ঈদের আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান
০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম
ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, উৎসব। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বারবার ফিরে আসা। ঈদের আনন্দ ও উৎসব বারবার ফিরে আসে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঈদ। ঈদের আনন্দ ও উৎসব উদযাপনের জন্য ধর্মীয়ভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সে কারণে ঈদের দিন সকালে মিষ্টি মুখ করে বাড়ি থেকে নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার কথা বলা হয়েছে, একই সাথে সাধ্যমত সুন্দর পোশাক পরার কথা বলা হয়েছে। যেকোনো উৎসব বা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেলে মানুষ তার আনন্দ উদযাপন করে থাকে। তেমনি দীর্ঘ একমাস কঠোর সিয়াম সাধনার পর ঈদের মাঠে যখন ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর নির্দেশে রোজাদারদের মাসুম অর্থাৎ নিষ্পাপ হওয়ার পুরস্কার ঘোষণা করবেন, তখন রোজাদারদের জন্য সার্বিক অর্থেই এটি বিশাল আনন্দের ও উৎসবের ব্যাপার।
এমন নয় যে, ইসলাম আনন্দ-উৎসবে বিরোধী। ইসলাম ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফেস্টিভ ধর্ম। দুই ঈদ ছাড়াও জুম্মার দিন হিসেবে বছরে ৫২ দিন মুসলমানদের জন্য ঈদের সমতুল্য। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা থাকলে শুক্রবার যথার্থই মুসলমানদের জন্য হয়ে উঠতো এক মহা আনন্দের দিন। যে ধর্ম সপ্তাহে একদিন তার অনুসারীদের জন্য উৎসবের আয়োজন করেছে সেই ধর্ম আমরা এখন উৎসবহীন বানিয়ে ফেলেছি। সেই ধর্মকে এখন উৎসব বিহীন, কঠিন ও কঠোর আচারনিষ্ঠ করে মুসলিম সমাজের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে ধর্মীয় আচারের প্রতি মানুষের বিশেষ করে তরুণ সমাজের আগ্রহ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করার জন্য ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জামায়াতে নামাজ আদায় করার জন্য মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য বিশেষ ফজিলত দান করেছেন। দিনে পাঁচবার যদি মসজিদে এবং যাতায়াতের পথে বন্ধু, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীর সাথে দেখা হয়, কথা হয়, ভাব বিনিময় হয়, তাহলে বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর আনন্দ ও কষ্ট নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। দিনে পাঁচ বার দেখা হলে একজন মানুষের মুখ দেখে তার ভেতরের কষ্ট ও সুখের প্রতিচ্ছবি বোঝা যায়। ফলে তিনি কী অবস্থায় আছেন, সুখে আছেন, নাকি দুঃখে আছেন তা বুঝে নিয়ে তার সুখ-দুঃখ, ভালোলাগা ও মন্দলাগা ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায় শুধু জামায়াতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে।
এরকম একটি উৎসবমুখর ধর্মকে নিরস ও নিরানন্দ ধর্মে পরিণত করা হয়েছে। তারুণ্য সব সময় উৎসব চায়। সে কারণে মুসলিম তরুণরা নিজেদের করিডরে উৎসব না পেয়ে বিধর্মী করিডরে গিয়ে উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এর ফলে রাখি বন্ধন, হোলির মতো পূজার উৎসবে মুসলিম তরুণরা ইদানিং ব্যাপকভাবে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে ঈদের আনন্দ থেকে, জুমার দিনের আনন্দ থেকে, জামায়াতের আনন্দ থেকে।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে এবং খেলার মাঠের অপ্রতুলতা ও পরিবেশের অভাবে মুসলিম পরিবার ও সমাজ থেকে ঐতিহ্যবাহী আনন্দ-আয়োজনগুলো বিলীন হয়ে গিয়েছে। এখন মুসলিম তরুণরা ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়ে এসে পুরো রমজান মাসে রাতে তারাবিহের নামাজ ও সেহরি খাওয়ার কারণে যেটুকু ঘুম কম হয়েছিল তা একদিনেই পুষিয়ে নেয়ার জন্য লম্বা ঘুম দেয়। এরপর বিকেলে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার কোনো চায়ের দোকানে, সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভির অনুষ্ঠানে সময় কাটায়। কেউবা রোজার কারণে সারামাসে যা খেতে পারেনি একদিনে তা খেয়ে পুষিয়ে নিতে চায়। এ কারণে মুসলিম পরিবার ও সমাজে ঈদ উদযাপনের ঐতিহ্যবাহী রীতি ও আচারগুলো এখন বিলুপ্তির পথে।
এবারে আসি ঈদের বিনোদনের দিকে। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। সিনেমা হলগুলোতে নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি পায়। ঈদের এসব টিভি অনুষ্ঠানগুলো মূল উপজীব্য বিষয় থাকে ভাড়ামো, রসাত্মক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরপুর। এমনকি ঈদের নাটক ও ম্যাগাজিনগুলোতে ঈদ নিয়ে নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, স্থূল রসাত্মক বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ঈদের তাৎপর্য, শিক্ষা এতে খুবই কম গুরুত্ব পায়। বিনোদনের নামে, আনন্দের নামে এখানে এমন সব কন্টেন্ট তৈরি করা হয়, যা ঈদের শিক্ষা ও তাৎপর্যের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা ও ইবাদত বন্দেগী করে মানুষ যে তাকওয়া অর্জন করে তা যাতে এই ঈদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক সপ্তাহে ভন্ডুল করা যায় সেভাবেই আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর বিনোদন কনটেন্ট তৈরি করা হয়। সিনেমা হলগুলোতে এমন এমন সিনেমা মুক্তি দেয়া হয় যেগুলো দেখে এক মাসের পুণ্যি আড়াই ঘণ্টায় রসাতলে ডুবে যায়। এগুলো অত্যন্ত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে।
যদিও এ জন্য দায়ী আমরা মুসলিমরাই। তারুণ্য উৎসব চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে মুসলিম তরুণদের উৎসব ও আনন্দের জন্য এমন ইভেন্ট, অনুষ্ঠান, উৎসব ও আয়োজন থাকা জরুরি ছিল, যাতে মুসলিম তরুণরা আনন্দ ও বিনোদন পেতে পারে এবং তাদের তাকওয়াও ঠিক থাকে। কিন্তু মুসলিম সাংস্কৃতিক কর্মী, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীগণ এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে ও উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আমাদের মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে এমন উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে, যা তাদের রমজানের তাকওয়ার শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
একটা সময় মুসলিম সমাজে ঈদের নামাজ আদায়ের পর বাড়িতে ফিরে পিতা-মাতা ও গুরুজনদের সালাম করে সালামি নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। সালামিটা ছিল পার্থিব পাওনা, কিন্তু এর সাথে যে দোয়া পাওয়া যেত তা দুনিয়া ও আখেরাতের পাথেয় হতো অনুজদের জন্য।
এটা ছিল বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী ঈদ পালনের রীতি। কিন্তু এখন তা বিলুপ্তির পথে। এখন মুসলিম তরুণ ও যুবকরা ঈদের দিন মোবাইল কোম্পানির দেয়া স্পেশাল ডাটা অফার কিনে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে মাথা গুঁজে তার পরিপূর্ণ ব্যবহারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাথা উঁচু করে চারপাশ দেখার সময়, ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি তার থাকে না। এভাবেই আমাদের তরুণরা মুসলিম সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফলে উৎসবের জন্য তারা রাখি বন্ধন, হোলি উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি প্রভৃতি পৌত্তলিক উৎস থেকে উৎসারিত আচার ও অনুষ্ঠানের মধ্যে সম্পৃক্ত করে ফেলছে। এখান থেকে যদি আমরা তরুণ সমাজকে ফেরাতে না পারি তাহলে যে সংস্কৃতিক সংকটের সৃষ্টি হবে তা ধীরে ধীরে মানুষকে ধর্মহীন বা ধর্মবিমুখ জাতিতে পরিণত করবে।
আমাদের শৈশবে আমরা অনেকেই মসজিদে যেতাম মিলাদ বা বিভিন্ন উপলক্ষে পাঠানো বাতাসা ও সিন্নি খাওয়ার জন্য। স্থানীয়ভাবে এই সিন্নিকে ক্ষীর বা জাও বলা হতো। কখনো খিচুড়ি রান্না করেও দেয়া হতো। এখন জিলাপি, তেহারি প্রভৃতি দেয়া হয়। নামাজ শেষ হলেও আমরা এই সিন্নির জন্য বসে থাকতাম। ইমাম সাহেব সবার নামাজ শেষ হলে মিলাদ শুরু করতেন। দরুদ শরিফ পড়ার পর কিছুটা সময় ওয়াজ করতেন। তাতে অত্যন্ত জরুরি এবং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বয়ান থাকতো। আমরা মনোযোগ সহকারে সেগুলো শুনতাম। আমাদের ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান এই মিলাদের বয়ান থেকেই হয়েছে। বয়ানের বিধি নিষেধ ও আমলগুলো যেমন শৈশবে আমাদের উপরে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল এবং এখনকার ব্যক্তিত্ব গঠনেও এর অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। অথচ, এখন মসজিদে বাতাসা-সিন্নি বিতরণের চল উঠেই গেছে।
শিরক মুক্ত এবং হারাম-হালালের বিধান লঙ্ঘিত হয় না এমন আনন্দ ও সাংস্কৃতিক উৎসব চালু করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সেটা যদি স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যানুগ করে করা যায় তাহলে তা আরো বেশি মানুষকে কাছে টানতে পারে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
অতিক্তি লোক ভিড় করায় মাওলানা মামুনুল হক মুক্তি পাননি
দুটি মার্কিন ডেস্ট্রয়ারসহ চার জাহাজে হামলা হুতিদের
দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর সদর দফতরে হামলা রাশিয়ার
আমাকে উৎখাতের পর ক্ষমতায় কে?
ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-১
সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-১
উচ্চতাপ বজ্র-ঝড় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা এ মাসেই
অবশেষে গ্রেফতার সেই ভয়ঙ্কর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দার
ধরা পড়েনি কিলিং মিশনের ১২ খুনি, অভিযোগ ভুক্তভোগীদের
ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম
জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ আজ
৭ জানুয়ারির নির্বাচন ’৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচন -ওবায়দুল কাদের
বাংলাদেশ ও ভারতের দুই সচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
কাউকে ছাড় দেবে না বিএনপি
ওমরা পালনে সস্ত্রীক সউদী আরব গেছেন মির্জা ফখরুল
শনিবার মাধ্যমিকে রোববার থেকে প্রাথমিকে পাঠদান চলবে
এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমেছে ৪ কোটি ডলার
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার
রাশিয়ার উপগ্রহ-বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র ভয়ঙ্কর হতে পারে : পেন্টাগন
শিক্ষা ক্যাম্পাসজুড়ে গাজা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, চলছে গ্রেফতার-উচ্ছেদ