কর্তাদের বয়ান ও মানুষের অসহায়ত্ব

Daily Inqilab রিন্টু আনোয়ার

১১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ মানতে নারাজ সরকার। অর্থমন্ত্রীর দাবি, উন্নয়নের ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির সব সূচক কেবল বাড়ছে। অনিশ্চয়তা ও হতাশার কিছু নেই। এর প্রমাণ হচ্ছে, মেট্রোরেলে আরামে ঘোরা যায়। নারীরা ট্রেনে একা চলতে পারে। আর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর সাফাই আরো কড়া। তার দাবি, মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি টাকা মানুষের পকেটে। অর্থনীতি এবং হাটবাজার বিষয়ক দুই মান্যবরের এই দাবির বিপরীতে তেমন কোনো কথা হয়নি। মানুষ বা জনগণও ক্ষেপেনি। সইতে সইতে মহাশয় হিসেবে মেনে নিয়েছে।

রাষ্ট্রের এবং প্রতিষ্ঠিত মান্যবরেরা যা বলেন সবই সত্য। সারাদিন কেবল সত্যই বলেন। মানুষের আয় কমছে তারা তা মানতে নারাজ। সরকারের ঋণ প্রবণতা বাড়ছে, তাও স্বীকার করতে চান না। বলেন, এগুলো বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর রটানো বদনাম। কখনো কখনো একটু আধটু স্বীকার করলেও দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বা বিশ্বপরিস্থিতির ওপর। নির্ভেজাল সুখবর আছে শুধু ঋণখেলাপিদের জন্য। নামে-বেনামে নেয়া ঋণের সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়েই যাচ্ছে। ব্যাংক দখল এবং নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতকে চরম অবস্থায় নিয়ে গেছে। এ চক্রের উৎপাত ও অর্থনীতির সার্বিক শ্লথগতির প্রভাব পড়ছে সব খাতে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাতে কেবলই খরার টান। এ ধারার মাঝে রাজস্ব আয় নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি লাগামহীন। মানুষের সামগ্রিক আয়ও কমছে। গড়ের অংকে তা দেখানো হচ্ছে বেশি করে। জনজীবনের সাথে ব্যয় বাড়ছে সরকারেরও।

অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আয়ে ঘাটতি থাকলেও, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কৃচ্ছ্রতা সাধনের আহ্বানের পরও সরকারের ব্যয় মোটেই কমেনি। সরকার ঋণ নেয়া বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে শোনানো হচ্ছে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার মাঝেমধ্যে স্বীকার করলেও দেয়া হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের দোহাই। সেইসঙ্গে মুদ্রামান ধরে রাখা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার পর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড। ১৯৮৩ সালে পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বেছে নেওয়া হয়। আর ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়। এ সময় থেকেই চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ডলার বিক্রি ও তদারকির মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কৃত্রিমভাবে ধরে রাখতে চাইছে টাকার মান।

আজব সার্কাসের মাঝে পর্ব যোগ হতে হতে মেগাসার্কাস চলছে। তারওপর বিকল্প বাতলানোর প্রতিযোগিতা চলছে। মরিচ-পেঁয়াজ-বেগুনের বিকল্পও শেখানো হচ্ছে। সাথে বিকল্প রেসিপিসহ পরামর্শও। একদম না খাওয়ার পরামর্শও আছে। চিনিতে সুগার, আর সুগার মানে নিশ্চিত ডায়াবেটিকস। তা হলে চিনি খাওয়া বন্ধ করে দেয়াই ভালো। মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, আলু, পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ কোথাও কোথাও।
আগুন লাগলে রেস্টুরেন্টে যাওয়া ছেড়ে দিতে হবে? ভোট দিতে গিয়ে ‘ভোট দেওয়া হয়ে গেছে’ জানলে বিকল্প হচ্ছে সুন্দর মতো ঘরে চলে এসে লুডু খেলা বা ফেসবুক চালানো। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের এমন বিরল মেধার স্ফুরণ ফেটে-ফুটে বেরুচ্ছে। সবশেষে এসে যোগ হয়েছে, বরই দিয়ে ইফতার করেন, ইফতারে আঙুর-খেজুর কেনো লাগবে? পেয়ারা দিয়েও ইফতার করা যায়। আঙুর-খেজুরের পরিবর্তে বরই দিয়ে ইফতার করার পরামর্শটি সম্প্রতি দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী।

দেশে একটি শ্রেণি গজিয়েছে, যাদের হোটেল-রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে ফ্যাশন দেখাতে হয়। সেখানে কী দিয়ে কী খেলো জানার দরকার নেই। ওই রেস্তোরাঁয় লাইসেন্স আছে কিনা, খাবারগুলো মানসম্পন্ন কিনা, ফ্যাশন অটুট রাখতে গিয়ে তা দেখার সময় কই। এই মুহূর্তে রেস্টুরেন্ট এবং এর ব্যবসায়ীদের নিয়ে আর বেশি না কথায় যাওয়াই ভালো। তাদের কাছে ব্যবসাটাই মূল। আর কাস্টমারদের কাছে ভুরিভোজ ও ফ্যাশন গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে, মানুষের জীবনকে বিন্দুমাত্র মূল্য না দেয়ার কারণে গার্মেন্ট কারখানায় মানুষ মরতে দেখেছি। প্রায় সময়ই গার্মেন্ট কারখানার ইমার্জেন্সি সিড়ি তালাবদ্ধ থাকত। এসব নিয়ে কথা বললেই অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানার মালিকই ‘তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, দেশের এক্সপোর্ট শেষ হয়ে গেল’ বলে রব তুলতেন। ভালো ভবনে যাওয়ার প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে সবাই বলত, পুঁজি কই? এই ঘটনার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ২০১৩ সালে, রানাপ্লাজার দুর্ঘটনার পরে। বিদেশি বায়াররা প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করলো। একসাথে বলল, যে ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করবে না, সেখানে ব্যবসা করবে না। পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে ঢাকায় যেসব শপিংমলের উপরে গার্মেন্ট কারখানা ছিল, প্রায় সবগুলো বন্ধ হয়ে গেল। কারখানাগুলো গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার অঞ্চলে নিজেদের ভবনে চলে গেল। এখন আর আগের মতো আগুনের খবর আসে না। কারণ, ফ্যাক্টরিগুলতে সিঁড়ি আছে, পানি আছে, নিরাপত্তার ট্রেনিং আছে, ছাদ খোলা আছে, ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ আছে।

ঢাকা শহরের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও কমার্শিয়াল ভবনের মালিকদের নোটিশের পর নোটিশ দেয়া হলেও তারা গা মাখেন না। রেস্টুরেন্টের সিঁড়িগুলো হাঁটাচলার জন্য নয়। মালপত্র রাখার জন্য। এরা সেই গার্মেন্ট মালিকদেরই ভাই-ব্রাদার। যারা সিঁড়িতে এক্সপোর্টে কার্টন আর বড় বড় ডেনিম কাপড়ের রোল রেখে সিঁড়ি বন্ধ করে রাখতেন। এরা কেউ গরিব না। গুলশান-বনানীর অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট মাত্র কয়েকটি বড় গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। একই মালিকের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, আরেকটি জাপানি রেস্টুরেন্ট তো তৃতীয়টি থাই রেস্তোরাঁ। তাদের অভাব টাকার নয়, সদিচ্ছার। চাপে না পড়লে তারা লাইনে আসবে না। চাপে পড়লে ঠিকই সিঁড়ি আর ছাদ পরিষ্কার রাখা শুরু করবেন, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ফিট করবেন। তাদের রক্ষক আছেন। শুধু রেস্তোরাঁর অনুমতি নয়, ওই এক-সিঁড়িওয়ালা সাততলা ভবনের অনুমতি কারা দিলো, কারা ওই নরক নির্মাণ করলো, কারা ওই নরকের মালিক, কাদের এসব গুরুতর অনিয়ম এবং ঝুঁকি পরিদর্শন করে আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। যাদের এ দায়িত্ব তারা কী করেন? গত এক দশকে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বেড়েছে, আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি এসেছে, নতুন স্টেশন হয়েছে। আগুন লাগার খবরে তারা ছুটে আসে। তাদের সবকিছু বিতর্ক মুক্ত নয়।

সম্প্রতি কয়েকটি রেস্টুরেন্টে আগুন লাগার ঘটনায় লোক দেখানোর জন্য হোক আর ইস্যু চাপা দেয়ার জন্য হোক যেভাবে রেস্টুরেন্ট ভাঙ্গা হচ্ছে তা সমর্থন করা যায় না। সিলগালায় সমাধান আসে না। তা খুলতে সময় লাগে না। রাজউক-সিটি কর্পোরেশনসহ যারা এ তৎপরতায় এখন সাধু সাজছেন, সেখানেও গোলমালে ভরা। গুরুতর অনিয়ম এবং ঝুঁকি পরিদর্শন করে আগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। তা নেয়া হয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে, ঘটনা বিচারে অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোও স্বাভাবিক। নোটিশ ছাড়া মরছে না কেউ। বেইলি রোডে আগুনে মৃত্যুগুলোও তাই। ঘটনা ঘটার পর শোনা যায় ফায়ার ব্রিগেড কয়েকবারই ঝুঁকির কথা জানিয়ে নোটিশ করেছে। মানে মৃত্যুর নোটিশ। যেখানে আগুন লাগে, সেখানেই শোনা যায় তারা নোটিশ দিয়েছিল! দুর্ঘটনার পর জানা যায়, বাস বা লঞ্চটির ফিটনেস ছিল না বা রুট পারমিট ছিল না। অতএব, নিশ্চিত মৃত্যু। মানে স্বাভাবিক মৃত্যু, তা বাসে, লঞ্চে, আগুনে বা খতনায় বা অ্যানেসথেসিয়ার সময়ই হোক।

দোকান মালিকরা কয়েকদিন চুপচাপ থেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনসহ কর্তৃপক্ষগুলোর কায়কারবার সম্পর্কে। এর মাঝে আবার ঢাকা দক্ষিণের মেয়র জানিয়েছেন, তদন্তগুলো ঠিকভাবে হয় না। আবার উচ্চ আদালত থেকে রুলের পাশাপাশি নির্দেশসহ আদেশ দিয়ে জানতে চান, এসব ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? কখনও আবার তদন্ত কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। আদালত থেকে তদন্ত কমিটি করে দেয়া যেনতেন বিষয় নয়। এটি খুবই অ্যালার্মিং।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ