ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

কেন ভারতীয় পণ্য বর্জন, ভারতকেই তা বুঝতে হবে

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০৮ এএম

এটা এখন স্পষ্ট, উপমহাদেশে ভারত একটি অপছন্দের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তার প্রতি এ অঞ্চলের দেশগুলোর জনগণের ক্ষোভ, বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং বিরোধিতা যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তীব্র। দেশটির প্রতি তাদের ন্যূনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। আগ্রাসী মনোভাব, খবরদারি, আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারণে ভারতকে বন্ধু দেশ হিসেবে তারা মনে করে না। এর ফলাফলও ভারত পাচ্ছে। আমরা যদি মালদ্বীপের কথাই ধরি, দেখব, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ছোট দেশ (সমুদ্রসীমা ধরে ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার, শুধু ভখ- অনুযায়ী মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার যা ঢাকা শহরের চেয়েও ছোট) হয়েও ভারতকে ‘আউট’ করে দিয়েছে। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার এমনকি সাদা পোশাকেও তারা থাকতে পারবে না বলে দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু নির্দেশ দিয়েছেন। মুইজ্জু নির্বাচিত হওয়ার আগেই মালদ্বীপ থেকে ভারতকে ‘আউট’ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দেশটির জনগণ তার এই প্রতিশ্রুতিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। সে সময় তারা ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন ও স্লোগান দিতে থাকে। তারা মুইজ্জুকে নির্বাচিত করে এবং শুরুতেই তিনি অনুযায়ী, ইন্ডিয়া আউট প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ১৫ হাজার ১৩২, যা ঢাকার একটি এলাকার জনসংখ্যার সমান। এই অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে ভারতের প্রতি কী পরিমাণ বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণা থাকলে তারা তাকে আউট করে দিতে পারে! এখন দেশটি ভারতকে ছাড়াই নতুন করে পথ চলা শুরু করেছে এবং ভারতের উপর অতি নির্ভরতা বা প্রভাব কাটিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এতে ভারতের আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকছে না। এর জন্য দায়ী ভারত নিজে। উপমহাদেশে শুধু মালদ্বীপই নয়, ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান। পাকিস্তান ও চীনের সাথে তো তার আজন্ম বিরোধ। এখানে সে খবরদারি চালাতে পারে না। বরং ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। ২০২০ সালে ভারতের লাদাখ সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনের সেনাবাহিনীর কাছে কমব্যাট যুদ্ধে কী মারটাই না খায়! সে যুদ্ধে ভারতের কমপক্ষে ২০ জন সেনাসদস্য নিহত হয়। অন্যদিকে, পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীবাহিনী অত্যন্ত সতর্ক ও সংকুচিত অবস্থায় থাকে। দেখা যাচ্ছে, উপমহাদেশে ভারত ‘দাদা’ হওয়ার নীতি অবলম্বন করে যে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে, তা প্রায় প্রত্যেকটি দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদির আঞ্চলিক নেতা হওয়ার স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। তার ভুল নীতির কারণে উপমহাদেশের দেশগুলোর জনগণের কাছে ভারত সম্মান অর্জন করতে পারেনি। ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ বা অপছন্দ করলেও দেশগুলো ভারতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, কিংবা শত্রুতামূলক সম্পর্কে জড়ায়নি। তারা প্রতিবেশি হিসেবে যতটুকু সম্মান দেখানো এবং পারস্পরিক স্বার্থে যেটুকু স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা দরকার, তাই রেখেছে। এটা সম্ভব হয়েছে, উল্লেখিত দেশগুলোর সরকারের নিজস্ব শক্তিশালী কূটনীতির কারণে। দেশগুলোর সরকার তাদের জনগণের মনোভাব বুঝে ভারতের ‘দাদাগিরি’ থেকে বের হয়ে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আমাদের মতো ‘একতরফা’ ও ‘জি হুজুর’ ধরনের সম্পর্কে জড়ায়নি।

দুই.
ভারতের ‘দাদাগিরি’ ফলানো কিংবা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার একমাত্র দেশ হিসেবে আমাদের দেশই রয়ে গেছে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, আমাদের সরকারই ক্ষমতায় টিকে থাকতে গদগদ হয়ে ভারতকে এ সুযোগ করে দিয়েছে। ভারত ছাড়া যেন তার চলবে না, কিংবা ভারত হাতছাড়া হয়ে গেলে ক্ষমতায় থাকা যাবে না, এমন এ শঙ্কার নীতি অবলম্বন করে চলেছে। এখানে দেশের স্বার্থ এবং জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবের চেয়ে ক্ষমতায় থাকাই বড় হয়ে উঠেছে। সরকারের এই অন্ধ ভারতপ্রীতির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বহুদিন ধরেই ক্ষোভ, অসন্তোষ ও বিদ্বেষ জমে আছে। এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভারতের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এর কারণ হচ্ছে, ভারত শুধু একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে বিগত তিনটি নির্বাচন করতে ক্ষমতাসীন দলকে সহায়তা করেছে। এর মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব যেমন তীব্র হয়ে উঠেছে, তেমনি তা প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও প্রকাশ্যে মালদ্বীপের মতো ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রডাক্ট’ ক্যাম্পেইন অনেকে শুরু করেছে। প্রবাসী থেকে শুরু করে দেশের মানুষ ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রডাক্ট’ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোরালো ক্যাম্পেইন গড়ে তুলেছে। তাদের এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের ভারতবিরোধী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। তারা উৎসাহিত হয়েছে এবং নীরবে এই ক্যাম্পেইনকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন ঠেকানোর কোনো কৌশল সরকার বা ভারতের নেই। তাদের কিছু বলারও থাকছে না। এর কারণ, এটা জনগণের ইচ্ছাধীন। তারা ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করবে কি করবে না, তা আদেশ-নির্দেশ দিয়ে কিংবা নিপীড়ন-নির্যাতন করে বাধ্য করার উপায় নেই। যদিও ভারতপন্থী হিসেবে কিছু টকশোজীবী ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চেষ্টা করছে, এ ক্যাম্পেইন দেশের মানুষের মধ্যে খুব একটা ইমপ্যাক্ট তৈরি করছে না। সম্ভবত তারা এটা ভুলে যাচ্ছে, একটি পরিবার যে নিয়মিত ভারতীয় পণ্য, যেমন-টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, নারিকেল তেল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, বিস্কুট, চকলেট, চিপস, বডি স্প্রে, থ্রি-পিস, রেজর, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেই পরিবার যদি এসব পণ্য বর্জন করে, তাহলে ভারতের পণ্য বিক্রি কিছুটা হলেও কমে যাবে। যদি একজনও একটি ভারতীয় পণ্য বর্জন করে, তাহলেও একটি পণ্য কম বিক্রি হবে। অন্যদিকে, দেশীয় পণ্য কিনলে দেশের পণ্যের বিক্রি বাড়বে। একাধিক পরিবার যদি বর্জন করে, তাহলে কত ভারতীয় পণ্য বিক্রি কমবে এবং দেশীয় পণ্যের বিক্রি বাড়বে, তার পার্থক্য ব্যাপক হয়ে দাঁড়াবে। যদি একটি পরিবার গড়ে পাঁচ হাজার টাকার ভারতীয় পণ্যবর্জন করে, তাহলে দশটি পরিবার বর্জন করলে তা পঞ্চাশ হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। এতে ভারতীয় পণ্য বিক্রি কম হবে এবং এই অর্থ দেশে থেকে যাবে। এভাবে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবারের মধ্যে যদি শত শত পরিবার বর্জন করা শুরু করে, তাহলে কত অর্থ দেশে থাকবে এবং ভারতের বাণিজ্য কমবে, তার হিসাবটি তথাকথিত টকশোজীবীরা করছে না কিংবা এড়িয়ে গিয়ে ভারতের দালালি করছে। তবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ক্যাম্পেইন চলছে, তা যে ভারতীয় দালাল হিসেবে চিহ্নিত টকশোজীবীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, তা বোঝা যায়, তাদের কথা বলার ধরণ থেকে। যদি ক্যাম্পেইন কোনো প্রভাব বিস্তার না করত, তাহলে তাদের কথা বলার প্রয়োজন পড়ত না কিংবা ক্যাম্পেইন সফল হচ্ছে না বলে বক্তব্য দিত না। শুধু দেশের এসব ভারত তোষণকারীই নয়, ক্যাম্পেইনের কাঁটা গিয়ে বিঁধছে, ভারতীয় ভøগার থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনদের মধ্যেও। এক ভিডিওতে কলকাতার বিখ্যাত সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক যেভাবে উত্তেজিত হয়ে এ নিয়ে কথা বলেছেন এবং আনন্দবাজারসহ ভারতের অন্যান্য পত্রিকায় পণ্যবর্জন ও ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন নিয়ে প্রতিবেদন করেছে, সেটা থেকে তা বোঝা যায়। এই ক্যাম্পেইন যদি কোনো প্রভাব বিস্তার না করত, তাহলে এ নিয়ে তাদের উত্তেজিত হয়ে কথা বলা কিংবা প্রতিবেদন প্রকাশ করার প্রয়োজন ছিল না। শুধু ভারতের পত্র-পত্রিকায়ই নয়, আল জাজিরা, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, বিবিসি বাংলার মতো বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যমেও ভারতীয় পণ্যবর্জনের ক্যাম্পেইন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং তার ইমপেক্টের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে সারাবিশ্বে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যবর্জনের ক্যাম্পেইনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশী যেসব ইনফ্লুয়েন্সিয়ার এই ক্যাম্পেইন শুরু করেছে এবং তা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভারতীয় ব্লগাররা রেগেমেগে তাদেরকে গালাগালি ও বাংলাদেশ নিয়ে অবমাননাকর নানা মন্তব্য করছে। ভারতীয়দের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যবর্জনের ক্যাম্পেইন তাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং একধরনের ভীতি সৃষ্টি করেছে।

তিন.
বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যায্য ও অন্যায় আচরণের প্রতিবাদের যুথসই কোনো আন্দোলন দেশের মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল না। ক্ষমতায় যেতে ভারতের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করেনি এবং পদক্ষেপও নেয়নি। অন্যদিকে, সরকারের ভারততোষণ নীতির বিরোধিতাও মানুষ করতে পারছিল না। বর্তমান সরকারকে বিনাভোট, রাতের ভোট, ডামি ভোটের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখাসহ নির্বাচনে কোনো কোনো আসনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রার্থী ঠিক করে দেয়ার মতো ঘটনা দেশের মানুষের ভেতর তীব্র ভারতবিরোধী ক্ষোভ ও বিদ্বেষ জন্মালেও নিপীড়নের শিকার হওয়ার শঙ্কায় তারা নীরব থেকে গেছে। দ্বাদশ নির্বাচনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশপ্রেমিক কিছু ইনফ্লুয়েন্সিয়ার মালদ্বীপের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন এবং তা বাস্তবায়ন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশেও এই ক্যাম্পেইন শুরু করে। এই ক্যাম্পেইন দ্রুতই দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বহু বাংলাদেশীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় পণ্যবর্জন শুরু করে। তারা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যায় ও অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদের মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে যায়। তারা নিজেরা যেমন ভারতীয় পণ্যবর্জন শুরু করে, তেমনি অন্যদের বর্জন করতে অনুপ্রাণিত করে। অনেকে ভিডিও করে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। এই ক্যাম্পেইন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদেরও চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ক্যাম্পেইন শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় পণ্য আমদানিতে তার প্রভাব পড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে। আগে যেমন ভারত কথায় কথায় পেঁয়াজ, চাল রফতানি বন্ধ করে দিত, এখন সে নিজেই তা রফতানির কথা বলছে। পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পর ভারতীয় পণ্য বর্জন ক্যাম্পেইনের মধ্যে বাংলাদেশকে পঞ্চাশ হাজার টন পেঁয়াজ সরবারহ করেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারত সরকারকেও পণ্যবর্জনের এই ক্যাম্পেইন নাড়িয়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, ভারত বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে তার সবধরনের চাওয়া আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও বিনাস্বার্থে তা দিয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সহজ যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে অনেকটা বিনামূল্যে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিয়েছে। রেল, নৌপথসহ সমুদ্র ও নৌবন্দর ব্যবহারের অবাধ সুবিধা দিয়েছে। ভারতের বাণিজ্যকে বাংলাদেশের বাণিজ্যের চেয়ে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ভারতের অন্যান্য যা চাওয়া তার সবই পূরণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার তা করেছে শুধু তার ক্ষমতায় থাকার গ্যারান্টি হিসেবে। ভারতের এসব চাহিদা পূরণের বিপরীতে বাংলাদেশ পেয়েছে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলি। তারা পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা-নির্যাতন করছে। বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা অভিন্ন নদ-নদীর পানি ইচ্ছামতো প্রত্যাহারসহ তিস্তা চুক্তি আটকে দিয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। ভারত আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিকেব গ্রাস করে ফেলেছে। বলা বাহুল্য, যেকোনো দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে এই দুটি ক্ষেত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি কোনো একটি দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে সে দেশের অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। অস্তিত্ব ও নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য পারস্পরিক ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের এ দুটি ক্ষেত্রে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রয়েছে। সরকার ভারতের সাথে সর্বোচ্চ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বলে তা আড়ালে রাখার নীতি অবলম্বন করছে। ভারতের সাথে মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান একসময় এ ধরনের সম্পর্কের মধ্যে থাকলেও তারা বুঝতে পেরে বের হয়ে গেছে। ভারতনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে তারা ভারসাম্যমূলক সম্পর্কে ফিরেছে। মালদ্বীপ তো ভারতকে আউটই করে দিয়েছে। তাতে কি মালদ্বীপ পানিতে পড়ে গেছে? অন্য দেশগুলোরও কি অসুবিধা হচ্ছে? হচ্ছে না। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে, বর্তমান গ্লোবাল পলিটিক্স কিংবা অর্থনীতিতে প্রত্যেক দেশকে প্রত্যেক দেশের প্রয়োজন। কেউই এককেন্দ্রিক বা একদেশের উপর নির্ভর করে চলে না। সেটা পরাশক্তিশালী দেশ হোক, কিংবা উন্নয়নশীল দেশ হোক। প্রত্যেক দেশকেই প্রত্যেকের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। আমাদের সরকার এক ভারতের লেজুড় ধরে আছে।

চার.
ভারতীয় পণ্যবর্জনের যে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে, তা দিন দিন বেগবান হচ্ছে। এ এমন এক ক্যাম্পেইন বা যুদ্ধ, যা প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে কোনো যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না। একে বলে ‘ফাইটিং উইদাউট ফাইটিং।’ যুদ্ধ চলছে কিন্তু তা রক্ত না ঝরিয়েই প্রতিপক্ষকে নমনীয় বা হার মানতে বাধ্য করছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্যাম্পেইন শুরু করা ইনফ্লুয়েন্সারদের ফেসবুক পেজে তাদের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করা থেকে। সেখানে তারা এখন বলতে শুরু করেছে, ভারতে যে চিকিৎসা করতে ৫০০ টাকা লাগে মালয়েশিয়া বা অন্যদেশে তা করতে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। এই বাড়তি টাকা বাংলাদেশিরা কোথায় পাবে? তাদের এ কথার মধ্যে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশের ক্লায়েন্ট বা ক্রেতা হারানোর ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। তারা এটা ভাবে না, যাদের ভারতে গিয়ে চিকিৎসা বা কেনাকাটা করার সামর্থ্য রয়েছে, তাদের ভারত ছাড়াও দেশে বা অন্যদেশে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। বরং অন্যদেশে ভারতের চেয়ে ভাল চিকিৎসা ও পণ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া এখন আমাদের দেশে মানসম্মত চিকিৎসা, পোশাকসহ সব ধরনের মানসম্মত নিত্যপণ্য পাওয়া যায়। কাজেই ভারত যাওয়া কিংবা ভারতীয় পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই। দেশের মানুষ আশা করে, যারা ভারতের অন্যায় আচরণ ও দাদাগিরির প্রতিবাদে ভারতের পণ্যবর্জনের ন্যায়সঙ্গত ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে, তা অব্যাহত রাখবে এবং আরও জোরদার করবে। সরকার ও ভারতকে বুঝতে হবে, জনগণের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কিংবা দমিয়ে কখনো কোনো শুভ ফল পাওয়া যায় না। ভারতকে বুঝতে হবে, কেন ও কি কারণে তার প্রতি বাংলাদেশের মানুষ বিদ্বেষ পোষণ করছে এবং তার পণ্যবর্জনের ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে? এটা না বুঝে যদি অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ অব্যাহত রাখে, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই তাকে বন্ধু মনে করবে না এবং তার বিরোধিতা বন্ধ করবে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

তোফাজ্জলের জানাজায় মানুষের ঢল, দাফন হলো বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

গণপিটুনিতে হত্যা: ঢালাওভাবে ছাত্রদের বিজয়কে খাটো করতে আওয়ামী মিডিয়ার আস্ফালন, সমালোচনার ঝড়

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক এমপি ইয়াকুবসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কারাগারে

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

ভারতকে ৩৭৬ রানে গুটিয়ে দিল বাংলাদেশ, হাসানের ৫

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরো ১৫০ অনিয়মিত বাংলাদেশি

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

দোয়ারাবাজার সীমান্তে মহিষসহ মাছের চালান জব্ধ

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

সিলেটে ১৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার, নারী গ্রেফতার

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

আশ্বিনকেও ফেরালেন তাসকিন

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

কক্সবাজার পাহাড়তলীতে অনৈতিক কাজে অতিষ্ঠ মানুষ, বাধা দেয়ায় বাসার মালিকের উপর হামলা

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

তাসকিনের জোড়া আঘাত, লিটনের রেকর্ড

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

ডিবির আলোচিত ডিসি মশিউর গ্রেপ্তার

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

১৯৯ রানের জুটি ভাঙলেন তাসকিন

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

গণপিটুনিতে দুই মাসে ৩৩ জনের মৃত্যু

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় প্রশ্ন তুললেন জয়

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ