আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সাবমেরিন ক্যাবলের গুরুত্ব

Daily Inqilab মো. জাহিদুল ইসলাম

২৮ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম

ইন্টারনেট ছাড়া বর্তমানে জীবনযাপন কল্পনাই করা যায় না। এই ইন্টারনেট আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে সাবমেরিন ক্যাবল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পারস্পারিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে দূরত্বের ব্যবধান কমে গিয়েছে। মেসেজিং, ফোন কল, ভিডিও কলের মাধ্যমে মুহূর্তেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা অপটিক্যাল ফাইবারের। অপটিক্যাল ফাইবার আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রিকাল সিগন্যালের পরিবর্তে আলোক বা লাইট সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে ডাটা (তথ্য-উপাত্ত) আদান-প্রদানের জন্য লেজার রশ্মি ব্যবহার করে। একইসঙ্গে তড়িৎ শক্তি ও সংকেত পাঠানোর ক্ষমতা রয়েছে এই অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তির মধ্যে। বিশ্বব্যাপী একাধিক সাবমেরিন ক্যাবল রয়েছে। যেগুলো একদেশ থেকে শুরু করে অন্যদেশ, এক মহাদেশ থেকে শুরু করে অন্য মহাদেশ তথা পুরো বিশ্বকে যুক্ত করেছে।

‘সাব’ মানে হলো নিচে আর ‘মেরিন’ মানে সমুদ্র। অর্থাৎ সাবমেরিন ক্যাবল দ্বারা সমুদ্রের নিচে অবস্থিত তারকে বুঝায়। বর্তমানে বিশ্বের মোট ইন্টারনেট ট্রাফিকের নিরানব্বই শতাংশই সাবমেরিন ক্যাবলের উপর নির্ভরশীল। সাবমেরিন (আন্ডারসি) অপটিক্যাল ফাইবার কেবল, যা সাবমেরিন কমিউনিকেশন ক্যাবল নামেও পরিচিত। সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেবল সিস্টেমটি মূলত ফাইবার অপটিক কেবল এবং ইন্টারনেট সংযোগ করতে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রের পানি বাহ্যিক আলো এবং চৌম্বক তরঙ্গের হস্তক্ষেপ রোধ করতে পারে। এ কারণে সাবমেরিন তারের সংকেত থেকে শব্দ অনুপাত বেশি। সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের যোগাযোগে কোনো সময় বিলম্ব নেই। সাবমেরিন অপটিক্যাল ক্যাবলের মূল কাঠামো হলো পলিথিন স্তর, পলিয়েস্টার রজন বা অ্যাসফল্ট স্তর, ইস্পাত স্ট্র্যান্ড স্তর, অ্যালুমিনিয়াম পানিরোধী স্তর, পলিকার্বোনেট স্তর, তামা বা অ্যালুমিনিয়াম নল, প্যারাফিন, অ্যালকেন স্তর, অপটিক্যাল ফাইবার বান্ডেল ইত্যাদি।

এক একটি সাবমেরিন ক্যাবল বিশ থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারে। যেখানে কৃত্রিম উপগ্রহ সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। এদিকে সমুদ্রের নিচে ক্যাবলগুলোকে প্রচন্ড রকমের পানির চাপ সহ্য করে টিকে থাকতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এর ক্ষয়ক্ষতির আশংকা থাকে। এমনকি জাহাজের নোঙ্গরের কারণেও এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এগুলোকে যে কোনো রকমের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে আট স্তর বিশিষ্ট করে তৈরি করা হয়, যার মধ্যে সাতটিই কাজ করে নিরাপত্তাস্তর হিসেবে। আর একদম ভিতরের স্তরটি অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ডেটা ট্রান্সমিশনের কাজ করে থাকে। সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা বিশ্বের অন্যতম কঠিন কাজগুলোর একটি। এর জন্য কাজ করে বিশেষ ধরনের কিছু জাহাজ। বিশ্বে বর্তমানে চারশো ছয়টির বেশি সাবমেরিন ক্যাবল রয়েছে। যেগুলো প্রায় বারো লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের সিস্টেমটি মূলত উপকূলীয় সরঞ্জাম এবং পানির নিচের সরঞ্জাম এই দুই ভাগে বিভক্ত। উপকূল-ভিত্তিক সরঞ্জামগুলি ভয়েস, চিত্র এবং ডেটার মতো যোগাযোগ পরিষেবাগুলিকে সংগ্রহ করে এবং প্রেরণ করে। পানির নিচের সরঞ্জামগুলি যোগাযোগের সংকেতগুলি প্রক্রিয়াকরণ, প্রেরণ এবং গ্রহণের কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে। এদিকে পানির নিচের যন্ত্রপাতিসমূহ তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি হলো সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেবল। দ্বিতীয়টি হলো রিপিটার এবং তৃতীয় অর্থাৎ সর্বশেষটি হলো শাখা ইউনিট। এর মধ্যে সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেবল হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের গঠন শক্তিশালী এবং উপাদানে হালকা ধাতু ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন সামুদ্রিক পরিবেশ এবং পানির গভীরতা অনুসারে অপটিক্যাল তারগুলিতে গভীর-সমুদ্রে এবং অগভীর-সমুদ্রের স্থাপন করা হয়।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সাবমেরিন ক্যাবল যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। কেউ যদি সাবমেরিন ক্যাবল বের করে অপটিক্যাল ফাইবার যোগ করে তাহলে তথ্য চুরি হতে পারে। যুদ্ধ হলে কেউ ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ক্ষতি করতে পারে। তাই সাবমেরিন তারগুলি নিরাপত্তার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। টেরিস্ট্রিয়াল ফাইবার অপটিক তারের সাথে তুলনা করলে সাবমেরিন ফাইবার অপটিক তারের অনেক সুবিধা রয়েছে। অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে লম্বা দূরত্বে অনেক কম সময় বিপুল পরিমাণ তথ্য পরিবহণ করা যায়। অপটিক্যাল ফাইবারের আরও অনেক সুবিধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এ ব্যবস্থায় তথ্য পরিবহনে তথ্য ক্ষয় কম হওয়ার পাশাপাশি তড়িৎ-চুম্বকীয় প্রভাব থেকে মুক্ত ইত্যাদি।

সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের নকশা এমনভাবে করা হয় যেন অপটিক্যাল ফাইবার বাহ্যিক শক্তি এবং পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত না হয়। এছাড়াও এটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন এই সাবমেরিন চাপ, ঘর্ষণ, ক্ষয়, জীববিদ্যা, ইত্যাদি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সাবমেরিন ক্যাবল প্রকল্পটি সারা বিশ্বের দেশগুলির দ্বারা একটি জটিল এবং কঠিন বড় আকারের প্রকল্প হিসাবে স্বীকৃত। ভূমিকম্প এবং সুনামির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বলপ্রয়োগের দ্বারা সাবমেরিন তারের বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়াও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণ রয়েছে যার ফলে সাবমেরিন অপটিক্যাল তারের সংযোগের বিচ্ছিন্নতা ঘটে। একবার তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেল। এর ফলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। সাবমেরিন অপটিক্যাল তারগুলি সাধারণত সমুদ্রতলের নিচে ১-২ মিটার গভীরে পুঁতে রাখা হয়। এদিকে সমুদ্রতল সব জায়গায় সমতল নয়।

অপটিক্যাল তারগুলি অনিবার্যভাবে কখনও কখনও উন্মুক্ত হয়ে যায়। মাছ ধরার নৌকা নোঙর করার সময় বা মাছ ধরার জন্য ট্রল ব্যবহার করলে ফাইবার অপটিক ক্যাবল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই সাবমেরিন অপটিক্যাল কেবলগুলিকে সুরক্ষিত করতে এবং উন্নত করতে শক্তিশালী প্রযুক্তিক করা হয়। আর যদি অনিবার্য কারণে দুর্ঘটনাবশত কোথাও সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবারের সংযোগস্থলে বিপর্যয় ঘটে বা ছিড়ে যায় তখন মেরামত কাজের প্রথম ধাপ হল ব্রেকপয়েন্ট খুঁজে বের করা। সাবমেরিন ক্যাবল ইঞ্জিনিয়াররা টেলিফোন এবং ইন্টারনেট বিভ্রাটের মাধ্যমে ব্রেকপয়েন্টের আনুমানিক অবস্থান খুঁজে বের করেন। এরপর প্রয়োজনে মেরামতের জন্য জাহাজের মাধ্যমে এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রোবটের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থেকে। অপটিক্যাল ফাইবার যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশে খুব কম সময়ের মধ্যে অত্যন্ত গভীর ভূমিকা পালন করেছে এবং মানব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লবকে উন্নীত করেছে। অপটিক্যাল ফাইবার প্রযুক্তি তার সূচনা থেকে অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে অপটিক্যাল ফাইবার যোগাযোগ প্রযুক্তি শুধুমাত্র যোগাযোগ শিল্পে নয়, বিদ্যুৎ শিল্প, সামরিক ক্ষেত্রে এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দৌলতপুর গার্লস কলেজ কেন্দ্রে ৪ শিক্ষককে বহিস্কার

দৌলতপুর গার্লস কলেজ কেন্দ্রে ৪ শিক্ষককে বহিস্কার

ভাঙা দাঁতই চেনাল হারানো ভাইকে! ১৮ বছর পর দেখা বোনের সঙ্গে

ভাঙা দাঁতই চেনাল হারানো ভাইকে! ১৮ বছর পর দেখা বোনের সঙ্গে

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতিতে ঢাবি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, ক্লাস বন্ধ ঘোষণা

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতিতে ঢাবি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, ক্লাস বন্ধ ঘোষণা

এইচএসসি : নকলে সহযোগিতায় শিক্ষকসহ ১১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার

এইচএসসি : নকলে সহযোগিতায় শিক্ষকসহ ১১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার

বিপর্যস্ত দিল্লিতে ফের ভারী বর্ষণের সতর্কতা, মৃত ১১ জনের

বিপর্যস্ত দিল্লিতে ফের ভারী বর্ষণের সতর্কতা, মৃত ১১ জনের

ইসরাইলের আগ্রাসনে গাজায় নিহত ৪০

ইসরাইলের আগ্রাসনে গাজায় নিহত ৪০

দুমকীতে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ৩১৮ বস্তা সরকারি চাল জব্দ,

দুমকীতে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ৩১৮ বস্তা সরকারি চাল জব্দ,

কেয়ামত নামিয়ে আনার অস্ত্র আছে ইসরায়েলের : ইয়ের কাটজ

কেয়ামত নামিয়ে আনার অস্ত্র আছে ইসরায়েলের : ইয়ের কাটজ

হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন লাদাখের আইসম্যান

হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন লাদাখের আইসম্যান

বড় বড় সাংবাদিকদের কিনে এসেছি, সব থেমে যাবে, যা বলছেন নেটিজেনরা

বড় বড় সাংবাদিকদের কিনে এসেছি, সব থেমে যাবে, যা বলছেন নেটিজেনরা

এবার আত্মঘাতী রোবট, দানা বাঁধছে রহস্য

এবার আত্মঘাতী রোবট, দানা বাঁধছে রহস্য

৩০ অক্টোবরের মধ্যে ফাইভ-জি সেবা চালুর নির্দেশ!

৩০ অক্টোবরের মধ্যে ফাইভ-জি সেবা চালুর নির্দেশ!

বন্যায় ভেসে গেলো আট হাজার পুকরের ৭২ কোটি টাকার মাছ

বন্যায় ভেসে গেলো আট হাজার পুকরের ৭২ কোটি টাকার মাছ

সাগরে বোতল দেখে মদ ভেবে পান, ৪ জেলের মৃত্যু

সাগরে বোতল দেখে মদ ভেবে পান, ৪ জেলের মৃত্যু

চীনের ১৪ সাংস্কৃতিক নিদর্শন ফিরিয়ে দিলো আর্জেন্টিনা

চীনের ১৪ সাংস্কৃতিক নিদর্শন ফিরিয়ে দিলো আর্জেন্টিনা

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস আজ

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস আজ

গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে তেল আবিবে বিক্ষোভ ইসরায়েলিদের

গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে তেল আবিবে বিক্ষোভ ইসরায়েলিদের

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু

হারিয়ে গেল বিশ্বখ্যাত গানের পাণ্ডুলিপি! আদালতের দ্বারস্থ শিল্পী

হারিয়ে গেল বিশ্বখ্যাত গানের পাণ্ডুলিপি! আদালতের দ্বারস্থ শিল্পী

আমেরিকার গুরুত্বে মধ্যপ্রাচ্য, কারণ...

আমেরিকার গুরুত্বে মধ্যপ্রাচ্য, কারণ...