ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গণহত্যাকারী ইসরাইলের গালে ইরানের শক্ত চপেটাঘাত

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম

গাজায় ইসরাইলী গণহত্যার বিরুদ্ধে হামাস-হেজবুল্লাহ্র মতো প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর অন্যতম সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক ইরানের উপর জায়নবাদীদের আক্রোশ দীর্ঘদিনের। ইরানের আইআরজিসি বা রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনীর চৌকষ কৌশলগত ফোর্স আল কুদস ব্রিগেডের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিরোধ বাহিনীগুলো ক্রমেই শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ায় ইসরাইলের আইডিএফকে গত দেড়যুগে অন্তত তিনবার স্থলযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হার মেনে ঘরে ফিরতে হয়েছে। ইসরাইল-আমেরিকান সামরিক বিশ্লেষকরা ফিলিস্তিন ও আরব প্রতিরোধ বাহিনীগুলোকে ইরানের আইআরজিসি’র প্রক্সি বলেই গণ্য করে। ফিলিস্তিনী জনগণের উপর সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলা ইসরাইলী দখলদারিত্ব, আগ্রাসন, বর্বরতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বশংবদ আরব রাজারা যখন নিরবতার মধ্য দিয়ে কৌশলে জায়নবাদী ইসরাইলকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল, তখন পশ্চিমা সম্মিলিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে ঐক্য ও বিশ্বজনমত গঠনের পাশাপাশি প্রতিরোধ শক্তিকে পাথর-গুলতি ছোঁড়ার সীমাবদ্ধতা থেকে মারকাভা ট্যাঙ্ক বিদ্ধংসী গ্রেনেড ও হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্রের পর্যায়ে উন্নীত করতে নেপথ্য ভূমিকা রেখেছেন। এ কারণেই ইসরাইলের সীমান্ত থেকে হাজার মাইল দূরের ইরান জায়নবাদীদের প্রধান টার্গেট। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ শক্তিগুলোর বাইরের যেকোনো স্বাধীনচেতা শাসক কিংবা রাজনৈতিক শক্তিতে নির্মূল করতে পশ্চিমারা ইসরাইলকে কার্যত ব্লাঙ্ক চেক দিয়ে রেখেছে। তারা আন্তজার্তিক আইন-কানুন, কনভেনশন ও মানবাধিকারের শর্তসমুহের পরোয়া না করেই অন্যদেশের অভ্যন্তরে টার্গেটেড কিলিং মিশন থেকে শুরু করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে নিবির্চার গণহত্যা, হাজার হাজার শিশু ও নারী হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বর্বরতম যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা ইসরাইলী গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে কখনো কণ্ঠিত হয়নি। ইসলামি ইরানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর এখানেই পার্থক্য। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরাকের সাথে ৮ বছর ব্যাপী যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা, সামরিক-কূটনৈতিক সহায়তা নিয়েও ইরানের বিজয় ঠেকানো যায়নি। সেই থেকে ইরানী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা জায়নবাদী ইসরাইলের গুপ্তহত্যার অন্যতম টার্গেট। ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ বিমান বন্দরে ইরানের লিজেন্ডারি সমরবিদ, আল কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার কাশেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যাকান্ডের পর ইরানের প্রক্সি বাহিনীগুলোর প্রত্যাঘাতে সিরিয়া ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাটিগুলো বড় ধরনের সামরিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। গত বছর ৭ অক্টোবর সংঘটিত হামাসের আল কাসাম ব্রিগেডের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড সুলাইমানি হত্যার প্রেক্ষাপটে গৃহিত ইরানের প্রক্সি সামরিক পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। গাজায় ইসরাইলী গণহত্যা শুরুর আড়াই মাসের মাথায় সিরিয়ায় ইসরাইলী বিমান হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কমান্ডের আল কুদস ফোর্সের সিনিয়র সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইয়েদ রাযি মুসাভি শহীদ হন। এরপর গত ১লা এপ্রিল ২০২৪ (২০ রমজান) সিরিয়ায় ইরানী কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালিয়ে ইসলামি রেভ্যুলেশনারি ফোর্সের ২ জেনারেলসহ মোট ১১জন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরাইল। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে যে কোনো সময় ইসরাইলে হামলা চালানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল ইরানের শীর্ষ নেতারা। তারই প্রেক্ষাপটে ১৩ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ইরানের মাটি থেকে ইসরাইলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর ড্রোন ও মিসাইল দিয়ে নজিরবিহীন হামলা ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’ প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব। ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ৭২ ঘন্টা আগে সতর্কতা জারি করেছিল ইরান।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল ৮০০ কোটি মানুষের এই সবুজ গ্রহটিকে ক্রমে রক্তাক্ত, অগ্নিময় মানবতার ভাগাড়ে পরিনত করে চলেছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ১৫০তম, এক কোটির কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটি জন্মের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে আছে। প্রথম মহাযুদ্ধে ওসমানীয় খেলাফতের পতন এবং ফিলিস্তিনে বৃটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আরবদের জমি দখল করে, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও গণহত্যা চালিয়ে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রটি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শিখণ্ডী হয়ে টিকে আছে। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর উপর আধিপত্যবাদী আগ্রাসন চালিয়ে সেখানকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও যে কোনো ধরণের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে নস্যাৎ করাই যেন ইসরাইলের মূল লক্ষ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি জনগোষ্ঠি পরোক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। হিটলারের টার্গেট থেকে বেঁচে ফেরা ইউরোপের ইহুদিরা ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর গত ৭৬ বছর ধরে অবিরাম আগ্রাসন চালিয়ে বাইবেলে বর্ণিত প্রমিজ্ড ল্যান্ড বা জায়নবাদী ইউটোপিয়া বাস্তবায়নে তাদের একমাত্র হাতিয়ার গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘণ। জন্মের পর থেকেই ইসরাইল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সমরশক্তির প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের পদ থাকলেও প্রাইম মিনিস্টার নেই। তবে মার্কিন রাজনীতিতে ইসরাইল ও ইহুদিদের প্রভাব এতটাই প্রবল যে, কংগ্রেস ও সিনেটের বক্তারা যখন প্রাইম মিনিস্টার নেতানিয়াহু বলে সম্বোধন করেন, তখন মনে হয়, তেল আবিবে অবস্থান করলেও তিনি মার্কিন প্রধানমন্ত্রী। কখনো কখনো এমনটাই মনে হয়, মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রেসিডেন্ট নাকি প্রধানমন্ত্রী, কে বেশি শক্তিশালী? প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে মার্কিন কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর বক্তৃতার সময় বিশ্বের সামনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছিল। হোয়াইট হাউজের কর্তৃত্বকে পাশ কাটিয়ে নেতানিয়াহুর নীতি নির্ধারণী টাইপের বক্তৃতা এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে দলেরই হোন তিনি মূলত ইহুদি লবিস্টদের দ্বারা মনোনীত হওয়া ছাড়া রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে গড়াতে পারেন না। মধ্যপ্রাচ্যে হাজার বছরের সমৃদ্ধ এতিহাসিক-রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে রুদ্ধ করে দিয়ে মহাযুদ্ধের ডামাঢোলে অবৈধ প্রক্রিয়া জন্ম নেয়া ইসরাইল এখন বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের লাঠিয়ালের ভূমিকা নিয়ে সত্তুর বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি ও আরবদের উপর আধিপত্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে দুর্বল বা স্তিমিত করতে পারেনি। হামাস শাসিত গাজা উপত্যকার উপর দেড়যুগ ধরে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন ও হত্যাকান্ডের প্রত্যাঘাতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আল কাসাম ব্রিগেডের বিষ্ময়কর অপারেশন আল আকসা ফ্লাড ইসরাইলীদের সীমাহীন ববর্র গণহত্যার বিরুদ্ধে হামাসের সামরিক প্রতিরোধ জায়নবাদীদের শিড়দাঁড়ায় শক্ত আঘাত হেসেছে। অনিবার্য পরাজয় ও পতনের মুখে ইসরাইল এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে গাজা যুদ্ধকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ দিতে চাচ্ছে। ইসরাইলের মাটিতে ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র হামলা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফল হয়েছে বলে ইরান দাবি করেছে। ইসরাইল এর পাল্টা জবাব দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইরান সেই হামলার জবাব ১০গুন বেশি শক্তিতে প্রত্যাঘাতে আগাম সতর্কতা জারি করেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পাল্টা হামলাকে সমর্থন করবে না বলে জানিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, গাল্ফ ওয়ার, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাফল্য অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছিল। একদিকে শত শত কোটি ডলারের সামরিক ব্যয়, নিজ দেশের সেনাসদস্যদের প্রাণহানি ঘটলেও এসব যুদ্ধ দৃশ্যমান কোনো সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় এনে দিতে পারেনি। এ কারণেই গতানুগতিক যুদ্ধ এড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা মার্সেনারি বাহিনী পোষণ ও প্রক্সিযুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করেছিল বহু আগেই। কোনো প্রক্সি অপারেশন সামরিক সংঘাতে পরিনত হওয়ার আগেই পশ্চিমাদের কৌশলগত বিজয় এনে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশকে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইরানে প্রথমবারের মত জনগণের ভোটে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেখানকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমা বশংবদ রেজা শাহ পাহলবির রাজতান্ত্রিক ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ইরানের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল বৃটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ প্রযোজনার ফসল। সরাসরি সামরিক সংঘাত এড়িয়ে প্রক্সিবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ কৌশলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নিকারাগুয়ায় কন্ট্রা বিদ্রোহ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়া ও সিরিয়ায় বিদ্রোহ, আইসএ’র উত্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের চরম অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার মুখে ঠেলে দেয়া পশ্চিমাদের প্রক্সি যুদ্ধের উদাহরণ। ইউনিপোলার পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের নিষেধাজ্ঞার তোপের মুখে দুর্বল ও অর্থে-বিত্তে ভারসাম্যহীন ইরান গতানুগতিক যুদ্ধ এড়িয়ে ইসরাইল ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে প্রক্সিযুদ্ধের কৌশল হিসেবে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও ইরাকের প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তি ইসরাইল ও পশ্চিমাদের শুধু সন্ত্রস্ত করে তোলতে সক্ষম হয়নি। কনভেনশনাল যুদ্ধে অজেয় শক্তি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ইসরাইলকে বার বার পরাস্ত করার সক্ষমতা দেখিয়েছে ইরানের প্রক্সি গ্রুপ হামাস-হিজবুল্লাহ-হুতি। সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেও হামাসের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে ইসরাইল এখন আমেরিকাকে সাথে নিয়ে ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর আত্মঘাতী তৎপরতা শুরু করেছে। আমেরিকার নেতারা রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থে ইসরাইলকে নি:শর্ত সমর্থন অব্যাহত রাখলেও এবারই প্রথম কিছুটা ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপনাস্ত্র হামলার পর তারা ইরানে পাল্টা হামলাকে সমর্থন করছে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোকে রক্ষা করতে মার্কিন নেতারা প্রকাশ্য এ ধরণের সংঘাতে জড়াতে না চাইলেও বাস্তবে তা রক্ষা করবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আল কোরআনে সুরা বাকারার ১০০ নম্বর আয়াতে প্রথভ্রষ্ট ইহুদি ও খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা যখনই অঙ্গীকার করেছে, তখনই তা ভঙ্গ করেছে, বরং তাদের অধিকাংশই অবিশ্বাসী। বনি ইসরাইল সুযোগ পেলেই বিশৃঙ্খলা বা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। সুরা মায়িদার ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা যতবার যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে মহান আল্লাহ ততবার তা নিভিয়েছেন, তারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা করে বেড়ায়, আল্লাহ বিশৃঙ্খল ব্যক্তিদের ভালবাসেন না।’

সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে কয়েকজন শীর্ষ ইরানি জেনারেলকে হত্যার ঘটনা সরাসরি ইরানে আঘাত করার সামিল। শান্তির সময় বনস্যুলেটে হামলা করে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিন্দা করতে শোনা যায়নি। এমনকি জাতিসংঘও এর নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপরও ইরান ইসরাইলে হামলা না করার শর্ত হিসেবে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, হামলা ও গণহত্যা বন্ধের মত সার্বজনীন শর্ত দিয়েছিল। দক্ষিণ গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হলেও একদিনের জন্যও শিশু ও গণহত্যা বন্ধ করেনি তারা।ইরানের সামরিক-বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত, একের পর এক টার্গেট কিলিং ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে প্ররোচিত করছে ইসরাইল। প্ররোচনার প্রথম জবাবটিকে ইসরাইলের গালে একটি চপেটাঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছিল ইরান। ইরানের ঘোষিত অপারেশন ট্রু প্রমিজ খুব সীমিত সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। জবাবে পাল্টা হামলা করলে এরচেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী ও ভিন্ন মাত্রায় প্রত্যাঘাতের হুশিয়ারি দিয়েছে ইরান। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের লাঠিয়াল ইসরাইলের পক্ষাবলম্বনের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা এবার বেশ সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানালেও জর্ডান ও মিশরের মত মুসলিম উম্মাহ ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি ইরান ও উম্মাহর সাথে আবারো বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করেছে। জর্ডানের সহায়তা না থাকলেও ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র ইসরাইলের জন্য আরো অনেক বেশি বিপর্যয় ডেকে আনত বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইরানের অফেনসিভে ইসরাইলের কয়েকটি সামরিক ঘাটি ও বিমান বন্দরে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে. তা অস্বীকার করতে বরাবরের মত মিডিয়া ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নিয়েছে ইসরাইল। ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে নিজেদের মুখ রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে জায়নবাদীরা। কিন্তু ইসরাইলে সাধারণ মানুষ নেতানিয়াহুর যুদ্ধবাদী নীতি ও ব্যর্থ সামরিক কৌশলের প্রতিবাদে আবারো ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। গাজায় বেপরোয়া গণহত্যা চালানোর পরও হামাসের কাছ থেকে একজন ইসরাইলী বন্দীকেও উদ্ধার করতে না পারা, সামরিক-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল কিংবা ইসরাইলের নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া, পশ্চিমা পুরনো বন্ধুদের সমর্থন হারানো এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আকাশ চুম্বি জনমত বৃদ্ধি জায়নবাদী ইসরাইলের পতনঘন্টা বাজাচ্ছে। গাজায় বর্বরতম গণহত্যা, হামাস-হেজবুল্লাহর প্রতিরোধ দমনে ব্যর্থতার মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার অনিবার্যতা ঠেকাতেই ইরানের সাথে ইসরাইল একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। আল আকসার উপর ইসরাইলী দখলদারিত্বের অবসান, গণহত্যা ও আগ্রাসন বন্ধ করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এবার যারা মুসলিম উম্মাহর সাথে বেইমানি করবে, তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ইরান-ইসরাইল সংঘাতে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন ইরানের পক্ষে। গণহত্যা ও হাজার হাজার শিশু হত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা বিশ্বজনমত ফিলিস্তিনের মুজাহিদ ও ইরানের মনোবল শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কারণে ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তার সরকার ইসরাইলের প্রতিরোধ সক্ষমতা ধ্বংস করেছে। অপারেশন ট্রু প্রমিজ সফলভাবে সমাপ্ত হওয়ার পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি রোববার এক্স হেন্ডেলে দেয়া এক মন্তব্যে বলেছেন, পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে। ইরান ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাত ধরে মুসর্লিম উম্মাহ ও ফিলিস্তিনি জনগন স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখছে। শান্তি ও বিশ্বনিরাপত্তার বিষফোঁড়া ইসরাইল নিজেকে ক্রমশ একটি আত্মঘাতী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। অভিশপ্ত ও সীমালঙ্ঘনকারী জায়নবাদীদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা
ট্রাম্পের বিজয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কি কোনো লাভ হবে?
ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোচালকদের তাণ্ডব রুখতে হবে
স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
আরও

আরও পড়ুন

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি

মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা

মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা