সদকাতুল ফিতর

Daily Inqilab মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ এএম

রোজাদার ব্যক্তির নিজেকে সংযত রাখা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাবশত ভুলভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে। খাওয়া-দাওয়া এবং রোজা বিনষ্টকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা তো সহজ; কিন্তু অনর্থক কথাবার্তা ও অশ্লীল বাক্য এবং অশালীন আচরণ ইত্যাদি থেকে পুরোপুরিভাবে বিরত থাকা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দা-বান্দির জন্য সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন রমজান শেষে। তাহলো ‘সদকাতুল ফিতর’। এ সদকায় ফিতরের মাধ্যমে রোজার ভুলগুলো মার্জনা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) সদকায় ফিতর আদায় করার জন্য খুব তাকিদ দিয়েছেন, যা অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি, তা দূরীকরণ এবং নিঃস্ব লোকের আহার জোগানোর মাধ্যম। যে ব্যক্তি তা ঈদের আগে আদায় করে, তা মাকবুল সাদকা হবে। আর যদি ঈদের পর আদায় করে, তাহলে তা সাধারণ সদকা হবে। (আবু দাউদ : ১৬০৯)। এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেল, সদকায় ফিতর ওয়াজিব হওয়ার দুইটি উদ্দেশ্য। প্রথমত, রোজার মধ্যবর্তী সময়ে ভুলত্রুটির ক্ষতিপূরণ। দ্বিতীয়ত, অসহায় মিসকিনদের জন্য ঈদের দিন রিজিকের বন্দোবস্ত, যাতে তারাও সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে। আর এজন্যই প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, অসহায় নিঃস্বদের পেছনে এ পরিমাণ ব্যয় করো, যেন তারা এদিনে অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের তিন দিন আগে সদকায় ফিতর আদায় করতেন, যাতে অসহায় পথশিশুরা ঈদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারে।

সদকাতুল ফিতর মূলত দুটি আরবি শব্দের সমষ্টি। একটি হলো সদকা এবং অন্যটি হলো ফিতর। সদকা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান, অনুদান এবং ফিতর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উন্মুক্তকরণ বা রোজা ভঙ্গকরণ। আর ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বা এর সমমূল্য প্রদান করার নিয়মকে শরিয়তের পরিভাষায় সদকাতুল ফিতর বলা হয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন করার পর যেহেতু তা ভঙ্গ করা হয় এবং এ উপলক্ষে শরিয়ত কর্তৃক আরোপিত এ দান দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়; তাই একে সদকাতুল ফিতর বলে অভিহিত করা হয়।

মহানবি হজরত মুহম্মদ (সা.) এর বহু বাণীর আলোকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। সিহা সিত্তাহর প্রায় সবকটি গ্রন্থে সদকাতুল ফিতর অবধারিত হওয়া প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিসে এসেছে: ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) লোকদের ওপর রমজান মাসের সদকায়ে ফিতর অবধারিত করেছেন।’ (সুনানে নাসাঈ : ২৫০৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে: ‘হজরত কায়স ইবনে সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের জাকাতের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর জাকাতের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর আমাদের তা পালন করার নির্দেশও দিতেন না এবং বারণও করতেন না। তবু আমরা তা পালন করতাম।’ (সুনানে নাসাঈ : ২৫০৭)। মহানবী (সা.) এর নির্দেশ পালনার্থে সাহাবায়ে কেরামও যথাযথভাবে সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। ‘হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা মহানবী (সা.) এর যুগে এক সা’ খাদ্যদ্রব্য বা এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা’ যব অথবা এক সা’ কিসমিস দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ (বোখারি : ১৫০৮)। মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে লোকদের সামনে ভাষণ প্রদান করেছেন। তখন তিনি বলেছেন, তোমরা দুজন ব্যক্তির মাঝে এক সা’ গম কিংবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব আদায় করে দাও। এ বিধানটি প্রত্যেকটি গোলাম, স্বাধীন, ছোট ও বড় ব্যক্তির ওপর ফরজ।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৬৬৩)।

পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্য তথা গম, যব, খেজুর, পনির ও কিসমিসের মাধ্যমে সদকায় ফিতর আদায় করা যায়। গমের মাধ্যমে সদকায় ফিতর আদায় করা হলো অর্ধ সা’ (এক কেজি ৬৩৫ গ্রাম) এর মাধ্যমে আদায় করতে হবে। আর যব, খেজুর, পনির বা কিসমিসের মাধ্যমে ফিতরা আদায় করলে সেগুলোর এক সা’ (তিন কেজি ২৭০ গ্রাম) পরিমাণ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে: হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা’ খাদ্য (গম) বা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ পনির অথবা এক সা’ কিসমিস দান করতাম।’ (বোখারি : ১৮২৯)। সেই সময় আরব দেশে গম ছিল আমদানি পণ্য; তাই এর দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে গমের দাম কম। তাই গম ছাড়া অন্য পণ্যের তুল্য মূল্য করে ফিতরা আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শুধু গমের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করার রীতি প্রচলিত হয়ে গেছে। অন্য চারটি দ্রব্যের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর খুব কমই আদায় করা হয়। অথচ, নিয়ম হলো প্রতিটি ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করা।

ঈদুল ফিতরের দিন সুবেহে সাদিক উদয় হওয়ার পর সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। তাই ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা উত্তম। হাদিসে নামাজ আদায়ের আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে সদকা আদায় করল; তাই গ্রহণযোগ্য সদকায়ে ফিতর। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজের পর তা আদায় করল, তা সাধারণ দান-অনুদানের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হলো।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১৬০৯)।

ইসলাম কর্তৃক যেভাবে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারিত রয়েছে, ঠিক তেমনি সদকাতুল ফিতর ব্যয় করার খাতও নির্ধারিত রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে : ‘জাকাত হলো শুধু ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুলকারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সূরা তওবা : ৬০)।

যার কাছে প্রয়োজনীয় সম্পদ ব্যতীত এ পরিমাণ ধনসম্পদ থাকে, যা থেকে জাকাত দেয়া ওয়াজিব, এমন ব্যক্তির জন্য সদকায় ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। জাকাতের পরিমাণ হলো, ‘রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোনো একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থসম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে জাকাতের নিসাব বলে।’ সুতরাং কোনো ব্যক্তির কাছে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চান্দ্র মাসের হিসাবে ১ বছর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে, তাহলে তার ওপর এ সম্পদ থেকে ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাতরূপে প্রদান করা ফরজ। সদকায় ফিতর ও জাকাতের ভেতর সামান্য পার্থক্য রয়েছে। জাকাতের ক্ষেত্রে সম্পদ ‘মালে নামি’ অর্থাৎ বৃদ্ধি পায় এমন সম্পদ হতে হবে। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে এমনটি নয়। জাকাতের সম্পদ পূর্ণ ১ বছর অতিবাহিত হতে হয়; কিন্তু সদকাতুল ফিতর তাৎক্ষণিক ওয়াজিব হয়। উভয়ের ক্ষেত্রে সম্পদ ঋণ থেকে মুক্ত এবং প্রয়োজন অতিরিক্ত হতে হবে। (তাহতায়ি : ৩৯৪)।

শিশুর সদকায় ফিতর বাবার পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। আর যদি সন্তান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার সম্পদ থেকে সদকায় ফিতর আদায় করতে হবে। এমনিভাবে পাগল সন্তানের সদকায় ফিতরের বিধানও। (ফতওয়ায় আলমগির : ১/১৯২)।

সন্তানের প্রাপ্তবয়স হওয়ার পর বাবার পক্ষ থেকে সদকায় ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে বাবা যদি সন্তানের পক্ষ হয়ে আদায় করে দেন, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে। তদ্রুপ স্বামী স্ত্রীর সদকায় ফিতর আদায় করেন, তাহলেও তা হয়ে যাবে। চাই এ বিষয়ে স্ত্রী থেকে অনুমতি নিক কিংবা তার অজান্তে হোক। (দুররে মুখতার : ৩/২৮৫)।

লেখক: ঢাকার শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদরাসার শিক্ষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ