সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের আধার হাওর অঞ্চল
১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম
বাংলাদেশের ভূবৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন হচ্ছে হাওর। বাংলাদেশের বিশাল অংশ হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়াÑ এই সাত জেলার প্রায় ৮ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত, যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। হাওরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক অষ্টমাংশ। বাংলাদেশে কমবেশি এক সপ্তমাংশ মানুষ হাওরনির্ভর অর্থনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, আমাদের মৎস্য সম্পদের ২০ ভাগ আসে হাওর থেকে। হাওর মূলত কৃষক ও মৎস্যজীবীদের বাসস্থান। হাওর অঞ্চল হচ্ছে জীব বৈচিত্র্যের এক অপার আধার। হাওরপাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন হাওর দ্বারা প্রভাবিত। এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন, সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্যÑ সবকিছু হাওরকেন্দ্রিক। তাই এসব ক্ষেত্রে হাওর এলাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার রয়েছে বৈসাদৃশ্য। হাওরে বসবাসরত মানুষ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বেঁচে আছে।
বাংলাদেশ নদী-বিধৌত, জলাশয়, খাল-বিলে পরিপূর্ণ। অববাহিকা, জলাভূমি ও সকল প্লাবনভূমির প্রকৃতি বিশেষত অর্থনৈতিক বাধা বিপত্তি এবং শেষতক সম্ভাবনা প্রায় সমপর্যায়ের, অতএব হাওরের অভিজ্ঞতা অন্য-অঞ্চলেও প্রয়োগ সম্ভব। হাওর অঞ্চলে পুরুষরা যেমন কৃষক, নারীরা তেমনি কৃষাণি। দেখা যায়, বর্ষাকালে পুরুষদের কার্যক্রম কমে যায় আর নারীদের কাজও তেমনি কমে যায়।
অনেক মানুষ হাওরের ভিতরে বসবাস করে। ভিতরের জনপদ, গ্রামগুলো বর্ষায় দ্বীপ সাদৃশ্য ও দূর থেকে নয়নাভিরাম বটে। হবিগঞ্জের বানিয়াচং এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম। পূর্ববাংলার এক সুপ্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক সমৃদ্ধ জনপদ। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা উপজেলার প্রাচীন গ্রাম সেলবরষের রয়েছে সমৃদ্ধ বহু-বিচিত্র সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য। নেত্রকোনা জেলার ধনুনদী তীরবর্তী গাগলাজোর গ্রামের নৌযান তৈরির ধারাবাহিক ইতিহাস ৫০০ বছরেরও বেশি। গাগলাজোরের তৈরি যাত্রী ও মালবাহী নৌকা এবং কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুরের তৈরি মালবাহী নৌকার ঐতিহ্যতো ছিলই, চাহিদা ছিল মুর্শিদাবাদ, কলিকাতা ও আসামের নানা অঞ্চল থেকে মায়ানমার পর্যন্ত। এমনকি আসাম ও রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াঙ্গুন, মায়ানমার) থেকে কাঠ এনে স্থানীয় কারিগরেরা নৌকা তৈরি করত। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জস্থ সিয়াধার গ্রামটি হাজার বছরেরও অধিক প্রাচীন। ১৭৫৯ সালের ভূমিকম্পে গ্রামটির গঠন কাঠামো লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যায়। পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী বিলীন হয়ে গিয়েছে। এই গ্রামের শিক্ষা, গবেষণা কার্যক্রমের ঐতিহ্য ছিল ঈর্ষণীয়। ছিল একদিকে অপ্রচলিত ব্যবসার ধারা, আবার অন্যদিকে নব আবিষ্কৃত এবং ব্যবহারে অনভ্যস্ত দ্রব্যের সমাহার, যা ছিল ব্যবসা ও সেবা খাতের প্রকৃষ্ট নজির। মাছ কমেছে, এখন বাঙালির খাবার শাক-ভাত, হাওরবাসীদেরও তাই।
হাওরের সম্পদ সম্পর্কে বলতে গেলে জলজ সম্পদ এবং ফসলের কথাই মনে হয়, কিন্তু এর বাইরে আরো যে প্রাণিসম্পদ আছে তা-ও কম নয়। হাওরে যেমন আয় হয়, তেমনি দুর্যোগও হয়। হাওর অঞ্চলে বন্যার সময় জেলাগুলোর মানুষ ও শস্যের ক্ষতি হয়। সে সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকে। বর্ষা মৌসুমের আগে যে বন্যা হয় তাকে ফ্ল্যাশ ফ্লাড বলে, এটি হাওর এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হাওরের জমি এক ফসলি হলেও যখন ফসল হয়, প্রচুর হয়। কেবল নিজেদের সারা বছরের প্রয়োজন মেটানোই নয়, এ ফসল তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে পারে। সমস্যাটা হয় যখন ধান পাকার আগে বন্যা চলে আসে, তখন পুরো বছরের ফসলটা নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৭ সালে সেটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। প্রথমত আগাম বন্যা এর কারণ, যেটা এখন প্রাকৃতিক কারণে ঘন ঘন হচ্ছে এবং বাঁধের অব্যবস্থাপনার কারণে তা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। বাঁধের সঙ্গে পরিবেশের একটি সম্পর্ক আছে। কেননা যেখানে-সেখানে বাঁধ দিলে পানিপ্রবাহ বাধা পায়। বাঁধের উচ্চতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকি বাঁধের মাটি ক্ষয়ে গিয়ে নদীতেই পড়ে নদীর নাব্য কমে যায়। পানিপ্রবাহ বাধা পেলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়। অনেক জায়গায় বাঁধের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। একসময় শুরুতে, বাঁধের প্রয়োজনই ছিল না, কেননা তখন ফসল ডুবে যেত না। নদী নাব্য ছিল। পরবর্তী সময় এর প্রয়োজন দেখা দেয়। একসময় হাতি দ্বারা বাঁধ দেয়া হতো।
হাওরের ফসল আমাদের দেশের খাদ্য চাহিদার অনেকাংশ জোগান দেয়। হাওরের আয় আমাদের জিডিপির অংশ। কিন্তু এখন এ অঞ্চলটা সরকারের ওপর চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার কারণে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ব্যাপক ত্রাণ কাজ করতে হচ্ছে। সুনামগঞ্জে বোরো ধান চাষকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ফ্ল্যাশ ফ্লাড কিংবা বোরো ধানেরই কেবল সমস্যা নয় বরং আমন ধানের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়। একজন কৃষকের জমিতে ২২ ধরনের ধান চাষ করা হয়েছিল, কিন্তু তা সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। আসলে হাওর প্রকৃতির সৃষ্টি, কিন্তু আমরা সেই সৃষ্টি নষ্ট করেছি; কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো অনিচ্ছাকৃত। আমাদের নদী বা হাওরের এলাকাগুলো পলি পড়ে অগভীর হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি ঢল ধারণ করার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন কর্মের ফলে সেখান থেকে যে পানি আসে তা আসবেই, যেমন নেপাল থেকে আগে পানি আসতে সময় লাগত পাঁচদিন এখন তা তিনদিনে চলে আসে। সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্য কম থাকার কারণে দ্রুত পানিপ্রবাহের সমস্যা হয়, ফলে দেখা দেয় বন্যা। সরকারিভাবে উজান ও ভাটিতে ব্যাপকভাবে নদীখনন করা হলে সমস্যার অনেকাংশে সমাধান সম্ভব। পাশাপাশি খাল ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখলে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সময়মতো এবং সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। এখানে বজ্রপাতে অনেক কৃষক মারা যায়। সাধারণ সমাধান হিসেবে গাছ লাগানোর কথা বলা হয়। কড়চ এবং শিমুলের যে বন তৈরি করা হয়েছিলো তা এখনো ঢেউ ও বজ্রপাতের মোকাবেলা করে যাচ্ছে। তালগাছ লাগানোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আমাদের একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, উন্নয়ন মানেই নির্মাণ। কিন্তু হাওর এলাকায় এ ধারণার প্রয়োগ সঠিক হবে না। হাওরের জীববৈচিত্র্য আছে। হাওর কেবল হাওর অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশই এর সঙ্গে যুক্ত। এখানকার জীববৈচিত্র্য নানাভাবে নষ্ট হয়েছে। সেটি রক্ষা করা প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে, পানিপ্রবাহ ঠিক রেখে হাওরের উন্নয়ন করতে হবে, তাহলেই হাওর আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দেবে। (পিআইডি)
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন
বগুড়ায় শজিমেকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন
মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, আট প্রার্থীর মানোনয়ন পত্র জমা
বজ্রপাতে কুমিল্লায় ৪ জনের মৃত্যু
টানা অষ্টম দফায় কমলো সোনার দাম
কাপ্তাইয়ে ঝড় হাওয়ায় সিএনজির উপর গাছ পড়ে আহত: ৩
শীতল পানি বিতরন
আলমাতিতে মন্ত্রী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যা কাজাখস্তানে বিদ্যমান পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝড়
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রবাসী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট
চিরিরবন্দরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু
পেনশন স্কিম স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ : কুমিল্লা জেলা প্রশাসক
বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস
মোংলায় চেয়ারম্যান- ভাইসচেয়ারম্যান হতে চান ১৪ জন, সবাই আওয়ামী লীগের
বিশ পয়সার শরীক দল হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করুন--- শামসুল আলম খান
তীব্র গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন,সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্টরা
আবারও বাংলাদেশের অসহায় আত্মসমর্পণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবক্ষয়ের কথা শুনলে কষ্ট লাগে : ফরাসউদ্দিন
চীনে মহাসড়ক ধসে নিহত বেড়ে ৩৬
মধুখালীতে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : ওসির শেল্টারেই চেয়ারম্যান তপনের নানা অপকর্ম
ভারতকে পাকিস্তানে আনতে পিসিবির নয়া কৌশল