বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক নির্দেশনা

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৫ এএম

সরকারের পক্ষ থেকে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে নেয়ার দাবি করা হলেও দেশের অর্থনীতি এখন চরম সংকটকালে পড়েছে। সংকট উত্তরণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না। বিশেষত অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সেক্টরকে ভেতর থেকে ফোঁকলা করে দেয়ার কার্যক্রম থেমে নেই। ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের ধারাক্রম বহাল তবিয়তে অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থ বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধি থেকেই এর প্রকৃত অবস্থা বুঝা যায়। ২০২২ সালের শেষে এসে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের অংক দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে এসে এ অংক ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থা, খেলাপি ও মন্দঋণের জালে আটকে পড়া সম্পদ উদ্ধারে সরকারের তরফ থেকে নানাবিধ উদ্যোগের কথা বলা হলেও আদতে সে সব উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে এক সাকুর্লার জারি করেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের জন্য বিমান ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন, শেয়ার বা বন্ড ছাড়ার অনুমোদন, বাড়ি-গাড়ী, জমি, ফ্ল্যাট ও বিলাসী জীবন যাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে থাকলে তা বাতিল করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে। চলতি বছরের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার অনুসারে নির্দেশনাসমুহের বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে।

গত দেড় দশক ধরে দেশের অর্থনীতিতে এক শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে। এ সময়ে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে ৭ গুণের বেশি। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমান ছিল ২২ কোটি টাকা। ১৯৯০ সালে ৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ১৮ বছরে ২২হাজার কোটিতে উঠেছিল। এরপর ২০২৩ সালের শেষে এসে ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছিল। মাত্র ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ ৭গুণ বেড়ে যাওয়া এবং দেশ থেকে প্রতিবছর ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হওয়ার বাস্তবতা একই সুত্রে গাঁথা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমুহের নিয়ন্ত্রক ও তদারককারি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো উদ্যোগই এ ক্ষেত্রে সফল হয়নি। ব্যাংকিং সেক্টরের রাঘব বোয়ালদের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং সেক্টরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায় এড়ানো যাবে না। কথিত সার্কুলারে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ এবং ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এখতিয়ারে রাখায় এ নিয়ে ইতিমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে শুধুমাত্র কিছু এড-হক ভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়ে অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করলেও এই প্রথম বারের মত রাঘব-বোয়াল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দৃশ্যমান হলো। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এর দুর্বলতা এবং প্রতিবন্ধকতাসমুহ দূর করে তা বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক, এটাই সকলের প্রত্যাশা।

দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে অনিশ্চিত ও সংকটাপন্ন রেখে অর্থনৈতিক অবস্থাকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল করা অসম্ভব। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যাংক দুর্বল ও অতি দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গ্রাহকদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে এসব ব্যাংককে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একীভ’ত হওয়ার প্রেসক্রিপশনও দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক ব্যাসেল চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগের কথাও বলা হচ্ছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের দৈন্যদশা, বিশৃঙ্খলা, দেশ থেকে ব্যাপক হারে টাকা পাচারের সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল জড়িত। ঋণ খেলাপের সাথে ব্যাংক পরিচালকদের মধ্যে আন্ত:ব্যাংকিং যোগাযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অর্থমন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের নিবিড় যোগসাজশের ভ’মিকা অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। মন্দঋণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের সাথে যোগসাজশে জড়িত ব্যক্তিদেরকে জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনতে আরো শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। কথিত সার্কুলারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ঋণ গ্রহীতারাই নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, একাধিক ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের মধ্যে যারা ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে, তাদেরকে নিষেধাজ্ঞা, জবাবদিহিতা, শাস্তি এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আরো শক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রনালয়ের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ ছাড়া তা সম্ভব নয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ