ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯ কার্তিক ১৪৩১

তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন : দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ

Daily Inqilab প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম

২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

দুর্নীতি বলতে ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারকে বোঝানো হয়। এটি কেবল আর্থিক ক্ষেত্রে সংঘটিত হয় এমন নয় বরং আপাতদৃষ্টিতে আর্থিক লাভ দৃষ্টিগোচর না হলেও চিন্তা-ভাবনা, আচরণ এবং অযাচিত হস্তক্ষেপে নৈতিকতা বিরোধী কর্মকা-ও দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত। দুর্নীতি আস্থা নষ্ট করে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং বৈষম্য, দারিদ্র্য, সামাজিক বিভাজন এবং পরিবেশগত সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিষেবার বিনিময়ে অর্থ বা সুবিধা দাবি বা গ্রহণ করলে নীতিবিরুদ্ধ কাজ হবে। রাজনীতিবিদরা জনগণের অর্থের অপব্যবহার করলে বা তাদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারকে রীতি-নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকারি চাকরি বা টেন্ডার বা চুক্তি প্রদান করলে কিংবা লোভনীয় চুক্তি পেতে কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলেÑ তা হবে নিয়মবহির্ভূত কর্মকা-। দুর্নীতিতে যে কেউ জড়িত থাকতে পারেন। রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী বা জনসাধারণের সদস্যরা যে কোনো জায়গায় বিধিবহির্র্ভূত কাজ করে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী হতে পারেন। পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা অন্যায় ও অন্যায্য কাজ করে দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতির সুধাসদন তৈরি করেছিলেন। সেই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য এবং একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার উপযোগী রাষ্ট্রকাঠামো ও পরিবেশের প্রয়োজনে দেশনায়ক তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন ভাবনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বহুমাত্রিক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারসহ নানা রকমের দুর্বৃত্তায়নের যে শৃঙ্খল গড়ে তুলেছিলেন তার মূলোৎপাটন করাই তারেক রহমানের রাষ্ট্রভাবনার মৌল অনুষঙ্গ। এই অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল প্রতিষ্ঠানের আমূল সংস্কারের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা জোরদার করতে গণমাধ্যমসহ সকল অংশীজন ও সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণের উপযোগী নিষ্কণ্টক পরিবেশ অপরিহার্য। এই প্রত্যাশা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সম্ভব করে তুলতে চেয়েছেন দেশনায়ক তারেক রহমান। জনগণের কাছে কার্যকর জবাবদিহিতায় রাষ্ট্র পরিচালিত হবেÑএই ভাবনা বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গীকার। দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র-কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে দেশনায়ক তারেক রহমানের ভাবনার গুরুত্ব এখানে তুলে ধরা হলো।

২.
গত ১৭ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে দেশনায়ক তারেক রহমান বলেছেন, ‘ঘোষিত ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই সংস্কার কার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।’ গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংস্কার, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, এবং পাবলিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি সংস্কারের জন্য ৩১-দফা রূপরেখা প্রণীত হয়। সূচনায় বলা হয়েছেÑ‘গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শে নিহিত বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিপুল রক্তপাতের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু, ২০০৯ সাল থেকে, কর্তৃত্ববাদী শাসন নিছক দুঃশাসন, অবিচার এবং নৃশংসতার মাধ্যমে বাংলাদেশীদের এই মালিকানা থেকে বঞ্চিত করেছে, বাংলাদেশের ভিত্তি কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। তাই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের ন্যায্য মালিকানা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে জড়িত সব গণতন্ত্রপন্থী দলকে টেনে ‘জাতীয় ঐকমত্যের জনকল্যাণমুখী সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি কেবলমাত্র একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে, যা প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি নির্বাচিত সরকার অর্জন করবে।’

রূপান্তরমূলক সংস্কার ব্যবস্থার অন্যতম হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ৩১ দফার একটি অংশে বলা হয়েছেÑ‘দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স থাকবে। গত দেড় দশকের মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতির তদন্তের জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে, যাতে দায়ীদের জবাবদিহি করা হবে। বাংলাদেশের বাইরে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পর্যাপ্ত প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং দুর্নীতিবিরোধী আইন সংশোধনের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এই তদারকিকে আরও জোরদার করতে সংবিধানের অধীনে একজন ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।’

৩.
আসলে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যকর প্রস্তাবনা প্রদান করেছে। আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং হয়রানিমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন দেশনায়ক তারেক রহমান। কারণ অন্যায্য কাজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে আঘাত করে, দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে, সামাজিক অবক্ষয় ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। এ কারণে অনেক পেশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সে পেশার আদর্শ ও নৈতিকতা। তাই কঠোর নিয়ম-কানুন দিয়ে আমাদের দুর্নীতি দমন করতে হবে।

বলাবাহুল্য, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে দুর্নীতির ডালপালা মেলতে শুরু করে। এরপর প্রায় দুই দশকে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে। ২০২৪ সালে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশে দুর্নীতের মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর পিওন ৪০০ কোটি টাকার মালিক সেখানে সাধারণ মানুষের বিস্ময়বোধ আতঙ্কে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে জনগণের কাছে প্রকাশ পেতে থাকে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, সাবেক আইজিপি বেনজির প্রভৃতিসহ গ্রেফতারকৃত মন্ত্রী-এমপিদের অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিদেশে পাচার হওয়া প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার সন্ধানে তদন্তে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশের সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। কেবল অর্থপাচার করে দেশের ক্ষতিসাধন করেননি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেশবাসীকে পঙ্গু করে গেছেন হাসিনা। সম্ভবত ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি কিংবা হিটলার তাদের দেশের এ ধরনের ক্ষতি করেননি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দেড় দশক ধরে ঘোষিত বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন কর্মকা-ের কথা বলে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় দুর্নীতি ও অনিয়মকে মদদ দিয়ে শেখ হাসিনা তার আত্মীয়-স্বজনসহ দলীয় নেতাকর্মীকে যে পথে পরিচালিত করেছিলেন তা ছিল হিটলার-মুসোলিনিকে অতিক্রমের সামিল। ঋণের বোঝায় জর্জরিত জনগোষ্ঠীকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য সংকটে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। অ্যাডাম স্মিথ বেসামরিক সরকার কর্তৃক জনগণের সম্পত্তি রক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে এজন্যই বলেছেন, অসহায়-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধনবানদের জন্য তৈরি হয়েছে। এজন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণের অর্থ দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে। অথচ এই পাচারকৃত কিংবা দুর্নীতি লব্ধ টাকা দেশে বিনিয়োগ হলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো।
অবশ্য উন্নত দেশে এ ধরনের বিধি-বহির্ভূত কাজের কথা চিন্তাই করা যায় না। ইউরোপ-আমেরিকায় দুর্নীতিমুক্ত দেশের চিত্র একেবারে ভিন্ন। সেখানে মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্র নিবেদিত। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় দুর্নীতির সুযোগ নেই স্ক্যানডিনেভিয়ার দেশগুলোতেও। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের কথা আমরা সকলে জানি। শেখ হাসিনা সরকার সম্পর্কে ২৫/১/২০২২ তারিখে টিআইবি রিপোর্ট ছিল এরকমÑ‘গত ১০ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ২৫ থেকে ২৮ এর মধ্যে রয়েছে। যে দেশের স্কোর যত কম, সেই দেশ তত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। বিশ্বের সবগুলো দেশের স্কোরের গড় ৪৩। বাংলাদেশের স্কোর তার থেকে অনেক কম। এর মধ্যে টানা চার বছরসহ ছয় বছর বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ২৬, দুইবার ২৫ এবং একবার করে ২৭ ও ২৮। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশ চারবার ১৩তম, দুইবার ১৪তম, একবার করে ১২, ১৫, ১৬ ও ১৭তম হয়েছে।’ স্পষ্টত আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন, উন্নয়ন, উন্নয়ন চিৎকারের বিপরীত চিত্র এটি। গণ-অভ্যুত্থানের পর তাদের হত্যা, গুম, নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ঙ্কর চিত্র যেমন উদঘাটিত হয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিশদ বিবরণে পত্র-পত্রিকায় সয়লাব হয়ে গেছে। এমনকি ২০১৯ সালেও প্রকাশিত হয়েছে অর্থপাচারের বিস্তারিত বিবরণ।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভেও ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে। বাকি ২ কোটি ডলার যায় শ্রীলঙ্কায়। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংক হোটেল রূপসী বাংলা শাখা (বর্তমানের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল) থেকে কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে হল-মার্ক নামের একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। জালিয়াতির আরেকটি বড় শিকার বেসিক ব্যাংক। ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১১ মাসে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে এই ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বিভিন্নজনকে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় একই সময়ে বিসমিল্লাহ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এম এইচ গোল্ডেন জুট মিলসহ আটটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয় ৮৫৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। নিয়মনীতি না মেনে এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে জনতা ব্যাংক দিয়েছে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। আছে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথাও। অর্থ আত্মাসাৎ করার বাস্তবতা বহু পুরানো। ভারতবর্ষে হাজার বছর আগে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের আর্থিক দুর্নীতি সম্পর্কে লিখেছেনÑ ‘সকল উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে অর্থের ওপর। সে জন্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল আত্মসাতের ২৪টি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর স্বাদ আস্বাদন সম্ভব নয়, তেমনি একজন লোক রাজকর্মচারী হয়ে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে বসে থাকবেন, এটা অবিশ্বাস্য। জলের নিচের মাছের গতিবিধি যেমন লক্ষ করা সম্ভব নয়, তেমনি রাজকর্মচারীর তহবিল আত্মসাৎ করাও পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতে পাখির ওড়াউড়ি দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর সকল কর্মকা-ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।’ (কৌটিল্য, অর্থশাস্ত্র)

৪.
আসলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিমানুষকে সৎ হতে হবে। একইসঙ্গে জনগণকেও। তাহলে বেআইনি কাজ দূর করা সম্ভব। যেমন, সৎ শাসক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দুর্নীতির সকল দুর্নাম ঘোচানোর জন্য কার্যকর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।(তাঁর ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।) দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবেÑ এ ভাবনা আমরা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সততা ও নীতিবোধ থেকে পেয়েছি। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শুধু দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিলেই হবে নাÑ এ জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম এবং তারুণ্যের অঙ্গীকার। প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমি দুর্নীতি করবো না, অন্যকে দুর্নীতি করতে দেবো না।

৫.
খুনি হাসিনার বিদায়ের পর তারেক রহমান দেশের জনসাধারণকে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। উপরন্তু ড. ইউনূস সরকারের যে কোনো সংকট উত্তরণে পথ বাতলে দিচ্ছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশকে বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করার জন্য সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। ‘আওয়ামী লীগের শাসন : ২০০৯-২০২৪ : দানবিক রাষ্ট্রের কারিকর’ শীর্ষক পোস্টে যথার্থই লেখা হয়েছেÑ‘গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পুরো ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দলীয়করণের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হলো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরকারের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হলো। যেটা জনস্বার্থে কাজ করবে সেটাকে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তর করা হলো। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আইনের শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত প্রতিষ্ঠান আছে, সবগুলোয় একই চিত্র। সবগুলো ক্ষেত্রে দলীয়করণের মাধ্যমে পেশাগত দেউলিয়াপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, দুদক, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশনÑযত কমিশন আছে; সবগুলোকে এক ধরনের দুর্নীতিসহায়ক জায়গায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পেশাগত দেউলিয়াপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভূমিকা পালন করেছেন। ...তাদের কারণে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ক্ষমতার যে স্তম্ভ, এসব স্তম্ভে জনগণের কোনো অস্তিত্ব থাকেনি। রয়েছে শুধু আমলাতন্ত্র ও কলুষিত এবং দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি। ব্যবসা, আমলাতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিÑএ তিন চক্রের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা যাবে, এটাই নিশ্চিত করে ধরে নেয়া হয়েছিল।’

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের দলীয় লোকজনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে সুকৌশলে বিরোধী দলের বিশেষত বিএনপি’র ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগগুলো। এমনকি গ্রেফতার করে বিনাবিচারে জেলে ঢুকিয়েছে বিশিষ্ট নেতৃবর্গকে। তাঁর আমলে করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। ২০২০ সালের শেষের দিকে এবং ২০২১ সাল জুড়ে স্বাস্থ্যখাত ছিল প্রধান বিতর্কের বিষয়। সে সময় দুস্থ মানুষের ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে তারেক রহমান কথা বলেছেন বারবার; যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানুষকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীদের। আসলে নিশিরাতে ভোট চুরি করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হাসিনা সরকার গঠন করেন ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। কিছু দিন যেতেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হন সরকার প্রধান ও তাঁর মন্ত্রীবর্গ।

নীতিবিরুদ্ধ কাজে বাংলাদেশের অবস্থান করুণ হয়ে উঠেছে ২০২৩ সালে এসে। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৩-এ বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ এর তুলনায় ০-১০০ স্কেলে এক পয়েন্ট কমে ২৪ এবং নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে যথাক্রমে ১০ম ও ১৪৯তম। স্কোর ও অবস্থানের এই অবনমন প্রমাণ করে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক। টিআই কর্তৃক ২০১২ থেকে ২০২৩ মেয়াদের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের এই স্কোর সার্বিক ১২ বছরের গড় স্কোর ২৬ এর তুলনায় দুই পয়েন্ট কম এবং হাসিনা মেয়াদে সর্বনিম্ন।(সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, টিআইবি, ৩০/১/২০২৪) বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে ৩১ দফার একটি দফাতে যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা স্মরণ উল্লেখ করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়Ñদুর্নীতি ও অপরাধ যে করবে এবং যে প্রশ্রয় দেবেÑ সবাই অপরাধী। ঘুষ নেওয়া যেমন অপরাধ, দেওয়াটাও সমান অপরাধ। অপরাধী যে দলেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অপরাধ করলে ছাড় পাবে না।

তারেক রহমান মনে করেন, কেবল আইন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে দুর্নীতি ও অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়; এ জন্য সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে। ক্ষমতায় এলে বিএনপি সরকার জনগণের কল্যাণ এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ৩১ দফার ভিত্তিতে জিরো টলারেন্স নীতি নেবে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। দুদক পতনোন্মুখ একটি সংস্থা। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিনিয়ত তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে দুর্নীতির মাত্রাও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। (চলবে)

লেখকঃ সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাস্তা সংস্কার চাই

রাস্তা সংস্কার চাই

সুন্দরগঞ্জে ১০ বছর পর হত্যা মামলা দায়ের

সুন্দরগঞ্জে ১০ বছর পর হত্যা মামলা দায়ের

সবাই ভিসি হতে চান কেন?

সবাই ভিসি হতে চান কেন?

স্বৈরাচারের দোসররা নানা ইস্যুতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে

স্বৈরাচারের দোসররা নানা ইস্যুতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে

প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির ‘না’

প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির ‘না’

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ইরানি কুস্তিগীর নাঘুসি

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ইরানি কুস্তিগীর নাঘুসি

ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তুরস্ক

ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তুরস্ক

ফোন ওঠাতে গিয়ে দুই পাথরের মাঝে উল্টো হয়ে আটকা পড়লেন নারী

ফোন ওঠাতে গিয়ে দুই পাথরের মাঝে উল্টো হয়ে আটকা পড়লেন নারী

ইরানে পাল্টা হামলায় মার্কিন সমর্থন চায় ইসরাইল

ইরানে পাল্টা হামলায় মার্কিন সমর্থন চায় ইসরাইল

বাংলাদেশ থেকে ১৪০ রোহিঙ্গা নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ায় : ৩ জনের মৃত্যু

বাংলাদেশ থেকে ১৪০ রোহিঙ্গা নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ায় : ৩ জনের মৃত্যু

সরকারি কর্মীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে যোগী

সরকারি কর্মীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে যোগী

রাশিয়ায় ৩ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে উ. কোরিয়া

রাশিয়ায় ৩ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে উ. কোরিয়া

ট্রাম্প ‘বয়স্ক ও পাগলাটে’ : বারাক ওবামা

ট্রাম্প ‘বয়স্ক ও পাগলাটে’ : বারাক ওবামা

গণহত্যাকারী লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করুন কালো টাকা ও পেশীশক্তি রোধে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম

গণহত্যাকারী লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করুন কালো টাকা ও পেশীশক্তি রোধে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম

প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি

প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি

আইএসের ইরাক শাখার প্রধান নেতা নিহত

আইএসের ইরাক শাখার প্রধান নেতা নিহত

সিদ্ধ চালের রফতানি শুল্ক তুলে নিল ভারত

সিদ্ধ চালের রফতানি শুল্ক তুলে নিল ভারত

হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করল ইসরইল, নীরব হিজবুল্লাহ

হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করল ইসরইল, নীরব হিজবুল্লাহ

ইউক্রেনের জনসংখ্যা এক কোটি কমে গেছে : জাতিসংঘ

ইউক্রেনের জনসংখ্যা এক কোটি কমে গেছে : জাতিসংঘ

ব্যাংকখাতে আওয়ামী দোসররা এখনো তৎপর

ব্যাংকখাতে আওয়ামী দোসররা এখনো তৎপর