ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি থেকে কি সরকার দূরে থাকতে পারবে?

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম

৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছিল, সরকারের অবস্থা নড়বড়ে, ক্ষমতায় তার টিকে থাকা কঠিন হবে। বিরোধীদলের নেতাকর্মী এমনকি ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণে তা পরিলক্ষিত হয়েছিল। বিএনপি তো মনেই করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে একের পর এক বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে এবং রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যেভাবে দৌড়ঝাপ করছে, তাতে ক্ষমতায় যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাসহ সরকারের বিরুদ্ধে নানা নীতি প্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তার ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকানো যাবে না। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি এবং শক্ত অবস্থানের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও চীন দৃঢ় অবস্থান নিয়ে সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তারা একে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি ‘হস্তক্ষেপ’ বলে বিবৃতি দেয়। অন্যদিকে, ভারতও বিবৃতি দিয়ে বলে, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে, কাকে ক্ষমতায় রাখবে এবং বসাবে। সে সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের একটি বক্তব্য দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘তলে তলে সব ঠিক হয়ে গেছে।’ তার এ বক্তব্য নিয়ে তখন বিরোধীদল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। তাকে রীতিমতো সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করা হয়। বিষয়টি এমন, তার এ কথার কোনো মূল্য নেই। দলের নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে এবং বিরোধীদলের আন্দোলন স্তিমিত ও তার নেতাকর্মীদের হতাশ করতে, কিংবা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এমন বক্তব্য দিয়েছেন। অনেকের মনে এমন বিশ্বাস জন্মেছিল, নির্বাচন আদতে হবে না। ‘ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস’ বলে একটা কথা আছে। দেখা গেল, নির্বাচন ঠিকই হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে গেছে। ওবায়দুল কাদেরের ‘তলে তলে সব ঠিক হয়ে গেছে’ বক্তব্য যে নিছক কথার কথা ছিল না, নির্বাচনের পর তা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনের আগে ভারত উপরে উপরে জনগণের উপর নির্বাচনের ভার ছেড়ে দেয়ার কথা বললেও, তলে তলে যা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার সব বন্দোবস্ত করে ফেলে, যা নির্বাচনের পর বোঝা গেছে। ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য মন্ত্রীরা কোনো রাখঢাক না করেই নির্বাচনে ভারতের সহায়তার কথা অকপটে বলেছেন এবং কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে একসময় ভারতের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রায় মাস খানেক আগে তার এক গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে খোলাখুলিভাবেই নির্বাচনে ভারতের সরাসরি সহযোগিতার কথা বলেছেন। পিটার হাসকে কটাক্ষ করে এ কথাও বলেছেন, নির্বাচনের আগে তিনি বিরোধীদলের নেতাদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক এবং দৌড়ঝাপ করেছেন। নির্বাচনের আগে আগে তিনি গা ঢাকা দিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। তার এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে হেরে গেছে। বক্তব্য-বিবৃতি এবং তার রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে দৌড়ঝাপ করিয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারেনি। ভারতই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।

দুই.
বাংলাদেশের গত নির্বাচন নিয়ে এখন সব দেশের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য রয়ে গেছে। সে তার লক্ষ্য থেকে সরেনি। বাংলাদেশে কোন সরকার ক্ষমতায় থাকল, তা নিয়ে এখন তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এ অঞ্চলে তার যে ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএস গড়ে তোলার লক্ষ্য, এখন সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে। এই লক্ষ্যের সাথে ভারতও যুক্ত। অন্যদিকে, একমাত্র চীন এক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। সে কিছুতেই তাদের এ লক্ষ্য পূরণ করতে দেবে না বলে সংকল্পবদ্ধ। বলা বাহুল্য, আইপিএস বাস্তবায়ন করতে হলে ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ তাদের মিত্র দেশগুলোর খুবই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রধানতম ও কমন শত্রু। অন্যদিকে, বাংলাদেশে চীন ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে তার প্রভাব ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। গত ২৬ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে ভেতরের পৃষ্ঠায় দুটি খবর প্রকাশিত হয়। একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক অভিন্ন স্বার্থে পরিচালিত’। আরেকটি খবরের শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ-চীন সামরিক মহড়ার দিকে নজর থাকবে ভারতের’। দুটি খবরই চীন ও ভারতের জন্য অস্বস্তিকর। প্রথম খবরে বলা হয়েছে, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে আইপিএস নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ম্যাক্সওয়েল মার্টিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দুই দেশের অভিন্ন ইতিহাস, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তিতে পরিচালিত। এই সম্পর্ক ভারত, চীন, রাশিয়া বা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। সম্পর্কটা আমরা দ্বিপক্ষীয় প্রেক্ষাপট থেকেই দেখি। এই সম্পর্ককে আমরা অন্য দেশের চোখ দিয়ে দেখি না। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় শুনেছি, ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র দেখে, এটা সত্যি না। আইপিএসে বাংলাদেশের ভূমিকা কি হতে পারে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আইপিএসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক সহযোগিতাসহ বাড়তি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি আগের সহযোগিতাগুলো এগিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আইপিএসে বাধা প্রসঙ্গে বলেছেন, চীনের মতো কয়েকটি দেশ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জোর খাটাতে পারে। আইপিএসের ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের আধিপত্যবাদী আচরণ দেখতে চাই না। আইপিএস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাব ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও চীনের জন্য হুমকি। এর মাধ্যমে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপকে অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বারবার জোর দিয়ে বললেও শেষ পর্যন্ত ভারতের চোখ দিয়ে দেখেছে বলেই একতরফা একটি নির্বাচন হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতেরই কোনো কোনো মিডিয়া বলেছে, নির্বাচনের আগে শেষ মুহূর্তে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে ম্যানেজ করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সে নির্বাচনকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকামী মানুষের আবেগ ও ইচ্ছাকে পুঁজি করে খেলেছে। দেশের মানুষ এ সত্য বুঝতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু হয়, তার শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা যায় না। সে যে, নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও এগোয় না, তা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, কিংবা কোন সরকার আসবে, যাবেÑএ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তার মাথাব্যথা নিজ স্বার্থ বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে অটুট থাকা। সে জানে, বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, তার কথার বাইরে যেতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দল যদি তার কথা শোনে, তাহলে তাকে পরিবর্তন করা তার প্রয়োজন নেই। ভারত হয়ত, তাকে সেভাবেই বুঝিয়েছে। ফলে, নির্বাচনের আগে সে চুপ মেরে গেছে। প্রথম সংবাদটি চীনের জন্যও উদ্বেগের। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আইপিএসে যুক্ত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, যা তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় সংবাদটি ভারতের জন্য উদ্বেগের। এ সংবাদে বলা হয়েছে, এ মাসে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) একটি কন্টিনজেন্ট বাংলাদেশে আসবে। বিষয়টি নিয়ে দিল্লীতে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, প্রতিবেশি দেশ কিংবা অন্যত্র এ ধরনের মহড়ার ওপর ভারত সব সময় দৃষ্টি রাখে। বিশেষ করে সেই ধরনের ঘটনা, যা আমাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ ও চীনের সামরিক মহড়ার দিকে আমাদের দৃষ্টি থাকবে। এ সংবাদ থেকে বোঝা যায়, ভারত এই মহড়া পছন্দ করছে না। এতে চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও চীনের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভারতের জন্য কোনোভাবেই স্বস্তিকর নয়। নিজের আধিপত্য শত্রুর আধিপত্যে খর্ব হোক, তা কেউই চাইবে না। এ পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন ত্রিশঙ্কুর মধ্যে রয়েছে।

তিন.
এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ ক্রমেই পরাশক্তিগুলোর ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। এ যুদ্ধ সরকার কীভাবে সামাল দেবে, তাই এখন দেখার বিষয়। সবদিক সামলে কূটনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি বলতে কিছু নেই। এন্তার দুর্নীতি ও অর্থপাচার দেশকে প্রায় নিঃস্ব করে ফেলেছে। সরকার নগদ অর্থসংকটে ভুগছে। ধার করে চলতে হচ্ছে। ধার শোধ করতে গিয়ে রিজার্ভ তলানির দিকে যাচ্ছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাদের আয়-উপার্জন কমে গেছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস চলছে। সরকার সাধারণ মানুষের কষ্ট স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে পরিস্থিতি জানে। এটা তার জন্য বড় চাপ হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য ও তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যবস্থা এবং পরাশক্তির ছায়াযুদ্ধের কারণে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকার ভাল অবস্থায় রয়েছে, তা বলা যায় না। এমনিতে সরকার ভারতমুখী, তার উপর দেশে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। অনলাইনে ভারতবিরোধী যুদ্ধ চলছে। তাতে বিরোধীদসহ সাধারণ মানুষও যুক্ত হচ্ছে। এটা ভারতের জন্যও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, চীনের সাথে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি ও ব্যাপক হারে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ভারতের গায়ে কাঁটা হয়ে বিধঁছে। সরকার ভারতের সহায়তায় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে ঠিকই, তবে দেশের উন্নয়ন অবকাঠামো ও অর্থনীতি ঠিক রাখতে চীনের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারছে না। কারণ, ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা পাওয়ার পরিবর্তে দিতে হচ্ছে। নির্বাচনের আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ভারতকে যা দিয়েছি, তা সে সারাজীবন মনে রাখবে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারত শুধু নেনেওয়ালা, দেনেওয়ালা না। সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে সহযোগিতা করেছে বটে, তবে সরকারকে দেশ চালাতে হলে তো অর্থ প্রয়োজন। এ প্রয়োজন তো ভারতের দ্বারা পূরণ হচ্ছে না। ফলে সরকারকে অর্থনীতি ও উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে অন্যদেশের সাথে কাজকারবার করতে হবে। এর মধ্যে চীনই দেশের জন্য সহজ অপশন। এটাই ভারতের পছন্দ হচ্ছে না। একদিকে, দেশে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা, অন্যদিকে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ভারতের সবধরনের স্বার্থের পরিপন্থী। বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকলে আইপিএসে যুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলে, তা চীনের লাভ এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বহুমুখী স্বার্থ জড়িত। সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে যতই গালমন্দ করুক না কেন, তার বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতা এবং দান-অনুদান উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রও উঠেপড়ে লেগেছে আইপিএসে বাংলাদেশকে যুক্ত করার জন্য। তা নাহলে, হুট করে দূতাবাস সংবাদ সম্মেলন করে বলবে, আইপিএসের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাড়তি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি আগের সহযোগিতাগুলো এগিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার মাথায় এখন আইপিএস বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে যুক্ত করার চিন্তা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র গোল্লায় যাক, তাতে তার কিছু যায় আসে না। নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রত্যাশায় যে জনগণ তাকে পছন্দ করেছিল, সে পছন্দের মূল্য এখন তার কাছে নেই।

চার.
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়াস হওয়া এবং তা ঠেকানোর জন্য চীনের তৎপরতায় সরকারের আগামী দিনগুলো যে কঠিন হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই। ‘কূল রাখি না শ্যাম রাখি’ এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। একদিকে দেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সামাল দেয়া, অন্যদিকে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্বে পড়ে ভারসাম্যমূলক অবস্থান ঠিক রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে পুঁজি করেই শক্তিধর দেশগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। তখন জোর গলায়ও কথা বলা যায় না। কারণ, অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য দেশগুলোর উপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের কথা শুনতে হয়। এক্ষেত্রে, ভারতের সহযোগিতা করার কোনো কারণ নেই। সে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করেছে ঠিকই, তবে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে, এমন ভাবার কারণ নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস বাস্তবায়ন এবং চীনের তা ঠেকানোর মধ্যে সে ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ হয়ে আছে। এক্ষেত্রে, তাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘জ্বি হুজুর’ হয়েই থাকতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারতের কথায় চুপ থেকে সহায়তা করেছে। এবার নিজের স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারতকে তার কথা শুনতে হবে। তাছাড়া, চীনকে ঠেকানোর মতো ক্ষমতাও তার নেই। ক্ষমতাসীনদের সে বলতে পারে, আইপিএসে যোগ দিতে। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক, সামরিক ও উন্নয়ন সহযোগিতার কথা বিবেচনায় ক্ষমতাসীনদলের পক্ষে ভারতের কথা শোনা কতটা সম্ভব হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নোবিপ্রবিতে অ্যাকাডেমিক মানোন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

নোবিপ্রবিতে অ্যাকাডেমিক মানোন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে পৌনে এক লক্ষাধিক উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষনের আবেদন

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে পৌনে এক লক্ষাধিক উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষনের আবেদন

মোটরসাইকেলের কাগজ দেখতে চাওয়ায় দুই পুলিশকে পেটালেন যুবক

মোটরসাইকেলের কাগজ দেখতে চাওয়ায় দুই পুলিশকে পেটালেন যুবক

সখিপুরে উপজেলা নির্বাচনী কর্মী সভায় দলীয় এমপির ছবি, কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেন শওকত শিকদার

সখিপুরে উপজেলা নির্বাচনী কর্মী সভায় দলীয় এমপির ছবি, কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেন শওকত শিকদার

বিশ্বকাপে আমাদের শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো উচিত: মাশরাফি

বিশ্বকাপে আমাদের শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো উচিত: মাশরাফি

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

নতুন নতুন শ্রমবাজার সবার জন্য উন্মোচন করতে হবে

নতুন নতুন শ্রমবাজার সবার জন্য উন্মোচন করতে হবে

কাজী আজিজুর রহমান সিটি ব্যাংকের নতুন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক

কাজী আজিজুর রহমান সিটি ব্যাংকের নতুন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে জাইকা ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মশালা

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে জাইকা ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মশালা

কুষ্টিয়ায় গোরস্থান-মাদরাসার দান বাক্স ভেঙে টাকা ও সাইকেল চুরি

কুষ্টিয়ায় গোরস্থান-মাদরাসার দান বাক্স ভেঙে টাকা ও সাইকেল চুরি

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পাকিস্তানের

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পাকিস্তানের

কুষ্টিয়ায় জাহাবুল হত্যা মামলায় সামসুলের যাবজ্জীবন

কুষ্টিয়ায় জাহাবুল হত্যা মামলায় সামসুলের যাবজ্জীবন

ব্র্যাক ব্যাংকের লক্ষ্যণীয় সাফল্য

ব্র্যাক ব্যাংকের লক্ষ্যণীয় সাফল্য

প্রান্তিক পর্যায়ে দক্ষ এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে

প্রান্তিক পর্যায়ে দক্ষ এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত নাশকতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন

আবার বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ২৭ জন

আবার বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ২৭ জন

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের শ্রদ্ধা

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের শ্রদ্ধা

একাকী নামাজ পড়ার সময় ইকামত দেওয়া প্রসঙ্গে।

একাকী নামাজ পড়ার সময় ইকামত দেওয়া প্রসঙ্গে।

টেলিটক, বিটিসিএলকে লাভজনক করতে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ

টেলিটক, বিটিসিএলকে লাভজনক করতে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দাবি করেছে ইআরএফ

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দাবি করেছে ইআরএফ