ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসায় রাষ্ট্রীয়-সামাজিক উদ্যোগ জরুরি

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম

কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের প্রায় সকল রোগ এবং ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্যান্য অনেক ব্যাধির সময়মত যথাযথ চিকিৎসা না হলে তা শেষ পর্যন্ত কিডনি বিকল রোগে পরিণত হয়। তাই এটা অনুমান করা যায়, প্রায় সবাই কিডনি বিকল রোগের ঝুঁকিতে আছেন। গোষ্ঠী ও সামষ্টিক সহায়তা ছাড়া কিডনি বিকল রোগের যথাযথ চিকিৎসা পুনর্বাসন কখনই সম্ভব নয়। ফলে কিডনি রোগী বিশেষ করে কিডনি বিকল রোগীগণ, যাদের ডায়ালাইসিসের বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় তাদের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। তাই যেমন প্রতিরোধ কার্যক্রম চালাতে হবে, সমান্তরালভাবে চিকিৎসা পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও নিতে হবে।

বিভিন্ন সমীক্ষা ও জরিপে এবং মতবিনিময়ে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, সমস্যাগুলোর জন্য যে দুর্ভোগ হচ্ছে সাধারণত তা হলো: সময়মত রোগ নির্ণয়ের ডায়ালাইসিসের উচ্চমূল্য, পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যয়, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যয়, দক্ষ চিকিৎসা সেবাপ্রদানকারীর অভাব, চিকিৎসা সেবাপ্রদানকারী সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, যথাযথ তদারকি ও পরীবীক্ষণের অপ্রতুলতা, চিকিৎসা সেবায় বা উপকরণে আরোপিত ভ্যাট ও ট্যাক্স ইত্যাদি। দু’ভাবে এই দুর্ভোগকে বর্ণনা করা যায়: এক. সুযোগের অভাব ও দুই. সামর্থের অভাব। এই অভাবের কারণে বেশির ভাগ কিডনি বিকল রোগীর পরিণতি হলো রোগ ভোগের কষ্ট বা পরিশেষে অকাল মৃত্যু। এর ফলে এক একজন রোগীর সাথে এক একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। আর্থ-সামাজিক-মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়।

কিডনি বিকলকে একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সমস্যা হিসাবে দেখার উপায় নেই। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জনগণের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের আগামীতে কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি আছে এবং এদের ১০ শতাংশের আগামী দশ বছরের মধ্যে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা ন্যূনতম শতকরা ১০ ভাগ। কী ভয়ানক তথ্য! তাই এখনই সমন্বিত কাজ শুরু করতে হবে।

সমন্বিত কাজ হবে তথ্য ও তত্ত্ব ভিত্তিক। মনগড়া বা বিক্ষিপ্তভাবে নয়। দুর্ভোগের কারণগুলো যথাযথ বিশ্লেষণ করে তা সমাধানের জন্য রোডম্যাপ নির্ধারণ করতে হবে। এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা হলো ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। জাতীয় অঙ্গীকারে আবৃত হয়ে সামর্থ নির্ধারিত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কিডনি বিকল রোগীর জন্য চিকিৎসা পুনর্বাসন নিরাপত্তা বলয় সুজন। জাতীয় অঙ্গীকার হবে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য ‘বিল অব রাইট’। জাতীয় সংসদ হবে তার সূতিকাগার। জনপ্রতিনিধিগণ হবেন তার কারিগর, গত শতাব্দীর শঞ্চাশের দশকে যুক্তরাজ্য এবং সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে। তারপর অনেক দেশ তা অনুসরণ করেছে। অথচ তাদের দেশের জনগণের গড় আয় আমাদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।

আমাদের দেশেও তা সম্ভব। আমরা একটু পরীবীক্ষণ করলে দেখতে পাব, আমাদের কিছু দৈনন্দিন কাজ ও সামাজিক আনন্দ আর উল্লাসের জন্য যে অর্থ আর সম্পদের অপচয় আমরা করি, তার এক সামান্য অংশ দিয়েই পরিপূরক সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব। এজন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আর বুদ্ধিজীবীদের দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্ম কৌশলগুলো থেকে শিক্ষা আর দীক্ষা নিয়ে আমাদের কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। সেই কর্ম কৌশলকে প্রায়োগিক কৌশলে রূপান্তরিত করার জন্য জন প্রতিনিধি এবং আইন প্রণেতাদের প্রভাবিত করে জাতীয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কিডনি বিকল রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

কর্মকৌশলের প্রধান থিম হবে জাতীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে কিডনি রোগীদের জন্য সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা। প্রথমে প্রয়োজন একটি জাতীয় আইন। এই আইনের মাধ্যমে একটি জাতীয় কমিশন হবে এবং অর্থ আহরণের ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কমিশন এই আহরিত অর্থের রক্ষক ও পরিবর্ধক এবং সঞ্চালক হবে। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে কমিশন দেশের ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্ট প্রদানকারী সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধিত করবে। কারও যখন কিডনি বিকল ধরা পড়বে তখন সেই রোগী কমিশনের সাথে নিবন্ধিত হবেন। কমিশন তখন নির্ধারণ করবে রোগীর আর্থিক সক্ষমতা ভিত্তিক তার প্রদেয় অংশ এবং কার জন্য কতটুকু সাবসিডি দিতে হবে। এরপর রোগী যেকোন নিবন্ধিত সেবাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেবেন এবং তার জন্য নির্ধারিত অর্থ দেবেন এবং বাকী টুকু কমিশনের নিকট থেকে সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিল করে নেবেন। যথাযথ তদারকি ও পরীবীক্ষণের মাধ্যমে এই সামাজিক সহায়তা স্বচ্ছতার মাধ্যমে সমগ্র কার্যক্রম পরিচালিত হবে। চিকিৎসার সঠিক মানদন্ড পরিচালিত হবে। দেশের ইন্সিওরেন্স প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। আমেরিকার কিডনি বিকল রোগীদের বিল আব রাইটস নামে খ্যাত মেডিকেয়ার ইএসআরডি প্রোগ্রাম আইন থেকে গাইড লাইন নেয়া যেতে পারে।

সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু অর্থই সব। কোথা থেকে তা আহরিত হবে? একটি উদাহরণ দেয়া যায়। আমাদের দৈনন্দিন খরচের খুবই কম পরিমাণ অর্থ যদি কিডনি বিকল সহায়তা বা জীবন উপহার লেভী হিসাবে স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি থাকি তাহলে এ কাজ কখনই অসম্ভব নয়, নয় আমাদের সামর্থের বাইরে। যেমন আমাদের দেশে কয়েক কোটি মোবাইল সক্রিয় এবং দিনে একটি করে কল হলেও কয়েক কোটি কল হয়। ধরা যাক, প্রতিদিন আট কোটি কল হয়। প্রতি কলে যদি ১ পয়সা লেভী দেয়া হয় তবে কম করে হলেও আট লক্ষ টাকা হবে প্রতিদিন এবং ১ বছরে তা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। আসল পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। এভাবে আরও অনেক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে, যা হতে এভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে অনুদান প্রদান করতে পারে। এভাবে দূরদৃষ্টি আর কমিটমেন্ট নিয়ে এগোলে আমেরিকার মেডিকেয়ার প্রোগ্রাম বা যুক্তরাজ্যের সোশ্যাল সিকিউরিটির মতো আমাদের দেশেও শুধু মাত্র কিডনি বিকল নয়, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়া যাবে। কিন্তু এসব কারা করবে। অবশ্যই রাজনীতিবিদগণ ও জনগণের প্রতিনিধিগণ। তারাই সচরাচর বলে থাকেন অর্থ কোথায় পাওয়া যাবে? জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, মাখন বড় লোকদের খাবার তাই এতে ট্যাক্স বসাতে হবে বা বিশেষজ্ঞগণের কাছে সচ্ছলরা যান তাই তাতে ভ্যাট লাগাতে হবে অথবা প্রাইভেট স্কুলগুলোতে ধনীদের সন্তানরা পড়ে তাই ভ্যাট দিতে হবে, কিন্তু বলতে পারেন না এসব প্রতিজন মানুষের অত্যাবশ্যকীয় অধিকার, চেষ্টা করতে হবে, যাতে দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে তা সহজলভ্য হয়। এমনি অনেক উদাহরণ বিদ্যমান। বিশ্বে সবচেয়ে কল্যাণকামী জাতীয় নীতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের প্রণেতা লর্ড উইলিয়াম ব্রেবারিজ এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, এ প্রসঙ্গে একজন নেতিবাচক হলেন সুযোগ ভোগের সবচেয়ে বড় রক্ষক। তাই তো ট্যাক্স ফ্রি দামি গাড়ি তারাই ভোগ করেন আবলীলায়। রাজনীতিবিদগণ তখনই এসব করতে পারবেন যখন তারা একাডেমিক বেইজড কল্যাণকামী রাজনীতি করবেন এবং তাদের মাইন্ডসেট রিসেট করবেন।

আমাদের প্রত্যয় হোক সুযোগ আর সামর্থের অভাবে কোনো কিডনি রোগীর জীবন প্রদীপ যেন নিভে না যায়। আমরা যে যার অবস্থান থেকে এ প্রত্যয় এগিয়ে নিতে পারি। কারণ, আমাদের সম্পদ আছে তবে তা ছড়ানো ছিটানো। কবির কথায়, আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন। আমাদের যা নেই তা হলো, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সমন্বয়। স্বাস্থ্যের সামাজিকীকরণে অজ্ঞতা আর অনীহা। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মাইন্ডসেট স্বাস্থ্যের সামাজিকীকরণে রিসেট করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ