অন্তহীন যুদ্ধ এবং পরাশক্তির নিঃশব্দ পতনের পথরেখা

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৩ মার্চ ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১২:১০ এএম

বিশ্ব ধারাবাহিকভাবে একটি অন্তহীন যুদ্ধের পরিনতির দিকে এগিয়ে চলেছে। এটি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। পৌরাণিক কাহিনী কিংবা হাবিল-কাবিলের দ্বন্দ্বের পরিনতির কথা বাদ দিলেও আধুনিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই অন্তহীন যুদ্ধের সূচনা সম্ভবত ইউরোপীয় খৃষ্টানদের প্রথম ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে। আর মুসলমানদের বিজয়ের সূচনা হয়েছিল ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১৭ মার্চ (দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমজান) মদিনার মুসলমান ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ক্রমবর্ধমান মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে কুরাইশরা ১৩শ’ সৈন্যের যে বাহিনী গড়ে তুলেছিল তা ছিল অস্ত্রশস্ত্র, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, লৌহ বর্ম, ঘোড়্,া ঊট ও খাদ্য সম্ভারে মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। পক্ষান্তরে আনসার, মুহাজিরসহ মুসলমান বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। তিনগুণ বড় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরক্ষা ও সম্পদ নিয়ে বিস্ময়করভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনার মধ্য দিয়ে ইসলামের বিজয় পতাকা নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়। রাসুল (সা.) এর নিদের্শে বদরের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর বন্দিদের সাথে যে ধরণের ব্যবহার করা হয়েছিল, যুদ্ধের ইতিহাসে তা এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল। বিজয়ী বাহিনীর সেনারা নিজেরা শুধুমাত্র খেজুর খেয়ে দিনাতিপাত করলেও তারা বন্দিদের রুটি খেতে দিয়েছিলেন। আজকের গাজা যুদ্ধে হামাসের যোদ্ধারাও ইসরাইলী বন্দিদের সাথে রাসুলের নির্দেশমত মানবিক-সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করছে। মুক্তিপ্রাপ্ত ইসরাইলীরা প্রকাশ্য তাদের প্রশংসাও করেছে। পক্ষান্তরে ইসরাইলী সেনারা নারী, শিশুসহ ফিলিস্তিনি বন্দিদের সাথে নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণ করছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযোগিতা, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত করছে। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর উপর দমনাভিযান ও এথনিক ক্লিনজিং হঠাৎ করে ২০২৩ সালে শুরু হয়নি। একাদশ শতকে শেষ ক্রুসেডে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ক্রুসেডের আপাত সমাপ্তি ঘটলেও প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল বিশ্বে আরব ভূখ-ে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ইঙ্গ-মার্কিন পরিকল্পনা থেকেই এ বর্বরতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তারা কখনো ক্রুসেডে ব্যর্থতার কথা ভুলে যায়নি। ইসরাইলী জায়নবাদ প্রভাবিত নিউ কনজারভেটিভ (নিওকন) মার্কিন খৃষ্টানদের প্রতিনিধি জর্জ ডাব্লিও বুশ ২০০১ সালে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কথিত জঙ্গিবাদী মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন ক্রুসেড ও অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে, পরবর্তী দুই দশক ধরে ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে একের পর এক মুসলিম দেশগুলোকে ধ্বংস ও দখলের ভয়ানক খেলায় মেতেছিল। আফগানিস্তানে কার্যত পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে তালেবানদের সাথে সমঝোতা করে তাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সামরিক-অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল দেশ আফগানিস্তানের সাথে যুদ্ধ করতে ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট, মার্কিন ও ন্যাটোর লাখ লাখ সেনাসদস্য, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক-সাঁজোয়া এবং গণবিদ্ধংসী সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়েও জানবাজ আফগানদের হারাতে পারেনি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে অবরুদ্ধ গাজায় বর্বরতম গণহত্যা চালিয়েও হামাস-হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের মুখে টিকতে পারছে না জায়নবাদী ইসরাইলীরা। এ ইতিহাস যেন বার বার বদরের যুদ্ধেরই পুনরাবৃত্তি।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির বিজয়ের ধারাবাহিকতায় আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস নতুন এক বাস্তবতায় উপনীত হয়। তবে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভ. ই. লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানীতে এডলফ হিটলারের নাৎসী পার্টির জয়জয়কার এবং তাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস একটি প্রায় অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসী শক্তিতে পরিনত হয়। যুদ্ধের আগে ১৯৩৯ সালের আগস্টে চরম প্রতিপক্ষ শক্তি হিটলারের নাৎসী জার্মানী ও স্টালিনের সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি গোপণ সন্ধি ও অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর হিটলারের বাহিনী প্রথমে পোল্যান্ড পরে ফ্রান্স দখল করে নেয়। পোল্যান্ড দখলে জার্মানী ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাগাভাগি করে নেয়। তবে একের পর এক রাষ্ট্র দখল করার মধ্য দিয়ে হিটলার ইউরোপে নিজেকে অজেয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াসের অংশ হিসেবে তার গোপণ ও প্রধান টার্গেট ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করা। তিরিশ লক্ষাধিক সৈন্য, ২০ হাজারের বেশি ট্যাঙ্ক এবং হাজার হাজার যুদ্ধ বিমান নিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে মাত্র ১০ সপ্তাহের মধ্যে বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করার যুদ্ধ পরিকল্পনা খুব সাফল্যের সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। হিটলারের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করে কিছুটা নির্ভার সোভিয়েত বাহিনী এমন বড় একটি যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত থাকায় শুরুতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইউক্রেন, ক্রিমিয়া ও ডনবাস এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হওয়ায় হিটলার এ অঞ্চলটি দখল করতে সবচেয়ে বড় আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিল। সোভিয়েত বাহিনী লাখ লাখ সৈন্য ও সহ¯্রাধিক যুদ্ধ বিমান হারানোর পর পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। জার্মানীর সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে জাপানের বোমা হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিস্ক্রিয় থাকলে যুদ্ধ জয়ের সব আয়োজনই হিটলার ও তার অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিয়েভ দখল করতে গিয়ে সাড়ে ৬ লাখ সোভিয়েত সৈন্য হত্যা করেছিল হিটলারের বাহিনী। তড়িঘড়ি ও ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলে নেয়ার পরিকল্পনায় কিছু মারাত্মক ভুল-ভ্রান্তির কারণে হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্যাঁড়াকলে আটকে যায়। অপারেশন বারবারোসা এবং অপারেশন স্তালিনগ্রাদে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হিটলারের বাহিনী রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণ অপারেশন টাইফুন মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। মিত্রশক্তির ত্রিমুখী আক্রমণ মোকাবেলায় হিটলারের বাহিনী যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় দিলেও ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে সোভিয়েত বাহিনীর বার্লিন আক্রমণে বিপর্যয় ঠেকাতে পারেনি। এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে সোভিয়েত গোলন্দাজ বাহিনীর বার্লিনে প্রবেশের মধ্য দিয়ে জার্মানির পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবল্স, জেনারেল হিমলারসহ অনেকে প্রথমে সন্ধি ও আত্মসর্মপণের চেষ্টা করে হিটলারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেন। ফুয়েরার বাঙ্কারে নিজে আত্মহত্যা করার একদিন আগে দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। অত:পর পরিকল্পনা মাফিক দু’জনে একসাথেই আত্মহত্যা করেন।

হিটলারের পরাজয়ের পরও নানা ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছিল। পার্ল হারবারে বোমা হামলার প্রতিশোধ হিসেবে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমা ফেলে শহর দুটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে মার্কিন বিমান বাহিনী। পারমানবিক বোমায় একসাথে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা ও হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসস্তুপের মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তি বিজয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার নবযাত্রা সূচিত হয়। ইতিহাসের ধারকরা সত্য ধারণে সক্ষম না হলে ইতিহাস কখনো সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেনা। কারণ, ইতিহাস সব সময় বিজয়ী শক্তির গুণকীর্তন করতে অভ্যস্থ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালীনতা আমরা এখনো অতিক্রম করতে পারিনি। কারণ, সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতি এখনো সেসব যুদ্ধের মাধ্যমে সাধিত পরিবর্তনের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাইপোলার বিশ্ব এখন একচ্ছত্রভাবে ইউনিপোলার বা একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে পরিনত হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের হলোকস্টের ঘটনাকে ব্যবহার করে পশ্চিমা গণমাধ্যম, থিঙ্কট্যাঙ্ক এবং এস্টাবলিশমেন্ট ইহুদিদের পক্ষে এক ধরণের মানবিক অবস্থান তৈরী করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের চিন্তা না করে পশ্চিম ইউরোপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে এবং পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা বৃটিশ ঊপনিবেশিক শক্তির পতন নিশ্চিত হলে বিশ্বের পরবর্তী ইতিহাস ভিন্নতর ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হতো। উসমানীয় খেলাফতের ভাগাভাগি, ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম এবং ক্রুসেডের পুরনো ক্ষতচিহ্ন অনাবৃত করে অন্তহীন যুদ্ধের পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়গুলো না থাকলে এই বিশ্ব আরো নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারত। হিটলার ইউরোপের ইহুদিদের জন্য পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারে একটি নিজস্ব আবাসভূমি গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রায় চুড়ান্ত করে এনেছিলেন। ১৯৪২ সালে ব্যাটল অব মাদাগাস্কারে হিটলারের বাহিনীর পরাজয় না হলে মাদাগাস্কারে ইহুদি নিবাস গড়ে তোলার ফাইনাল সলিউশন নিশ্চিত ছিল। জার্মানীতে হিটলারের কাছে ইহুদি সমস্যা এতটাই প্রকট রূপে দেখা দিয়েছিল যে, দ্বিতীয় পরিকল্পনা ইউরোপের ইহুদিদের রাশিয়ায় চালান করে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদেরকে দেশছাড়া করার নির্মম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। ইহুদি ও পশ্চিমা গণমাধ্যম ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো যে হলোকস্টের প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল, তাতে অন্তত ৫০-৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যার তথ্য ছড়ানো হয়েছে। হলোকস্ট নিয়ে জায়নবাদী প্রচারনার কোনো প্রামাণ্য ভিত্তি না থাকায় এর বিপরীতে কেউ কেউ ৫০-৬০ লাখ ইহুদি হত্যার দাবিকে রূপকথার গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইহুদিরা জার্মানী-ইউরোপের অনিরাপদ অবস্থান ছেড়ে আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনে পালিয়ে যায়। আলবেনিয়ার মুসলমানরা জার্মানী-রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার ইহুদিকে আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। ক্রুসেডের সময়ও স্পেনের ইহুদিরা মুসলমানদের নিরাপত্তা লাভ করেছিল। অনেক ইহুদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। দশম শতকে কর্ডোবা খেলাফতে খলিফা ৩য় আব্দুর রহমান এবং তার পুত্র আব্দুল হাকামের সময়টিকে আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় ইহুদি সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত হয়। মুসলমানরা যদি কখনো ইহুদি জনগোষ্ঠিকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইতো, তা অসম্ভব ছিল না।

পদার্থ বিদ্যার একটি মৌলিক প্রপঞ্চ হচ্ছে, শক্তির কোনো বিনাশ নেই, শুধু রূপান্তর আছে। একইভাবে, কোনো মতবাদকেও শক্তি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। সপ্তদশ শতকের পদার্থ বিজ্ঞানী আইজাক নিউটনের থিওরি অব রিলেটিভিটির তৃতীয় সূত্র অনুসারে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া আছে। প্রতিটি ঐতিহাসিক জুলুমবাজির ঘটনা যেন সে জাতির ললাটে একইভাবে ফিরে আসে। জায়নবাদী ইহুদিদের শয়তানি ও ইউরোপ-আমেরিকার ঔপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থদ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হচ্ছে মুসলমানদের। আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে প্রবল পরাশক্তির বিরুদ্ধে নিপীড়িত মুসমান জনগোষ্ঠির বিজয়ের নির্দশন হয়ে টিকে থাকবে। রাশিয়া এবং আমেরিকাকে পরাজিত করে আফগান তালেবানরা যে সৌর্য্যরে স্বাক্ষর রেখেছে, আমেরিকা ও ইসরাইলের সম্মিলিত শক্তির নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে গাজায় হামাস যোদ্ধারা যেভাবে প্রতিরোধ টিকিয়ে রেখেছে, তা পরাশক্তিগুলোর জন্য একটি মাইলফলক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের রাশিয়া দখলের মনোবাঞ্ছা পূরণ না হলেও কট্টর নাৎসীবিরোধী জামার্নীর নেতারা কি এখনো রাশিয়া দখল বা পরাজয়ের স্বপ্ন দেখছেন? রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের প্রেক্ষাপটের পেছনে ন্যাটো ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের নীলনকশাকে দায়ী করলে অত্যুক্তি হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেনস্কির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি পরাজয়ের কাছাকাছি চলে আসার প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনকে মিসাইল দিয়ে সহযোগিতার বিষয় নিয়ে সম্প্রতি জামার্নীর সেনাকমান্ডারদের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন জামার্নীর এই পরিকল্পনাকে রাশিয়ার সাথে জার্মানী ও ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা হিসেবে দেখছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির নাস্তানাবুদ অবস্থা তাদেরকে যেন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ইউক্রেনে জেলেনস্কির বাহিনীর পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক বাজেট খরচ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের মুখ রক্ষা করতে পারছে না। তারা কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন-সহযোগিতা দিয়ে হামাস নিমূর্লের নামে গাজায় গণহত্যার ইন্ধন দিয়ে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে শক্তি ও বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেন তার শেষ স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন ভাষণের শুরুতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের প্রসঙ্গ এনে ১৯৪১ সালের জানুয়ারীতে তৎকালীন বিশেষ সময়ে মার্কিন কংগ্রেসের চেম্বারে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ইউনিয়ন ভাষণের স্মৃতিচারণ করেছেন। তার মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারো একটি যুদ্ধকালীন সংকটময় সময়ে পড়েছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি জো বাইডেন গাজা যুদ্ধের নামে গণহত্যাকে আবারো ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। গাজা গণহত্যায় জো বাইডেনের নীরব সমর্থন তাকে নিজ দেশের জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তিনি হয়তো গদিচ্যুত হবেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের হাতে আরো বিপজ্জনক ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিকল্প ছাড়া আর কিছুই নেই। এ থেকে বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তার জনগণের হাত থেকে বহু আগেই জায়নবাদী লবিস্টদের হাতে চলে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চোখ ও কণ্ঠ যেন দখলদার ইহুদি জায়নবাদীদের দৃষ্টি ও কণ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করছে। ইসরাইলের হারেজ পত্রিকার সাংবাদিক-কলামিস্ট গিদন লেভি তার সাম্প্রতিক কলামে লিখেছেন, ১৫০ দিনের যুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও ইসরাইল আগের চেয়ে শক্তিশালী কিংবা নিরাপদ নয়। বদরের যুদ্ধ থেকে আফগান ও গাজা যুদ্ধের ফলাফল বলে দিচ্ছে, বিজয়ের হিসাব-নিকাশ দুনিয়ার কোনো পরাশক্তির হাতে নেই।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ