লোডশেডিং ভয়াবহ, এখনই নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ এএম

দেশজুড়ে লোডশেডিং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একদিকে চৈত্রের প্রচ- দাবদাহ, অন্যদিকে লাগাতার লোডশেডিং রোজাদার এবং শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন লোডশেডিং করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় ৫-৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্রামের অবস্থা আরো করুণ, আরো শোচনীয়। বিশেষ করে সিলেট, রংপুর, রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে ১০-১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। অন্যান্য জেলাতেও বিভিন্ন মেয়াদে লোডশেডিং করা হচ্ছে। সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, রমজান বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকবে। কিন্তু সরকার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তার প্লান-প্রোগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবষিত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, এপ্রিল জুড়ে খরা ও গরম এখনকার চেয়ে আরো বাড়বে। তখন পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে উদ্বেগের অবধি নেই। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে, এটা কোনো নতুন কথা নয়। এ ব্যাপারে সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। তা কতটা আছে, সেটাই প্রশ্ন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যখন দেশ ভয়ংকর লোডশেডিংয়ের শিকার, তখন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের অক্ষমতার কারণে বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, যা গ্রাহকদের ঘাড় ভেঙ্গে আদায় করা হচ্ছে। সরকার বিদ্যুতের মূল্য আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। বিদ্যুৎ না পেয়ে কিংবা কম পেয়েও অস্বাভাবিক মূল্য গোনা জুলুমের পর্যায়ে পড়ে। অথচ অবলীলায় এ জুলুম চালানো হচ্ছে।

এ মুর্হূতে সারাদেশে ১৫০০ থেকে ১৮০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে লোডশেডিং আরো বাড়ার আশংকা নিশ্চিত। বিদ্যুৎ না থাকায় রোজাদারদের কষ্টের শেষ নেই। শিশু ও বয়স্ক মানুষের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গরমে- লোডশেডিংয়ে শুধু মানবিক পরিস্থিতিই নয়, অর্থনৈতিক ও পরিবেশিক পরিস্থিতিও বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে।

অনাবৃষ্টি, খরা ও লোডশেডিং বোরো আবাদে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এই মর্মে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। বোরো সবচেয়ে বড় আবাদ ধানের। মূলত সেচের ওপরই এ আবাদ নির্ভরশীল। নদনদী, খালবিলে পানি নেই। ছোট বড় সব নদী ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত ধারাবাহিক রিপোর্টে সেটা বর্ণিত হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে অভিন্ন নদনদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নেওয়া আমাদের নদনদীর মরণদশার প্রধান কারণ, তা কারো অজানা নেই। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ ও ভূমিকা নেই। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, সরকারের কোনো বিকার নেই। এরচেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! এই সঙ্গে আছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রতিক্রিয়া। খরা, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া কিংবা বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ভয়াবহ আকারে দেখা দেওয়া গ্লোবল ওয়ার্মিংয়ের পরিণাম। আমরা একই সাথে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছি। নদনদী, খালবিল জলাশয় পানিশূন্য হয়ে পড়ায় ভূগর্ভ পানির ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে। আবাদ-উৎপাদন ও পানীয় পানির জন্য ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে সেখানেও সংকট দেখা দিয়েছে। পানির স্তর ক্রমাগত নিচে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ভূবিপর্যয়সহ নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশংকা। এসব আশংকা সত্ত্বেও খাবার পানি ও সেচের জন্য আমাদের ভূগর্ভের পানিই ব্যবহার করতে হচ্ছে। বোরো আবাদ প্রয়োজনীয় সেচ ছাড়া সম্ভব নয়। আর সেচ যন্ত্র চালাতে হলে দরকার বিদ্যুৎ ও তেল। তেলের মূল্য বেশি। বিদ্যুতের মূল্যও বেশি। তবে তুলনামূলকভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। এখন গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় আবাদের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, তা না বললেও চলে। ওদিকে বড় বড় শহরে বা শিল্পাঞ্চলেই নয়, গ্রামে-গঞ্জেও অনেক ছোট-ছোট শিল্পকারখানা ও উৎপাদন-উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। বিদ্যুৎ ছাড়া সেগুলো অচল। বিদ্যুৎ না থাকা বা লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রামীণ উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে গ্রামীণ অর্থনীতিও বিপন্ন হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায়, সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

সরকার বড় গলা করে বলে, দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে সরকার এক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব জাহির করে। কিন্তু বাস্তবতা সরকারের দাবি সঙ্গে যায় না। বিদ্যুতের অভাব কোথায় নেই, শিল্পে, কৃষিতে, আবাসিকে, বাণিজ্যেÑ কোথাও বিদ্যুতের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়। শিল্পকারখানার মালিকরা বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার শর্তে অধিক মূল্য দেওয়ার কথা বললেও কি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ পেয়েছে? পায়নি। সক্ষমতার কথা বললেই হবে না, সরবরাহ নিশ্চিত করে সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ঘাটতি তার জন্য জ্বালানি সংকটই মূূল কারণ। গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান জ্বালানি। বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক অলস বসে আছে গ্যাসের অভাবে। ডলার সংকটের কারণে গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এহেন পরিস্থিতিতে অবশিষ্ট সাবসিডি দ্রুত প্রদানের তাকিদ দিয়েছে। সরকার বাজেটে চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫০০০ কোটি টাকা সাবসিডি নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ১৮০০০ কোটি দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট সাবসিডি জুনের মধ্যে ছাড়ের কথা বলেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করে আরো ডলার ছাড়ের অনুরোধ জানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, বেশ কয়েক মাস ধরে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। ডলারের অভাবে প্রয়োজনীয় সবকিছুর আমদানিই ব্যাহত হয়েছে। জ্বালানি আমদানিও। জ্বালানি অত্যন্ত জরুরি পণ্য। এর আমদানি ব্যাহত হলে কী হয়, আমরা এখন হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছি। বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষিতে অবিলম্বে জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থের সংস্থান করতে হবে। বিদ্যুতের অভাবে জনজীবন, অর্থনীতি, উৎপাদন ইত্যাদি যে ক্ষতির সম্মুখীন, তা অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কাজেই ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কর্মসূচিও নিতে হবে। এর আগে নেয়া সাশ্রয় কর্মসূচি তেমন একটা সফল হয়নি। সরকারি কর্মকর্তা ও বিত্তবান শ্রেণী কর্মসূচিকে পাত্তা না দিয়ে এসি চলানোসহ যথেচ্ছ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে। এর খেসারত আমজনতা ও গ্রাহকদের দিতে হয়েছে। এবার যেন এমন না, হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ

শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ