদের অনেকটা ব্যাকফুটে বা দাপট কমিয়ে চলতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে, বিএনপির অনেক নেতাকমীর্কে যুক্তরাষ্ট্র ‘এবার ধরেছে, সরকারের আর রক্ষা নেই’ এমন মনোভাব নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে থাকতে দেখা যায়। দলটি গত বছরের ২৮ অক্টোবর এমনভাবে মহাসমাবেশের ডাক দেয়, যেন ঐদিনই সরকারের পতন হয়ে যাবে। দেখা গেল, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সেই মহাসমাবেশ শেষই করতে দেয়নি। শুরুতেই প- করে দেয়। এরপর দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা একে একে গ্রেফতার হতে থাকে। মহাসমাবেশ প- হওয়ার মধ্য দিয়েই যেন বিএনপির আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। যদিও দলটি দাবি করেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাক্সিক্ষত হারে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ৫ শতাংশ ভোটারও ভোট দেয়নি। তবে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিরোধীদলের সরকার পতনের আন্দোলন দৃশ্যত কার্যকর হয়নি। সরকারের যে পতন হলো না, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আন্দোলনের চেয়ে বিএনপির অতিমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা। শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র কেন সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদলের প্রত্যাশা অনুযায়ী পদক্ষেপ না নিয়ে পিছিয়ে গেল, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির চেয়ে তার স্বার্থ বেশি দেখেছে। সরকারের বিরুদ্ধে তার অবস্থান দেখে মনে হতে পারে, তা ছিল বিরোধীদলের পক্ষে। বাস্তবতা হচ্ছে, সেটা ছিল তার স্বার্থের পক্ষে। কারণ, সরকার তখন একা ছিল না। তার পক্ষে চীন, রাশিয়া ও ভারত প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। এই তিন পরাশক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে উপমহাদেশে বা ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে সে মুখে মুখে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বললেও সরকারের বিরুদ্ধে তার সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘অপেক্ষা ও দেখা’র নীতি অবলম্বন করে। নির্বাচনের পর সরকারের সাথে কাজ করার কথাও বলে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সরকারকে অভিনন্দন জানায়। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যুক্তরাষ্ট্র যার মিত্র হয় কিংবা সমর্থন যোগায়, তার ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলী কথাবার্তাকে সমর্থন মনে হলেও এবং ধারণাপ্রসূত তার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা-পদক্ষেপের কারণে সরকারের পতন হবে, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং নিজের আন্দোলন পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা দলটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমাদের দেশে অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো দেশের সহযোগিতার আশায় আন্দোলন করা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ঐতিহ্য অনুযায়ী, নিজের সক্ষমতা এবং দেশের মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। সেসব আন্দোলন সফলও হয়েছে। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সবদল আন্দোলন করেছে। পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ অন্যান্য দল আন্দোলন করেছে। সেসব আন্দোলন সফলও হয়েছে। বিদেশিদের সমর্থনের প্রয়োজন পড়েনি। তাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, যেদিকে বৃষ্টি, সেদিকে ছাতা ধরা। অর্থাৎ বিজয়ীদেরই পক্ষে থাকে। আর এ আশা করাও উচিৎ নয়, বিদেশিরা এসে আন্দোলন কিংবা সরকার গঠন করে দেবে। যদিও বর্তমান ক্ষমতাসীনদল ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতায় টিকে আছে, যা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটির সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভারতের সাথে সরকারের এত মাখামাখি সম্পর্ক দেশের ক্ষতি ছাড়া ভাল কিছু হয়নি এবং হবেও না। তদ্রুপ, বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপর বেশি নির্ভর করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চার.
অতীতে যেসব সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এবং তা দমাতে ক্ষমতাসীনদলকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। গুম, খুন, অপহরণ, হেলমেট বাহিনী ব্যবহার কিংবা মিছিল-মিটিংয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি গুলি করার ভূমিকায় ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় বাহিনী কিংবা হন্তারকের মতো ব্যবহার করা হয়নি। তখন পারস্পরিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। বিরোধীদলের আন্দোলনের প্রতি ক্ষমতাসীনদলের বিদ্বেষ থাকলেও দমিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার মতো মনোভাব পোষণ করত না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তার নিজস্ব দায়িত্ব ও এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কাজ করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করেছে। ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে আওয়ামী লীগ ও অন্য বিরোধীদলগুলো বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করেছে, বিএনপি যদি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করত, তাহলে কি বিরোধীদলের আন্দোলন সফল হতো? কিংবা ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করার পর যদি বিএনপি সংবিধানের কথা বলে ক্ষমতায় থেকে যেত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিরোধীদলকে দমিয়ে দিত, তাহলে কি কিছু করার ছিল? আওয়ামী লীগ এখন যে সংবিধানের দোহাই দেয়, সেই দোহাই বিএনপিও তখন দিতে পারত। তাতে বিদেশিদেরও কিছু বলার থাকত না। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতি করতে হয়, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুযায়ী। বিদেশিরা করে দেবে, এ আশা নিয়ে নয়। বিদেশিরা বরাবরই সরকারের সঙ্গে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করে, সরকার টু সরকার সম্পর্ক রাখে। বিরোধীদলের সঙ্গে নয়। বিএনপিকে এ বিষয়টি বুঝে তার আগামীর রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ