ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়ছে?

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৬ এএম

ভারতে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে হিন্দু ভোটারদের সর্মথন নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদীরা। গত এক দশকে ভারতীয় গণতন্ত্রের সেক্যুলার ভাবধারা এবং সাংবিধানিক অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়েছে। ভূরাজনৈতিক বিভাজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে কৌশলগত সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও শতকোটি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন কার্যত একটি হাইব্রিড রিজিমে পরিনত হয়েছে। এক-এগারোর বিশেষ সরকার এবং পরবর্তী সরকার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একদলীয় শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনেক আগেই হাইব্রিড রিজিমে পরিনত করেছিল। মূলত ভারতের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক এজেন্ডায় বাংলাদেশে এই আধিপত্যবাদী নীতি কৌশলের বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে নিরপেক্ষ, গণতন্ত্রপন্থী ও আধিপত্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। ইউক্রেন যুদ্ধ ও হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের মতো অতি সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর সময়ে ভূরাজনীতির খেলায় রাশিয়া-চীন ও ইরানের কাছে প্রায় পর্যুদস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় গণতন্ত্রের ফ্যাসিবাদী বিবর্তন, মানবাধিকার ও মুসলিম গণহত্যার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কার্যত নীরব পথ বেছে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন জেনোসাইড ওয়াচের পরিচালক গ্রেগরি স্ট্যান্টন গত কয়েক বছর ধরে ভারতের ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম গণহত্যার প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশ কয়েকবার সতর্কবার্তা জারি করেছেন। নব্বই দশকের মাঝমাঝিতে রুয়ান্ডায় হুতো ও তুতসিদের সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক সংঘাত ও গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার আগেও গ্রেগরি স্ট্যান্টন তার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তার সেই ভবিষ্যদ্বানীকে নির্ভুল প্রমাণ করে সেখানে হুতোদের হাতে কয়েক লাখ তুতসির প্রাণহানি ঘটেছিল। মুসলিম রাষ্ট্রের বাইরে কোনো একক রাষ্ট্রে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ভারতে। মূলত পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে আগত সুলতান-মুঘলদের হাত ধরে মুসলমানরাই ভারত নামক বিশাল আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিল। সেই ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা এখন ভারতকে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে কিংবা মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করার নোংরা রাজনীতির খেলা খেলছে। রাম মন্দিরের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে ৫শ’ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে রামমন্দির নির্মাণ, মুঘল-মুসলমানদের ইতিহাস ও স্মৃতি বিজড়িত অসংখ্য স্থান ও স্থাপনার নাম পরিনবর্তন, গো রক্ষার নামে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মুসলমানদের হত্যা করাসহ নানা অজুহাতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সৃষ্টির ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। ভারতে নির্বাচনের আগে ভোটের সমীকরণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুভোটারদের মধ্যে একটি মুসলিমবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলতে সেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদকে তুঙ্গে তোলা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় হিন্দুত্ববাদীরা সুবিধা করতে না পারায় তারা এখানে বরাবরই ভিন্নতর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক এজেন্ডা গ্রহণ করে থাকে। প্রিয়া সাহারা যাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর, তারা কখনো হাল ছেড়ে দেয়নি। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত তাদের কাছে অসহ্য লাগবে, এটাই স্বাভাবিক।

গত শুক্রবার ভারতে ৭ দফা লোকসভা ভোট গ্রহণের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষী উত্তেজনা উস্কে দিতে দেখা যাচ্ছে। সেই রেশ কি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে? ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরুর দিনে ফরিদপুরের হিন্দু জনসংখ্যাবহুল এলাকায় হিন্দু মন্দিরে আগুন এবং মুসলমান দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। ভারতের নির্বাচনের আগে কিছু হিন্দুত্ববাদীদের জন্য সাম্প্রদায়িক কনসিকোয়েন্স খুব দরকার হয়ে পড়ে। কয়েক মাস আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় এক রাতে তিনটি হিন্দু মন্দিরের ১০টি প্রতিমা ভাঙ্গচুরের ঘটনা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল। কিন্তু বাঁধ সেধেছে আধুনিক প্রযুক্তি। আলফাডাঙ্গার কুশুমদি মহল্লার কেন্দ্রীয় হরিমন্দির ও শ্রীবিষ্ণু পাগলে মন্দিরের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, গভীর রাতে এক যুবক সন্দেহজনকভাবে মন্দিরে প্রবেশ করে বেরিয়ে আসছে। মন্দিরের মূর্তি ভাঙ্গার মামলা গ্রেফতার হওয়ার পর সনাতন মালো নামের সেই যুবক পুলিশের কাছে প্রতিমা ভাঙ্গার কথা স্বীকার করেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গার ঘটনায় হিন্দু যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সাবোট্যাজ করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে কোনো মহলের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ বলে সহজেই অনুমান করা যায়। ২০১৬ সালের আগস্ট ঢাকার টঙ্গি বাজারে শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দিরে কতিপয় যুবক হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙ্গচুর ও পুরোহিতকে মারধরের চেষ্টার অভিযোগে আটক ব্যক্তিরা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মন্দিরে হামলা চালানো যুবকদের নেতৃত্বে থাকা যুবক র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর জানা যায়, তার নাম সঞ্জয় কুমার সাহা। সে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সাহাপাড়া গ্রামের গণেশচন্দ্র সাহা এবং শুভা রানী সাহার পুত্র। ২০২২ সালের মে মাসে খুলনার ফুলতলা এম এম কলেজ সার্বজনীন পূজা মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গচুর করে পালানোর সময় স্থানীয়রা সন্দেহ করে এক যুবককে আটক করে তার ব্যাগ তল্লাশি করে ব্যাগে ভাঙ্গা প্রতিমার মাথার অংশ উদ্ধার করা হয়। তার নাম অনিক মন্ডল। সে অভয়নগর উপজেলার ধুলগ্রামের অসীম মন্ডলের পুত্র। বাংলাদেশের মানুষকে হিন্দু বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতেই হিন্দু যুবকদের মুসলমান সেজে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গার স্যাবোটাজের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রিয়া সাহা নামের এক এনজিও কর্মী ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউজে গিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু ভারতে পালিয়ে গেছে বলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ করেছিলেন। এ থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিষবাষ্প ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের একটি আন্তর্জাতিক যোগসূত্র চিহ্নিত করা যায়। গত জানুয়ারীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে মুসলমান নামধারি দুটি ফেইক ই-মেইল আইডি থেকে বোমা মেরে রামমন্দির ধ্বংস এবং মূখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ ও এসটিএফ প্রধান অমিতাভ যশকে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া ব্যক্তিরা মুসলমান পরিচয় ব্যবহার করেছিল। পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানে আটক হুমকি দাতা দুই ব্যক্তির নাম তাহার সিং এবং ওমপ্রকাশ মিশ্র। তারা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব প্যারামেডিকেলের কর্মী এবং ভারতীয় কিষাণ মঞ্চের সদস্য জনৈক দেবেন্দ্র কুমার তিউয়ারির নির্দেশে মুসলমান সেজে বোমা মেরে রামমন্দির উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল বলে স্পেশাল টাস্কফোর্সের পুলিশ জানিয়েছে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বিভক্তি-বৈরীতা উস্কে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল গ্রহণ করে থাকে। এ কারণে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই অতি কৌশলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয়া হয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে ভারতে সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তুলে ধরা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টর্স অফ ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স এর প্রধান ড্যান কোটসের দেয়া প্রতিবেদনে নির্বাচনের আগে এবং পরে ভারতের মুসলমানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর দমন-পীড়ন ও দাঙ্গার আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়। এসব প্রতিবেদন নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও সম্ভাব্য দাঙ্গা ও নাশকতা প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও মোদীর দল বিজেপি হিন্দু-মুসলমান বিভেদ-বৈরীতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করেছিল। এরপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনের আগে হিন্দুত্ববাদীরা ইসলামোফোবিয়া ও মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গার উস্কানি দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে একটি বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদে পরিনত করেছে। সেখানে মুসলিমবিদ্বেষী নৃশংসতা একটি সাধারণ ঘটনায় পরিনত হয়েছে। প্রায় ২৫ কোটি মুসলমানকে কোনঠাসা ও নির্মূল করার দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডা সামনে রেখে সেক্যুলার ভারতকে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিনত করতে চায় তারা। তাদের এই অপরিনামদর্শী এজেন্ডা ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ভারতের রাজনৈতিক সংহতি ও রাষ্ট্রীয় অখ-তা সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। চীন বা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ভারত ক্রমেই দুর্বল ও বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। প্রতিবেশীদের সাথে দূরত্ব ও বৈরীতা ঘুচিয়ে সহযোগিতামূলক একটি সর্ম্পক সৃষ্টির লক্ষ্য সামনে রেখে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নীতির কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এ কারণে কোনো প্রতিবেশীর সাথেই ভারত আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন দোকলামে, লাদাখে এবং অরুণাচলে ভারত সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামরিক- বেসামরিকস্থাপনা নির্মাণ প্রচেষ্টায় গত এক দশকে কয়েকবার চীনের সাথে সীমান্ত যুদ্ধের মুখোমুখী হয় ভারত। এসব যুদ্ধের সময় ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মত ক্ষুদ্র প্রতিবেশীও ভারতের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখা গেছে। চীনের প্রভাব কাজে লাগিয়ে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের মত দেশের নেতারাও ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পিছপা হয়নি। এক্ষেত্রে, উপমহাদেশে বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম। ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উস্কানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ যেমন কথা বলেনা, তেমনি সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশী হত্যা, ধরে নিয়ে নির্যাতন ও অনুপ্রবেশের ঘটনার পরও বিজিবিকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। দেশের নিরাপত্তায় এটা সংশ্লিষ্টদের অমার্জনীয় দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্ত ।

পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরীতা বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারলেও দেশের সরকারের অবস্থান যাই হোক, জনগণের সমর্থন কোন দিকে তা সহজেই অনুমেয়। ভারতে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদ শুধু প্রতিবেশিদেরকেই আক্রান্ত করেনা, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ কারণেই বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্বশাসন লঙ্ঘনের পর পশ্চিমা মিত্ররাও তার বিরোধিতা করেছে। একইভাবে মুসলমানদের টার্গেট করে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে ভারতের মুসলমানরা তো বটেই আন্তর্জাতিক সব পক্ষকেই এর সম্ভাব্য বিপদ ও হুমকি সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। বিজেপি সরকারের এসব সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা ও মানবাধিকারবিরোধী কর্মকা- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে আক্রান্ত করলেও বাংলাদেশ সরকার যেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বশংবদ ও আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে চলেছে। কোটি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য দেয়া, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গো রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক হত্যাকা-, দিল্লী দাঙ্গায় শত শত মানুষের প্রাণহানীর মত ঘটনায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটলেও সরকারের নীরবতা মানুষকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তবে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৃশংসতা কখনো বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করেনি। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী মহলের গোপণ ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হিন্দু মন্দির পাহারা দিতে দেখা গেছে। এবার ভারতের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে হিন্দুত্ববাদের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফরিদপুরের মধুখালিতে মন্দিরে রহস্যজনক অগ্নিকা-ের ঘটনার পর সন্দেহবশত দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা আমাদেরকে ভারতের গুজরাট, দিল্লী, আহমেদাবাদে দাঙ্গার নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কোনো যাচাই-বাছাই, তদন্ত ও বিচারের ন্যুনতম অনুসরণ ছাড়া পিটিয়ে মানুষ হত্যার এমন ঘটনা আমাদের সমাজে কল্পনা করা যায় না। এর পেছনে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের এজেন্টদের সুগভীর ষড়যন্ত্রের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের লেখা পোস্ট ও মন্তব্য থেকে তা অনেকটা বোঝা যাচ্ছে। শতকরা ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার কিছু লোকের এমন উগ্র সাম্প্রদায়িক ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। ওরা জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে নৃশংস কায়দায় নিরীহ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে, ফরিদপুর দিয়ে শুরু, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে যে অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তার বীজ সমূলে উৎপাটন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভিপ্রায়কে অস্ত্রের জোরে দাবিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যেভাবে খাদের কিনারে ঠেলে দেয়া হয়েছে, এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের উস্কানি ও হুমকি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। সন্দেহবশত: পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনার পর প্রকাশ্য উল্লাস এবং এর চেয়ে বড় ধরণের দাঙ্গা-হত্যার হুমকি দাতাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। এ ধরণের যেকোনো আশঙ্কার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে তা উগ্রপন্থীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথকে সহজ করে দিতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনায় চালকসহ আহত ৪ : পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনায় চালকসহ আহত ৪ : পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন

সড়কের দু’পাশে শত শত গাছের বেহাল দশা : উত্তরাঞ্চলে পেরেকের জ্বালায় মরছে গাছ

সড়কের দু’পাশে শত শত গাছের বেহাল দশা : উত্তরাঞ্চলে পেরেকের জ্বালায় মরছে গাছ

ভিআইপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ : চিনি রেখে গাড়ি ছেড়ে দিলো বিজিবি

ভিআইপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ : চিনি রেখে গাড়ি ছেড়ে দিলো বিজিবি

অবৈধ পথে ইউরোপের মরণ যাত্রায় তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: অবশেষে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা

অবৈধ পথে ইউরোপের মরণ যাত্রায় তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবি: অবশেষে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা

ঘুরে দাঁড়িয়েও জিম্বাবুয়ে অলআউট ১২৪ রানে

ঘুরে দাঁড়িয়েও জিম্বাবুয়ে অলআউট ১২৪ রানে

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি সিলেট জেলা যুবদলের

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি সিলেট জেলা যুবদলের

“তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে” - মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন

“তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে” - মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন

মায়ের সাথে পাঁচ তারকা হোটেলে নৈশভোজের সুযোগ ফুডপ্যান্ডার ‘সেলেব্রে-ইট মাদার্স ডে’ ক্যাম্পেইন

মায়ের সাথে পাঁচ তারকা হোটেলে নৈশভোজের সুযোগ ফুডপ্যান্ডার ‘সেলেব্রে-ইট মাদার্স ডে’ ক্যাম্পেইন

ট্রেনে কাল থেকে গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া

ট্রেনে কাল থেকে গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্ত ও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্ত ও সহ্য করবো না

বৃষ্টি বাঁধার আগে আউট লিটন,ধীরে শুরু বাংলাদেশের

বৃষ্টি বাঁধার আগে আউট লিটন,ধীরে শুরু বাংলাদেশের

দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ও ৫০-৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিসের

দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ও ৫০-৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিসের

২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার গান্ধী পরিবারের কোনো প্রার্থী নেই আমেথিতে

২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার গান্ধী পরিবারের কোনো প্রার্থী নেই আমেথিতে

নাইজারে মার্কিন বাহিনীর বিমান ঘাঁটিতে রুশ সেনা

নাইজারে মার্কিন বাহিনীর বিমান ঘাঁটিতে রুশ সেনা

কৃষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

কৃষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

উচ্চ তাপপ্রবাহ মানুষেরই কৃতকর্মের ফল

উচ্চ তাপপ্রবাহ মানুষেরই কৃতকর্মের ফল

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে

সৈয়দ আহমদ শহিদ বেরলভী (র.) ইসলামি আন্দোলনের আপোসহীন মডেল -আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

সৈয়দ আহমদ শহিদ বেরলভী (র.) ইসলামি আন্দোলনের আপোসহীন মডেল -আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

অস্ট্রেলিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত

অস্ট্রেলিয়ার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত

নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলেরা

নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে হতাশ জেলেরা