কবি আহমদ আখতারের চলে যাওয়া

Daily Inqilab শাহ মোস্তফা খালেদ

১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম

নাম সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান হলেও বন্ধু ও সুধী মহলে তিনি কবি আহমদ আখতার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সুবিখ্যাত কবি ফররুখ আহমদের পুত্র। কবি হিসেবে তিনিও ছিলেন পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা ‘অবিরাম গ্রামোফোন’ ও ‘অনন্তের প্রথম অক্ষর’। সাহিত্যে ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাব সাহিত্য পদক ২০০৮ ও জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা ২০১১ লাভ করেন। কর্মসূত্রে সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। দীর্ঘদিন ডায়বেটিস ও কিডনি সংক্রান্ত রোগভোগের পর ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ঢাকার স্থানীয় একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

আধ্যাত্মিক শিক্ষক জিয়াউল হক কুতুবুদ্দিনের কাছে শিক্ষা নেয়ার সুবাদে তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন, ছিলেন বন্ধুও। সহপাঠিতা ও বন্ধুত্বের স্রোতের একটা মিলন রেখা থাকে। আমাদের মাঝের সে রেখা শেষ অবধি বন্ধুত্বের থেকে সহপাঠিতার দিকেই হেলে ছিল। শ্রদ্ধা ছিল, ছিল স্নেহ-ভালবাসা-সহমর্মিতা। আমি যে শ্রেণিকক্ষে অত্যুৎসাহী ছাত্রদের একজন ছিলাম, তিনি ততটা চোখে পড়ার মতো ছিলেন না। প্রশ্নে-মন্তব্যে-তর্কে-জিজ্ঞাসায় আমি আলোচনার পুরোভাগে থাকতাম, শিক্ষককে ব্যস্ত করে তুলতাম। আমার সহপাঠী নিশ্চুপ শ্রোতার মতো থাকতেন। কখনো কখনো দুয়েকটা মন্তব্য বা প্রশ্ন করতেন, বাকিদের কাছে সে প্রশ্ন খুব ‘ভেরি গুড কোয়েশ্চেন/কমেন্ট’ বলে মনে যে হতো, তা না। পৃথিবীর সব শ্রেণিকক্ষের মতো ওইখানেও সব ছাত্র মেধায় সমান ছিল না। কিন্তু সকলের মননশীলতা ছিল, তার বিকাশও ঘটছিল।

সততা কেবল অর্থের প্রশ্ন না, নীতির প্রশ্নও। আমাদের মতো সুযোগের অভাবে সৎলোকের ভিড়ে, কবি আহমদ আখতার ছিলেন সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অবশ্য সততার চড়া মূল্য দিয়েছিলেন তিনি। অথচ, সে মূল্য না দিয়ে ক্ষমা চাইতে পারতেন, আপোস করতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। ‘আমি কোনো অন্যায় করি নি, আমি ক্ষমা চাইব না’, এই ভাবনা নিয়ে এক ধরনের আপোসহীন অবস্থানে নিয়ে যান নিজেকে। ‘সবাই তো মানিয়ে নেন, আপনি কেন নিজের ভালো দেখবেন না?’, আমার এই প্রশ্নের জবাবে ‘আল্লাহ নারাজ হবেন’Ñ এই সংক্ষিপ্ত উত্তর করেছিলেন। পার্থিব সুযোগ-সুবিধা ও উন্নতিকে গ্রহণ করা-না করার ক্ষেত্রে তিনি এই মাপকাঠির প্রয়োগ করেছিলেন। আমাদের ওই শ্রেণিকক্ষের অন্য দশজনের ভিড়ে খুব সাধারণ ছাত্র কবি আহমদ আখতার এখানেই নিজের জীবনকে অসাধারণ করে তোলেন।

অবশ্য এর জন্য খুব চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল, কর্মসংস্থান হারান তিনি। একটা বয়সের পর তেমনটা হলে নতুন কর্ম খুঁজে নেয়া সহজ না। তিনি যতটা ভালো মানুষ ছিলেন, ‘সার্ভাইভ্যাল অব দ্যা ফিটেস্ট’ এর পৃথিবীর কুশীলবগণের মধ্যে ততটা ‘চৌকস’ ছিলেন না। বাকি জীবন তাঁকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দারিদ্রের মধ্যে কাটাতে হয়। আমার লম্বা-ফর্সা সুদর্শন সহপাঠীর হাসিভরা মুখের আড়ালে আমি তাঁর ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত ক্ষয়ে যাবার রুক্ষ ছাপ পড়ার সাক্ষী হয়েছি। সে ভোগান্তি শুধু নিজের না, পরিবারের সব সদস্যের উপর চেপে বসে। শেষকালে অসুস্থতার সময়ে চিকিৎসার ভার নিতে সক্ষম ছিলেন না তিনি বা তাঁর পরিবার। অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল। অনেকে নিজেদের সাধ্যমত সহায়তা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেনও। কিন্তু তার দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য তা প্রতুল ছিল না। তাই এক রকমের সুচিকিৎসার অভাবেই চলে যেতে হয় তাঁকে।

দূরবাসে থাকায় তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আর ছিল না। অসুস্থতার খবর আগেই পেয়েছিলাম। কতটা অসুস্থ তা বুঝতে পারিনি। বুঝতে বুঝতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজের ভার নিজে নিতে পারেন না, অন্যের ‘দানের’ দ্বারস্থ হতে হচ্ছে, এই মনোকষ্টে ভুগছেন, এই খবরও আমার কাছে অনেক দেরিতে আসে। আগে আসলেও যে খুব কিছু করতে পারতাম, তাও না। আমার মতো মানুষের সাধ্য আর কতখানি! দূরবাস থেকেই তাঁর জন্য কিছু টাকা ‘উপহার’ হিসেবে পাঠাতে ব্যবস্থা করি। যার মাধ্যমে ব্যবস্থা করি, তিনি আমার অন্য অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ব্যবস্থাপনা করেন। তাকে বলে দেই, আমার উপহার হিসেবে পাঠানো টাকা যেন তাঁর হাতে পৌঁছে। আমার উপহারের খবর তিনি জেনে যেতে পারেননি। জৈবিক দেহে প্রাণের সঞ্চার তখন অবশিষ্ট থাকলেও কোনো সংবাদ শুনে যাবার মতো চেতনা তাঁর ছিল না। তাই, ‘আমাদের উপহার দেয়ার মতো কেউ নেই, যারা করছেন সবাই দান-সদগাহ করছেন। এতটা দান-নির্ভর জীবন কাটাতে হবে কখনো ভাবিনি’, লোক মারফতে শোনা তাঁর এই দীর্ঘশ্বাস মোচনের জন্য কিছু করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই দীর্ঘশ্বাস নিয়েই তাকে নিজ প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের পথে রওনা হতে হয়।

পরকালের বিশ্বাসের কারণে অনেক মানুষ ধর্ম-কর্মে ব্রতী হন, কবি আহমদ আখতার তেমনটা ছিলেন। বিশ্বাস-প্রার্থনা-সৎকর্ম দিয়ে জীবনকে সাজাতে সচেষ্ট হন তেমন লোকেরা। যাপিত জীবনের ভুল ত্রুটির জন্য স্রষ্টার ক্ষমা-প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন। স্বর্গের বাগানে একটা স্থান পাবার অভিলাষ পোষণ করেন। তিনিও তাই করতেন। অন্য সকলের মতই কুণ্ঠিত, ভীত, আশাবাদী মন নিয়ে পরকালীন মুক্তির প্রত্যাশা করতেন। কিন্তু পার্থিব জীবনে তাঁর অপার্থিব বিশ্বাসের জন্য তিনি চড়া মূল্য দিয়েছিলেন। সে মূল্য না দিয়ে সহজতর পার্থিব জীবনের পথ বেছে নেয়ার সুযোগ তাঁর ছিল। তিনি সে পথ বেছে না নিয়ে, অন্যায়ের সাথে আপোস না করে, তাঁর প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের পথ বেছে নেন। স্বর্গের বাগানে প্রবেশের আশা অনেকেই করেন, তার জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকেন না। তিনি যেন পৃথিবীর জীবনে চড়া মূল্য দিয়ে স্বর্গের বাগানে নিজের জায়গা কেনার চেষ্টা করেছিলেন। আমার দৃষ্টিতে অনেক সাধারণের ভিড়ে তিনি এখানেই নিজেকে অসাধারণ করেন। আল্লাহ তাকে তাঁর কর্মের পুরস্কার দান করুন, আল্লাহ তাঁর উপরে সে বাগানের প্রতিশ্রুতি পূরণ করুন, যার জোর প্রত্যাশা তিনি করতেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

ফুলক্রুগের গোলে ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে দিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

জোড়া গোলে নাসেরকে ফাইনালে তুললেন রোনালদো

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

ফেরার আগে মুস্তাফিজের 'মেডেন'ও জেতাতে পারলনা চেন্নাইকে

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী