বন উজাড়ের বিরূপ প্রভাব এবং আমাদের করণীয়
১০ জুলাই ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৪, ১২:০৪ এএম
কৃষিজমি বৃদ্ধি ও চাষ, অবৈধ লগিং (কাঠ চোরাচালান) এবং নগর উন্নয়নসহ বিভিন্ন কারণে বৃহৎ আকারে বন উজাড় করা বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। এই বিস্তৃত জনজীবন পরিচালনায় জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। এতে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট ও আমাদের বৈশ্বিক জলবায়ুর স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ নেতিবাচক সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বন উজাড় রোধ এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী সমন্বিত প্রচেষ্টার জোড়ালো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্বের স্থলজ প্রজাতির (প্রাণিকূল) প্রায় ৮০ শতাংশই বাস করে বনভূমিতে। এক আমাজন বনভূমিই সকল পরিচিত প্রজাতির প্রায় ১০ শতাংশ আশ্রয় দিয়ে থাকে। তাই আমজনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে ক্রমাগত বন উজাড় এই সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। যখন বনের গাছ নিধন করা হয়, তখন বনাঞ্চলে অবস্থিত জটিল জীবনচক্র তার স্বাভাবিক কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। এতে জীবের বাসস্থানের ক্ষতি হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বন উজাড়ের কারণে বনে অবস্থিত প্রজাতিগুলোর আবাসস্থলের ক্ষতি বর্তমান জীববৈচিত্র্য সংকটের মূখ্য বিষয়। এসব কারণে, বিশ্বে প্রায় ১ মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওরাংওটান, দক্ষিণ আমেরিকার জাগুয়ার এবং অন্যান্য অগণিত প্রজাতি আবাস সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। সঠিক পরিবেশ না থাকায় তাদের বেঁচে থাকা এবং প্রজনন কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার বাস্তুতন্ত্র অনুসারে, গাছপালাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবাগুলোকে প্রভাবিত করে, যা মানুষের উপর নির্ভরশীল। এতে পরাগায়ন, পানি পরিশোধন এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বনের মধ্যে জটিল সম্পর্কের অর্থ হল যে, এমনকি একটি একক প্রজাতির ক্ষতিও ক্যাসকেডিং প্রভাব ফেলতে পারে, বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং স্থিতিস্থাপকতা পরিবর্তন করতে পারে।
জলবয়ু পরিবর্তনে বন উজাড় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বনগুলো কার্বন শোষক হিসাবে কাজ করে, বায়ুম-ল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং জৈববস্তু মাটিতে সংরক্ষণ করে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ১০-১৫ শতাংশের জন্য বন উজাড় দায়ী। যখন গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলা হয় বা অপচয় করা হয়, তখন সঞ্চিত কার্বন আবার বায়ুম-লে ফিরে আসে যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
বনের ক্ষতি স্থানীয় জলবায়ু এবং আবহাওয়ার ধরনকেও প্রভাবিত করে। পানিচক্রে গাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করে। বন উজাড়ের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন হতে পারে, কিছু অঞ্চলে খরা এবং অন্য অঞ্চলে বন্যা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমাজন দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে আবহাওয়ার ধরনকে প্রভাবিত করে। এর গাছপালা উজাড় আবহাওয়াকে বিরূপ করে তুলতে পারে। এতে কৃষি ও পানি সরবরাহের জন্য সুদূরপ্রসারী ঘাটতি তৈরি হবে।
বন উজাড় মোকাবেলার জরুরী প্রয়োজনে সরকার, এনজিও ও বেসরকারি খাত এর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়ন করছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, জাতিসংঘের বন উজাড় এবং বন ধ্বংস থেকে নির্গমন হ্রাস প্রোগ্রাম (আরইডিডি)। আরইডিডি বন উজাড় কমাতে এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করে।
ব্রাজিল এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ, যেখানে বন উজাড়ের হার সবচেয়ে বেশি, তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিল অবৈধ লগিং রোধে কঠোর নজরদারি এবং প্রয়োগকারী ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৪ এবং ২০১২ এর মধ্যে, ব্রাজিল আমাজনে প্রায় ৮০ শতাংশ বন উজাড় কমিয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ এই লাভগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যা অব্যাহত সতর্কতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অনেক কোম্পানি, বিশেষ করে যারা কৃষি ও বনায়নের সাথে জড়িত, তারা শূন্য-বন ধ্বংস সাপ্লাই চেইনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রত্যায়িত টেকসই উৎপাদকদের কাছ থেকে পাম তেল, সয়া এবং কাঠের মতো পণ্যগুলো আমদানি করে। এই সংস্থাগুলোর লক্ষ্য বন উজাড়ের সাথে যুক্ত পণ্যগুলোর চাহিদা কমানো।
সম্প্রদায়ভিত্তিক বন ব্যবস্থাপনা আরেকটি কার্যকর কৌশল। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাদের বন ব্যবস্থাপনা ও রক্ষা করার ক্ষমতায়ন নেপাল এবং তানজানিয়ার মতো দেশে আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো কেবল বন সংরক্ষণই করে না বরং জীবিকাও উন্নত করে, এটি প্রদর্শন করে পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো একত্রিত হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ুর উপর গভীর প্রভাব ফেল বন উজাড় হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, দৃঢ় নীতি এবং উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে বন উজাড় কমানো এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনাকে উন্নীত করা সম্ভব। বিশ্বের বন রক্ষা করা শুধুমাত্র তাদের ওপর নির্ভরশীল অগণিত প্রজাতির জন্যই নয়, আমাদের বৈশ্বিক জলবায়ুর স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য। সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে কাজগুলো তীব্রতর হলে আশা করা যায় যে, আমরা বন উজাড়ের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারি এবং একটি টেকসই ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে পারি।
লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
'মারা গেছেন 'টারজান' খ্যাত অভিনেতা রন এলি'
পঞ্চগড়ে আহত নৈশ্য প্রহরীর মৃত্যু,যুবদল নেতাসহ আটক ৫
কসবায় অটোরিকশা ছিনতাই করতে চালক খুন
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করায় হিলিতে ছাত্রদলের আনন্দ মিছিল
সচিবালয়ে নাশকতার অভিযোগে ২৬ শিক্ষার্থী কারাগারে
জেনেভা ক্যাম্পে আবারো সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ
ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে সমালোচিত কমলা
মোরেলগঞ্জে ঘুর্নীঝড় "দানা"মোকাবিলায় প্রস্তুতি সভা
প্রেসিডেন্টের বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদ : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত
প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ পিপি এডভোকেট ফয়েজকে প্রতিহত করার ঘোষণা আইনজীবিদের
উত্তরার বিএনপি'কে ঢেলে সাজাতে চান সেগুন
সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর গাড়িবহরে হামলার মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে
তারাকান্দায় বাস ও অটোরিক্সার সংঘর্ষে নিহত-১ আহত-২
বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের ইন্টার্নশিপের উদ্বোধনী
ইন্দুরকানীতে ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাব প্রস্তুত ২৫ টি আশ্রয় কেন্দ্র
দেশে প্রথমবারের মতো এমআরসিপি পিএসিইএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
‘দানা’র প্রভাবে অকাল বর্ষণে বিপর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা লন্ডভন্ড উপকূল জুড়ে ব্যপক প্রস্তুতি
ক্ষমা চেয়ে চিরদিনের জন্য দল ত্যাগ করলেন আ’লীগ নেতা!
কেশবপুরে ঋন পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে গড়ার জায়গা : খুবির নবনিযুক্ত উপাচার্য