ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯ কার্তিক ১৪৩১

সবাই ভিসি হতে চান কেন?

Daily Inqilab প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘৫০০ শিক্ষক’ ভিসি হতে চান, বিস্মিত শিক্ষা উপদেষ্টা’। ‘জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকের সভার সময় মোবাইল ফোনে এল একটি কল। রিং টোনের শব্দে উপদেষ্টা ফোনটি ধরলেন না। তবে তিনি যে বিরক্ত তা বোঝা গেল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে করা স্বগতোক্তিতে।’ ...তিনি বলতে থাকলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের এত শিক্ষক, ৩০০-৪০০-৫০০ শিক্ষক সবাই কেন এত ভিসি হতে চায়, আমি বুঝি না।’

আরেকটি আলোচিত সংবাদ হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো বললেন, ‘পঞ্চাশজনের মধ্যে আটচল্লিশ জনই তদ্বির নিয়ে আসেন’। অর্থাৎ, তার কাছে বা দপ্তরে যারা দেখা করতে আসেন, তাদের ছিয়ানব্বই ভাগই আসেন কোন না কোন কাজ উদ্ধারে অবৈধ ‘তদ্বির’নিয়ে।

এসব শিরোনাম নিয়ে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এক সহকর্মীর সংগে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বিভিন্ন পদ লাভের জন্য এত তদ্বির বেড়ে গেছে কেন?

তার ঝট্পট উত্তর। এখন এই ঘুষমুক্ত সময়ে এতদিন নীরব থাকা সৎ প্রার্থীরা সরব হয়ে উঠেছেন ! এখন অন্তর্র্বতী সরকারের সময়টা ঘুষমুক্ত হিসেবে বৈষম্যমুক্ত থাকার দাবী করছে। কেউই প্রকাশ্যে ঘুষ-দুর্নীতির কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। হাসিনা সরকারের আমলে বা কিছুদিন আগেও পকেটে ২-৩ কোটি টাকা না থাকলে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন- সরকারি চাকরিতে ডিসি, ওসি হিসেবে পোষ্টিং পাবার কথা চিন্তাও করতো না। যাদের মনে ঘুষ লেনদেনের অবৈধ বিষয়ে ঘৃণা বা ভয়ডর ছিল তারা চুপ করে এসব বিষয় এড়িয়ে থাকতেন। ঘুষমুক্ত এই পরিবেশে সৎ মানুষেরা বড় বড় পদ লাভের জন্য সুযোগ নিতে চেষ্টা করতেই পারে। তার কথায় আবারো বেশ জোর লক্ষ্য করলাম।

তবে কর্তৃপক্ষের সাথে যাদের কোন না কোনভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় ও একাডেমিক যোগাযোগ বেশী রয়েছে তারাই বেশী সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন বলে তার ধারণা । ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে তিনজন ভিসি হয়েছেন। এ ব্যাপারে একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ প্রাধান্য পেলেও সেসব প্রার্থীদের বিশেষ যোগ্যতা ছিল, তা স্বীকার করতেই হবে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যারা আসেন তারা মোটামুটি সবাই ভিসি হবার যোগ্যতা রাখেন। কারণ, ব্যাচেলর বা মাস্টার্সে অন্তত: একটি ফার্স্টক্লাশ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য প্রাথমিক আবেদনই করা যায় না। এরপরও দু’একটি পদের জন্য আজকাল শত শত ফার্স্টক্লাশধারীর আবেদন জমা পড়লে নিয়মানুযায়ী তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মেধা ও উচ্চতর ডিগ্রীধারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও বিগত বিছরগুলোতে এর কিছু ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেছে তথাপি এখনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা মেধাবীরাই পড়াতে আসেন। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

এসব মেধাবীর মধ্যে যাদের অনেক বিদেশী ডিগ্রী ও গবেষণাকাজ রয়েছে এবং কিছুটা উচ্চাভিলাষী তারা মনে করছেন, ঘুষবিহীন বর্তমান সময়ে যদি একটু নড়াচড়া করলে ভিসি হওয়া যায় তাহলে দোষের কী? তাই ঘুষমুক্ত এই সময়ে যার যেভাবে নড়াচড়া করার সুযোগ রয়েছে তিনি সেভাবে তৎপরতা দেখাতে শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের বিস্ময় প্রকাশ করারই কথা। কারণ, দেশে এখন ৪টি স্বায়ত্বশাসিত পাবলিক, ৫১টি সরকারী বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এগুলোতে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে প্রতিটিতে তিনজন করে হিসেব করলে মোট ৪৮০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রয়োজন। সেখানে বিস্ময়ের তেমন কিছু নেই। বরং এতগুলো উচ্চপদে নিয়োগের জন্য একটি সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরী হলে এত জটিলতা হতো না। দেশের ৪টি স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডীন ইত্যাদি পদে সুষ্ঠু নীতিমালা থাকায় সেখানে নিয়োগ নিয়ে কোন জটিলতা দেখা যায় না। কিন্তু এবার ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার পদে নিয়োগে সমস্যা শুরু হয়েছে অন্য জায়গায়। কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করলাম সে সমস্যা কি এবং কোন জায়গায়?

সেটা হলো কে, কীভাবে, কার কাছে আবেদন করবেন তার কোন নিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন দেশের ডিগ্রী, কত বয়স, কোন ধরনের গবেষণা প্রকাশনা, কতটি বই, কত অভিজ্ঞতা থাকলে কে কত স্কোর পাবেন তা কেউ অনুধাবন করতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের উন্মুক্ত সার্কুলেশন না থাকায় অনেক প্রতিভাধর শিক্ষক আবেদন করতে পারেননি। অনেকে বিগত আন্দোলনে শরীক থেকেও সরাসরি ছাত্রদের হাতে নিজের সিভি জমা দিয়ে ভিসি হতে লজ্জা পেয়েছেন।

তারপরেও এই ঘুষমুক্ত সময়ে অনেক প্রতিভাধর শিক্ষক সপ্নবাজ হয়ে ভিসি হতে চেয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে রাজনৈতিক আবরণ ও আভরণ জাগ্রত হওয়ায় শুরুতে যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া দেখা গেছে তা অল্পদিনের ব্যবধানে থমকে গেছে । এছাড়াও অনেকে নিয়োগকর্তাদের স্বজনপ্রীতি ও নিজ প্রতিষ্ঠানপ্রীতির অভিযোগ করেছেন। এর সাথে তদ্বিরও বেড়ে গেছে বহুগুণ।

কথা হলো, তদ্বিরকারীরা আগের মতো সচল হয়ে উঠলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? তোয়াজ-তোষণ-তদ্বিরের দ্বারা অপরের ‘হক’কেড়ে নেয়া হয়। ঘুস, দুর্নীতমুক্ত সময়েও তদ্বিরের মাধ্যমে স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়। এতে প্রকৃত মেধাকে চরম অবমূল্যায়ণ ও অপমান করা হয়। এর ফলে অফিস-আদালত, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্ণারে বৈষম্য মাধা চাড়া দিয়ে উঠে। এর ফলে অরাজকতা তৈরী হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভাঙ্গন ধরে। যেটা কিছুদিন আগে আমাদের দেশে প্রকট নামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করে সামাজিক বিপ্লব সূচিত করেছিল।

এমন বিষয়গুলো মাথায় রেখে একটি দৈনিক পত্রিকা মন্তব্য করেছে, ‘পূর্বাপর এমন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে করা মন্তব্যকে সত্য ও সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি হওয়া এই অচলায়তন ভাঙবে কে? জাতির অন্ধকার দূর করে আলোর পথে আনবেন যে শিক্ষকরা তাদের মনের অন্ধকার প্রবণতা দূর করবে কে?’

এই সোনালী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নায়কদের কাছে যদি শতকরা ছিয়ানব্বইভাগ মানুষ ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে ভিন্নভাবে তদ্বির নাম ভয়ংকর অসুখের বার্তা নিয়ে হাজির হবার সাহস পায় তাহলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে কি চলছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষায় নেই। তা হলে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হলো কোথায়?

দেশের সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে একটি ইতিবাচক পরির্বর্তনের জন্য বিভিন্ন সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার শুরু হয়নি। ভিসি বা শিক্ষক নিয়োগ বা পদন্নোতির জন্য নতুন করে নীতিমালাও তৈরী হয়নি। এমতাবস্থায়, পুরনো নিয়মে ভিসি বা শিক্ষক নিয়োগ হলে পুনরায় পক্ষপাতিত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং এভাবে যোগ্যরা বঞ্চিত হয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকবে। তখন আরো নিত্যনতুন সমস্যা তৈরী করতে পারে।

তাই নতুন নীতিমালা ও কঠিন শর্ত তৈরী করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভিসি নিয়োগের সার্কুলার জারি করলে কেউই আর ভিসি হবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে ধর্ণা দিতে যাবার কথা নয়। সুনির্দিষ্ট যোগ্যতায় যার সর্বচ্চো স্কোর হবে শুধু তিনিই পদ লাভ করতে পারবেন। একটি পদের জন্য ৫০০ জনের দৌড়াদৌড়ি করার প্রয়োজন হবে না। কারণ, এটা একটি মর্যাদার্পূর্ণ পদ। এই পদকে আর কলুষিত করে নিচে নামানোর অবকাশ নেই।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাস্তা সংস্কার চাই

রাস্তা সংস্কার চাই

সুন্দরগঞ্জে ১০ বছর পর হত্যা মামলা দায়ের

সুন্দরগঞ্জে ১০ বছর পর হত্যা মামলা দায়ের

তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন : দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ

তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন : দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ

স্বৈরাচারের দোসররা নানা ইস্যুতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে

স্বৈরাচারের দোসররা নানা ইস্যুতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে

প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির ‘না’

প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতির ‘না’

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ইরানি কুস্তিগীর নাঘুসি

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন ইরানি কুস্তিগীর নাঘুসি

ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তুরস্ক

ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তুরস্ক

ফোন ওঠাতে গিয়ে দুই পাথরের মাঝে উল্টো হয়ে আটকা পড়লেন নারী

ফোন ওঠাতে গিয়ে দুই পাথরের মাঝে উল্টো হয়ে আটকা পড়লেন নারী

ইরানে পাল্টা হামলায় মার্কিন সমর্থন চায় ইসরাইল

ইরানে পাল্টা হামলায় মার্কিন সমর্থন চায় ইসরাইল

বাংলাদেশ থেকে ১৪০ রোহিঙ্গা নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ায় : ৩ জনের মৃত্যু

বাংলাদেশ থেকে ১৪০ রোহিঙ্গা নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়ায় : ৩ জনের মৃত্যু

সরকারি কর্মীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে যোগী

সরকারি কর্মীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে যোগী

রাশিয়ায় ৩ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে উ. কোরিয়া

রাশিয়ায় ৩ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে উ. কোরিয়া

ট্রাম্প ‘বয়স্ক ও পাগলাটে’ : বারাক ওবামা

ট্রাম্প ‘বয়স্ক ও পাগলাটে’ : বারাক ওবামা

গণহত্যাকারী লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করুন কালো টাকা ও পেশীশক্তি রোধে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম

গণহত্যাকারী লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের রাজনীতি এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করুন কালো টাকা ও পেশীশক্তি রোধে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম

প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি

প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি

আইএসের ইরাক শাখার প্রধান নেতা নিহত

আইএসের ইরাক শাখার প্রধান নেতা নিহত

সিদ্ধ চালের রফতানি শুল্ক তুলে নিল ভারত

সিদ্ধ চালের রফতানি শুল্ক তুলে নিল ভারত

হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করল ইসরইল, নীরব হিজবুল্লাহ

হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করল ইসরইল, নীরব হিজবুল্লাহ

ইউক্রেনের জনসংখ্যা এক কোটি কমে গেছে : জাতিসংঘ

ইউক্রেনের জনসংখ্যা এক কোটি কমে গেছে : জাতিসংঘ

ব্যাংকখাতে আওয়ামী দোসররা এখনো তৎপর

ব্যাংকখাতে আওয়ামী দোসররা এখনো তৎপর