ইরানের হামলা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতায় কি চিড় ধরিয়ে দিল?

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম

গত ১৩ এপ্রিল বিশ্বের বুকে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের ‘বিষফোঁড়া’ এবং ‘সীমালঙ্ঘনকারী’ হিসেবে পরিচিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বুকে আঘাত করেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ইরান ও উত্তর কোরিয়া। এই দুই দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া তার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনেক হম্বিতম্বি এবং যুক্তরাষ্ট্রকে উড়িয়ে দেব, এমন নানা কথা বললেও তা শুধু তার বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, ইরান তার ঘোষণা মোতাবেক চিরশত্রু এবং মুসলমান নিধনকারী দেশ ইসরাইলকে ঠিকই আঘাত করেছে। প্রায় তিন শতাধিক ড্রোন ও ব্যালাস্টিক মিসাইল দিয়ে রাতভর ইসরাইলের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তার প্রতিশোধ নিয়েছে। যদিও ইসরাইল বলেছে, ইরানের বেশিরভাগ হামলা সে প্রতিহত করেছে। তবে এটা স্বীকার করেছে, ইরানের ৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারেনি। ইরান এই হামলা করেছে, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরাইলের হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) আল-কুদস ফোর্সের কমান্ডার মোহাম্মদ রেজাসহ সাত কর্মকর্তাসহ ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতিশ্রুতি প্রতিশোধ ‘ট্রু প্রমিজ’-এর আওতায়। তবে এটা শুধু ইরানের নিজস্ব প্রতিশোধের বিষয় নয়, এটাকে মুসলমানরা দেখছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের অব্যাহত গণহত্যার প্রতিশোধের নজির হিসেবে। কারণ, ইরানের এ হামলায় ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছে। ইসরাইলকে কেউ এভাবে হামলা করতে পারে, এমন অকল্পনীয় ঘটনা ইরান ঘটিয়ে মুসলিম জাহানে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করেছে। অন্যদিকে, ইসরাইলি বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত নিহত প্রায় ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনি শহীদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইসরাইল তার প্রধান মিত্ররাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সহায়তায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পারমানবিক শক্তিধর দেশে পরিণত এবং আকাশ ও স্থল পথে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার মতো রক্ষাবুহ্য তৈরি করার পরও ইরানের হামলা ঠেকাতে পারেনি। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। আকাশ পথে যেকোনো হামলা ঠেকানোর জন্য সে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় অ্যারো-৩ নামের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ ব্যবস্থা হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধ্বংস করে দিতে পারে। তারপরও ইরানের ছোড়া ৯টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারেনি। এগুলো ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এতে সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কেন এমন হলো, এ নিয়ে এখন সে অ্যারো-৩ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। এর অর্থ হলো, ইসরাইল প্রযুক্তি ও অস্ত্রে যতই শক্তিশালী ও আক্রমণের নিñিদ্র ব্যবস্থা গড়ে তুলুক না কেন, তা কাজে আসেনি। এটা নিশ্চিতভাবেই তার আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে।

দুই.
এবার আসি যার নেতৃত্বে গাজায় ইসরাইলি বাহিনী নির্বিচারে নিরীহ মুসলমান নারী, পুরুষ, শিশু হত্যা করছে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্মূলীকরণ অভিযান চালাচ্ছে, সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’র কথায়। ইসরাইলের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন এবং এখনো করেছেন আত্মআহমিকায় ভোগা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০২১ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনি ইংরেজী ও হিব্রু ভাষায় আত্মজীবনীমূলক ‘বিবি: মাই স্টোরি’ নামক ৬০০ পাতার একটি বই লেখেন। খ্যাতনামা বই সমালোচক জেন আইজনারও নেতানিয়াহুকে বুঝতে পাশাপাশি দুটি বই রাখেন। একটি ‘বিবি: মাই স্টোরি’, অন্যটি ইসরাইলি সাংবাদিক অ্যানশেল ফেফারের ‘বিবি: দ্য টারব্যুলেন্ট লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’। গার্ডিয়ানে তিনি লিখেন, বই দুটি পড়ে তিনি একটি বিষয় বঝতে পেরেছেন, নিজের গুণকীর্তনে নেতানিয়াহুর মেধা অতুলনীয়। তিনি এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন যে, তার তুলনা তিনি নিজেই। যেমন, তিনি অতুলনীয় রাষ্ট্রনেতা, তার বাবা বেনিজয়ন অতুলনীয়, ভাই জোনাথন অতুলনীয়, তার তৃতীয় স্ত্রী সারাহর তুলনা স্বর্গমর্ত্য কোথাও নেই। তিনি লেখেন, একদিক থেকে নেতানিয়াহু অতুলনীয়ই বটে। তাকে বলা হয়, ইসরাইলের প্রথম ‘টিভি প্রধানমন্ত্রী’। জনসমক্ষে যেন তার ভাবভঙ্গি ঠিক থাকে, এজন্য তিনি অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি নিয়মিত মেকআপ করেন। আলোকচিত্রী ও ভিডিওগ্রাহকদের বলে রাখেন, কেবল যে অ্যাঙ্গেলে তাকে ভালো দেখায়, সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই ছবি তোলা হয় এবং তার উপরের ঠোঁটের কাটা দাগটি যেন দেখা না যায়। যখন ইসরাইলের অন্যসব নেতারা ফুলহাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে সহজ ভঙ্গিতে ক্যামেরার সামনে বসে যেতে পারেন, নেতানিয়াহু তখন অতি মূল্যবান স্যুট পরে চোস্ত ভঙ্গিতে বসেন। বিলাসব্যসনের প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ্য এবং চিরকালীন। নিজেকে তিনি চার্চিলের ইসরাইলি সংস্করণ বলে দাবি করেন। তিনি মনে করেন, তিনিই ইরানের বিপজ্জনক হামলা থেকে সুরক্ষা দানকারী, তিনিই সারাবিশ্বের ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ত্রাণকর্তা। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ৭৫ বছর বয়সী রাষ্ট্র ইসরাইল এ সময়ের মতো আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। দেশটির গণতন্ত্র হুমকির মুখে, জাতি হিসেবে এত বিভেদ আগে কখনো ছিল না। ইসরাইল যে ক্রমশ ডুবছে, তা এখন দৃশ্যমান। কয়েক মাস আগে বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকায়, ‘দ্য নেতানিয়াহু ডকট্রিন: হাউ ইসরাইলস লঙ্গেস্ট সার্ভিং লিডার রিশেপড দ্য কান্ট্রি ইন হিজ ইমেজ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, নেতানিয়াহু দুর্গরাষ্ট্র ইসরাইল গড়েছেন। তাকে তার চাটুকাররা ‘মিস্টার সিকিউরিটি’ বলে সম্বোধন করে। অনেকে তাকে ‘কিং বিবি’ বলে থাকে। তার বন্ধু বেনি যিফার বলেন, ‘আমি বিবিকে দেখি, আর ভাবি, আমাদের প্রতিদিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। কারণ, বিবি আমাদের কাছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে আসা উপহার।’ নেতানিয়াহুর আমলেই ইসরাইল আয়রন ডোম গড়েছিল গাজা উপত্যকা থেকে ছোড়া রকেট হামলা থেকে সুরক্ষা পেতে। গাজা সীমান্তে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কাঁটাতারের বেড়া, মাটির তলদেশে সেন্সর, দূর নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ও সর্বত্র ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন, কেবল প্রযুক্তি আর অস্ত্র দিয়েই ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ করা যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র দিয়ে ক্রমাগত গণহত্যা চালিয়েও হামাস কিংবা ফিলিস্তিনিদের সাথে তাকে এখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মাসের পর মাস গণহত্যা চালিয়েও ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে পারছে না। নেতানিয়াহু কখনোই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন না। ২০১৯ সালে ইসরাইল রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কখনই হবে না। মানুষ যেমনটি বলছে, তেমনটি তো নয়ই। এটা কখনই হবে না।’ তিনি সবসময়ই বলেন, ‘ইহুদিরা আরবদের জমি দখল করেনি, বরং আরবরাই ইহুদিদের জমি দখল করেছে। ইহুদিরাই এ অঞ্চলের প্রকৃত বাসিন্দা। আরবরা উপনিবেশ করেছে।’ তিনি নিজেকে, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের প্রতিনিধি মনে করেন। তার মতে, ‘ইহুদিরা আলোর সন্তান, ফিলিস্তিনিরা অন্ধকারের।’ এ কারণে তিনি গাজার সঙ্গে অন্তহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার বাবার মতো একরোখা এবং কুটিল চরিত্রের। বাবাকে তিনি আদর্শ মনে করেন। তার বাবা বেনজিয়ন ছিলেন জায়নবাদী, অতি ডানপন্থী। তিনি মনে করতেন, ‘নাৎসিদের ধারাবাহিকতার প্রতীক হলো ফিলিস্তিনিরা। তারা শয়তানের আধার।’ নেতানিয়াহু তার বাবার এই মনোভাব নিয়ে বড় হয়েছেন। তিনিই ইরানের বিপজ্জনক হামলা থেকে সুরক্ষা দানকারী, তিনিই সারাবিশ্বের ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ত্রাণকর্তা। অথচ শেষ পর্যন্ত তিনি ইরানের হামলা ঠেকাতে পারেননি।

তিন.
ইসরাইলের উপর ইরানের ‘ট্রু প্রমিজ’ হামলা বিশ্বের চলমান গতিপথ বদলে দিতে পারে। ইতোমধ্যে তার আভাস পাওয়া গেছে। কারণ, যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের গায়ে ফুলের টোকা লাগতে দিতে চায় না। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে যক্ষের ধনের মতো সবসময় আগলে রাখে, ইরানের হামলার পর সেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে বলেছে, আমরা তোমার পাশে আছি, তবে ইরানের উপর পাল্টা হামলায় আমরা তোমার সাথে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এই পিছুহটার কারণ কি? কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি ক্ষয়ীষ্ণু রাষ্ট্র। বিশ্বে তার একাধিপত্য এখন আর নেই। যেখানে যায়, সেখান থেকে তাকে পরাস্ত বা অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। অন্যদিকে, তার নিষেধাজ্ঞা তেমন কোনো কাজে আসছে না। যে দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তার পাশে বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশ পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশও তার নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করে না। ইরান, উত্তর কোরিয়াসহ যেসব দেশে সে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তারা তো আরও তোয়াক্কা করছে না। ইসরাইলে হামলা চালিয়ে ইরান তা বুঝিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার অবস্থান বুঝতে পেরে এখন ইসরাইলকেও ইরানের উপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে নিষেধ করেছে। বলা যায়, ইসরাইলের উপর হামলা চালিয়ে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছে, বিশ্বে তোমার মোড়লগিরির দিন শেষ। ইরানের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোর যতই রাগ, ক্ষোভ থাকুক না কেন, তারাও এ হামলার নিন্দা করেনি। চুপ থেকেছে। তাদের এই চুপ থাকাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নীরব আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। এই আতঙ্ক ইসরাইলের মধ্যেও সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির চেয়ে ভয়ংকর। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যেমন রয়েছে, তেমনি হারানোরও অনেক কিছু রয়েছে। দেশগুলো তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোতে ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হবে। তার এখন ‘কূল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নরম সুরে বলেছে, ইরানকে বোঝানোর জন্য। সে যাতে আর কোনো হামলা-টামলা না করে। গত সোমবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আবদুল্লাহহিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি বলেছেন, চীন বিশ্বাস করে, ইরান তার সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা রক্ষা করে যেকোনো পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে সক্ষম। মধ্যপ্রাচ্যে আরও উত্তেজনা এড়াতেও সক্ষম। ওয়াং আরও বলেছেন, আঞ্চলিক ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে লক্ষ্যবস্তু না করার বিষয়ে ইরানোর জোরালো অবস্থান প্রশংসনীয়। ইরানও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে বলেছে, সে যেন এ ব্যাপারে নাক না গলায়, গলালে তার ঘাঁটি গুড়িয়ে দেবে। ইসরাইলকে বলে দিয়েছে, সে যদি পাল্টা হামলা না করে, তাহলে সেও হামলা করবে না। পাশাপাশি, জাতিসংঘকে তার হামলার কারণ সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছে। ফলে স্পষ্টতই ইরান এখন সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। গাজায় কেন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ও গণহত্যা শুরু করেছে তার কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলেছেন, নেতানিয়াহু ইসরাইলে গণতন্ত্রকে পেছনে ফেলে একনায়ক হয়ে উঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দেশটির বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যেভাবে বিচার বিভাগ চলছিল সেভাবে আর চলতে দিতে চান না। এটাই তাকে সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে তার দেশের ভেতরে প্রচ- বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছেন। তার মসনদ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সে ইসরাইলিদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য গাজায় যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে দিয়েছে। যদিও অনেক সাধারণ ইসরাইলি এটি সমর্থন করে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের কট্টর সমর্থক হলেও নেতানিয়াহুর সাথে এক ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অন্য প্রেসিডেন্টদের সাথে সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। অ্যারন ডেভিড মিলারের ‘দ্য মাচ টু প্রমিজড ল্যান্ড’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন লিখেছে, ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহুর সাথে প্রথম বৈঠকের পরপরই বিল ক্লিন্টন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। সে সময় তিনি তার সহযোগীদের বলেছিলেন, ‘সে নিজেকে কী মনে করে? কে সুপারপাওয়ার?’ বারাক ওবামার সাথে তার সম্পর্ক আরও খারাপ ছিল। ২০১৫ সালে নেতানিয়াহু কংগ্রেসে এক ভাষণে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে চুক্তি করায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। এতে ওবামা প্রশাসন খুবই অসন্তুষ্ট হয়। নেতানিয়াহুর এ সফরকে অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বলা হয়, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়েছেন। নেতানিয়াহু তার স্মৃতিকথায় নিজেই লিখেছেন, ওভাল অফিসে তিনি ওবামার সাথে দেখা করতে যান। সৌজন্যমূলক কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ওবামা তার ওপর চড়াও হন। ওবামা বলেছিলেন, ‘বিবি, আমি যা বলেছি তাই। এই মুহূর্তে ১৯৬৭ সালের সীমারেখার বাইরে যে নির্মাণকাজ চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। একটা ইটও বসানো যাবে না। নেতানিয়াহু তখন বলেছিলেন, তারা শর্তহীনভাবে ফিলিস্তিনের সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের পর জেরুজালেমের পূর্বাংশের অর্ধেক ইসরাইল দখল করে নেয়। ২০১১ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি সবার সামনে ওবামাকে বলেছিলেন, ‘আমি নেতানিয়াহুকে সহ্য করতে পারি না। ও একটা মিথ্যুক।’ জবাবে ওবামা বলেন, ‘আপনি ওকে নিয়ে বিরক্ত। আর আমাকে ওকে নিয়েই কাজ করতে হয় বেশি। অন্যদিকে, নেতানিয়াহুর সাথে ট্রাম্পের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনার নতুন নীলনকশা উপস্থাপন করেন। নেতানিয়াহুর সেই প্রস্তাব খুবই পছন্দ হয়। তিনি বলেন, এই শতকের সবচেয়ে ভাল সুযোগ এসেছে। তবে ফিলিস্তিনিরা প্রস্তাবকে একপক্ষীয় বলে অভিযোগ করে। ফলে এই পরিকল্পনা যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল, সেভাবেই পড়ে রয়েছে। অবশ্য ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে অপছন্দ করা শুরু করেন, যখন বাইডেন বিজয়ী হওয়ার পর নেতানিয়াহু তাকে অভিনন্দন জানান। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে অবিশ্বস্ত বলে আখ্যায়িত করেন।

চার.
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরাইলে ইরানের হামলার পর পরবর্তী পরিস্থিতি কি হবে? যুদ্ধ কি মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে? নাকি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য জো বাইডেনের সমালোচনা করে বলেছেন, বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ঠিকমতো দুই লাইন বলতে পারেন না। এলোমেলো করে ফেলেন। সিঁড়ি খুঁজতে গিয়ে পান না। যদিও ট্রাম্পের এসব সমালোচনা নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে সামনে রেখে বাইডেনকে আক্রমণ করার ইস্যু। তবে ইরানের হামলার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে গত সোমবার ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন নেতানিয়াহু। ইরানে শিঘ্রই পাল্টা হামলা চালানোর বিষয়ে মন্ত্রীসভা ঐক্যমত পোষণ করেছে। তবে কখন ও কীভাবে হামলা চালানো হবে, তা নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, আগে থেকেই গাজায় যুদ্ধ চলায় ইসরাইলের নতুন হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে ইসরাইলকে সংযত থাকার জন্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা আহ্বান জানিয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে ইসরাইল ইরানের ভূখ-ের বাইরে তার বিভিন্ন সামরিক বাহিনী ও ইরানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর ‘সীমিত পরিসরে’ হামলা চালাতে পারে। যদি বড় ধরনের কোনো আঞ্চলিক বা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে তার জন্য একমাত্র দায়ী হবে ইসরাইল। কারণ, এ যুদ্ধের সূচনাকারী হবে সে। আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে ইসরাইল ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করেছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরাইল নিজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ১ এপ্রিল ইরানী কনস্যুলেটে হামলা চালিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ইসরাইল এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, যাতে মনে হতে পারে, ইরান তার উপর সশস্ত্র হামলা চালাতে যাচ্ছিল, কিংবা হামলার জন্য কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী পাঠাচ্ছিল। ইসরাইল হামলার আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও জানায়নি। অথচ জাতিসংঘের সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা জরুরি ছিল। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদের অধীন অন্যকোনো দেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগ নিষিদ্ধ। ইসরাইল ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে তা লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য, ইহুদীরা জাতিগতভাবেই ‘সীমালঙ্ঘনকারী’ ও ‘অভিশপ্ত জাতি’ হিসেবে পরিচিত। তারা কখন কি করে, তা আগাম বলা মুশকিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যতই ইসরাইলকে আগলে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, সে বড় ধরনের যুদ্ধ বাঁধানোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে চাইলে তা ঠেকানোর মতো শক্তিধর দেশ এবং বলয় এখন রয়েছে। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রও বোঝে। এ পরিস্থিতিতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভেদাভেদ ভুলে মুসলমানদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরাইল খুব বেশিদূর এগুতে পারবে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

কলাপাড়ায় পিকআপ-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষ, গুরুতর আহত ২

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

আইপিডিআই ফাউন্ডেশন হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে : স্পিকার

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

কুড়িগ্রামে ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, যুবকের কারাদণ্ড

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

মানবপাচার-অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, সবকিছু বিবেচনায় নেবে ডিবি

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

হারাম রিজিক খেয়ে ইবাদত কবুল হবেনা-পীর সাহেব বায়তুশ শরফ আল্লামা আব্দুল হাই নদবী

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

মোদির ভারতে এবার মসজিদের ভেতরে ইমামকে পিটিয়ে হত্যা, ক্ষোভ সর্বত্র

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

ফরিদপুরের শ্রমিক হত্যার দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে : প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

শিক্ষকরাই আগামী দিনের স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর : শিল্পমন্ত্রী

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

৫ মে হেফাজতের জাতীয় শিক্ষা সেমিনার, সফল করার লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

ইরানি নারীদের অনুর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

বঞ্চিত মেহনতী-শ্রমিক জনতাই ফ্যাসিবাদী এই সরকারের পতন ঘটাবে- এবি পার্টির আলোচনা সভায় বক্তারা

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

টেকনাফে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৬

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

চলমান আন্দোলন বিএনপির একার সংগ্রাম নয়, সকলের : মির্জা ফখরুল

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

হাসপাতালে পৌঁছেছেন বেগম খালেদা জিয়া

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

রাজশাহীর মোহনপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় বাইক আরোহী নিহত

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী

ধান উৎপাদনে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে : পরিবেশমন্ত্রী

রাজশাহীর বাঘায় স্ত্রীর লাঠির আঘাতে স্বামীর মৃত্যু

রাজশাহীর বাঘায় স্ত্রীর লাঠির আঘাতে স্বামীর মৃত্যু

রাজশাহীতে বাস শ্রমিকদের চারকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিক্ষোভ

রাজশাহীতে বাস শ্রমিকদের চারকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিক্ষোভ

চকলেটের লোভ দেখিয়ে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, আটক-১

চকলেটের লোভ দেখিয়ে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, আটক-১