আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে
০৪ মে ২০২৪, ১২:৩১ এএম | আপডেট: ০৪ মে ২০২৪, ১২:৩১ এএম
গত এপ্রিলজুড়ে শুরু হওয়া তাপদাহ স্মরণকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আবহওয়াবিদরা বলেছেন, গত প্রায় ৭৬ বছরের মধ্যে এমন দীর্ঘ তাপপ্রবাহ দেখা যায়নি। দেশের সর্বত্র মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে জনজীবন থেকে শুরু করে পরিবেশ বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে। নগরে ও গ্রামের মানুষের মধ্যে হাঁসফাঁস পরিস্থিতি চলছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে, খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের প্রচ- তাপের মধ্যে কাজ করা ছাড়া গতি নেই। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, এলনিনোর তীব্র প্রভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাপদাহ এক মহাদুর্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বে বহুবছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক ও সচেতন হওয়ার তাকিদ দিচ্ছেন। এ নিয়ে করণীয় এবং যেসব দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, সেগুলোতে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন রোধে তহবিলও গঠন করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে তা দেয়াও হচ্ছে। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন থেকে উন্নত দেশগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে মরুর দেশ সউদী আরব ও আরব আমিরাতে বন্যা দেখা দিয়েছে, যা অকল্পনীয় এবং বিগত শত বছরের মধ্যে এমনটি দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশেও বন্যা দেখা দিয়েছে। মাঝে মাঝেই অস্ট্রেলিয়া, কানাডার শত শত মাইল জুড়ে থাকা বন-জঙ্গল পুড়ে ছাই হতে দেখা যায়। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তনের ক্ষয়-ক্ষতি উন্নত বিশ্ব কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয় না। ক্ষতি রোধে আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া গতি নেই।
গতকাল একটি ইংরেজী দৈনিকে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত এক সেমিনারে গবেষকরা বলেছেন, বিশ্ব যখন দেড় ডিগ্রি বৃদ্ধি পাওয়া তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম করছে, তখন ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে প্রায় ৬ ডিগ্রী হয়ে গেছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং নগর অবকাঠামোর ভয়াবহ ক্ষতি করছে। এটা আমাদের উন্নয়নকে থমকে দেবে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হিটস্ট্রোকে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। তাপদাহের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কলকারখানায় উৎপাদন কমছে। গড়ে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার সমপরিমান উৎপাদনশীলতা কমে গেছে। চলমান তাপদাহে কৃষিখাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তাপদাহের কারণে পোল্ট্রি ও খামার শিল্পে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীসহ দেশের কিছু অঞ্চলে বৃষ্টি হলেও পরিবেশ শীতল করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আবহাওয়াবিদদের মতে, এপ্রিলে সাধারণ বৃষ্টিপাতের তুলনায় প্রায় ৮০ ভাগ কম বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চলমান তাপদাহ চলতি মাসজুড়েও বয়ে যেতে পারে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি, উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এ এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণের জন্য মানুষই দায়ী। আবহাওয়া অনুকূল রাখার জন্য যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন, তা নিয়ে সরকারসহ কেউই সচেতন নয়। তাপমাত্রা স্বাভাবিক, পরিবেশ শীতল রাখা ও বৃষ্টিপাতের জন্য যে ধরনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন, তা ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। নগর তো বটেই দেশজুড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ ও পাহাড় নিধন, খোলা মাঠ ও জলাশয় ভরাট করে ধ্বংস করে দেয়া, পানি ও বায়ূ দূষণকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, নগর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। একটি দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বন থাকা প্রয়োজন। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে দেশে এখন বনের পরিমান ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কুফল কতটা ভয়াবহ তা চলমান দাবদাহ ও আবহাওয়া বিরূপ হওয়া থেকেই বোঝা যাচ্ছে। রাজধানীতে সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকা- করতে গিয়ে যেভাবে বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে খোলা মাঠ, জলাশয়, লেক ভরাট করে ইমারত গড়ে তোলা হচ্ছে। গবেষকরা বলেছেন, হাইরাইজ ভবনে কাচের দেয়াল ব্যবহার করার ফলে রাজধানীতে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে পরিবেশ শীতল রাখার জন্য যে পরিমান গাছপালা, খোলা জায়গা ও পানির আধার থাকা প্রয়োজন, তা নেই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম শহরে উড়াল সড়কের র্যাম্প নামানোর জন্য শতবর্ষী অনেক বৃক্ষ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা আপাতত স্থগিত করা হয়। সেখানে পাহাড় নিধন নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছ। শুধু চট্টগ্রাম নয়, রাজধানীতে কোনো ধরনের বিচারবিশ্লেষণ ছাড়াই উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। সবুজ পাহাড় ও বনাঞ্চলের জন্য সিলেটের সুনাম রয়েছে। সেখানেও নির্বিচারে বৃক্ষ ও পাহাড় নিধন করা হচ্ছে। এসব কাজে যেমন প্রভাবশালীরা জড়িত, তেমনি সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা জড়িত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশ¯্র বাহিনীও তাদের উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে বৃক্ষ নিধন করছে। দেশজুড়ে যখন বনাঞ্চল ও পাহাড় নিধনযজ্ঞ চলে, তখন পরিবেশের স্থির থাকার কোনো কারণ নেই। তা বিরূপ হয়ে উঠবেই, যার ফলাফল চলমান তাপদাহ থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
দেশে জলবায়ুর পরিবর্তন অনেক আগে থেকেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অকাল বন্যা, উপূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ বহু বছর ধরেই চলছে। এর প্রতিকারের জন্য পরিবেশের যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার তা না করে, উল্টো ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে যদি এখনও সচেতন না হওয়া হয়, তাহলে অদূরভবিষ্যতে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। বাসপোযোগী স্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশই যদি না থাকে, তাহলে মানুষ টিকে থাকবে কিভাবে? পরিবেশ বিপর্যয়গত কারণে মানুষ যদি সুস্থ না থাকে, তখন দেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। দেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিক, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে ঠিকই, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এসব প্রকল্পও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। কাজেই সরকারকে পরিবেশ সুরক্ষাকে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ও অগ্রাধিকার দিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বনাঞ্চল বৃদ্ধির জন্য নির্বিচার বৃক্ষনিধন রোধ, পাহাড় কাটা বন্ধ করা, শহর ও গ্রামে নিয়মিত বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ করাসহ উন্নয়ন কর্মকা- এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে যাতে পরিবেশ সুরক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গর্ভে থাকা সন্তান মারা গেলে মা-বাবা প্রতিদান প্রসঙ্গে?
হাজীগঞ্জে বিএনপির ২ গ্রুপের সংঘর্ষে কিশোরসহ ৪ জনের অবস্থা গুরুত্বর : আহত ৫০
উত্তরপ্রদেশে নেকড়ের পর এবার রাজস্থানে চিতাবাঘের হামলা, দুদিনে নিহত ৩
কলকাতায় ৪১ দিনের মাথায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার জুনিয়র ডাক্তারদের
দুই রাজ্যে সংঘাত, ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা
ডায়নার সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল দেহ, এবার ধর্ষণে অভিযুক্ত সেই ডোডির বাবা
ভারতে 'এক দেশ এক ভোট’ আয়োজন কতটা সম্ভব হবে?
বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৯
কুমিল্লায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায় প্রবাসীর ওপর হামলা
এবার হলিউডের সিনেমায় জ্যাকুলিন
৯ বছর পর ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি সিনেমা!
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
‘হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে’: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যানি
ঢাকাস্থ গণচীনের দূতাবাসের প্রতিনিধিদলের ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত