আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার প্রসঙ্গে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের সর্ববৃহৎ শৃংখলা বাহিনী। তৃণমূল পর্যায়ে এ বাহিনীর বিস্তৃতি। ১৯৪৮ সালে এ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আনসার বাহিনীকে সুসংগঠিত করে এর নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ আনসার’। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (ভিডিপি) গঠন করে বাংলাদেশ আনসারের সাথে একই প্রশাসনিক কাঠামোয় সন্নিবেশিত করায় এর আত্মপরিচিতি ঘটে ‘আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দল’ সংক্ষেপে আনসার-ভিডিপি হিসেবে। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ সংগঠনটি শৃংখলা বাহিনী রূপে আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সংগঠনটির বিপুল সংখ্যক সদস্য- সদস্যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের আইনশৃংখলা রক্ষায় নিরলস প্রয়াস চালিয়ে সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে। সাংগঠনিক কাঠামো ও আইন অনুযায়ী এ বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবী জনবল প্রায় ৬০ লক্ষ। শুধুমাত্র ভিডিপির ইউনিয়ন দলনেতাগণ মাসিক সম্মানী ভাতা পায়। তালিকাভুক্ত অন্যান্য সদস্য-সদস্যা নিয়মিত আর্থিক সুবিধার আওতায় না থাকলেও প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ, সমাবেশে যোগদান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য-সদস্যা নির্বাচন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়ে থাকে। অন্যান্য সময়ে নিজ নিজ পেশায় অর্থসংস্থান ও উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে।
বাংলাদেশ পুলিশ, আনসার ভিডিপি বাহিনীকে আমরা সাংবিধানিকভাবে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। বাংলাদেশ পুলিশ হচ্ছে ২০০ বছরের অধিক পুরানো এক ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নাম। আর আনসার বাহিনী ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি। তাদেরও ৭৫ বছর পূর্তি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে উভয় বাহিনী তাৎপর্যময় ভূমিকা পালন করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। একটির পাশে অন্যটিকে টেনে আনার বিষয়টিকে অনেকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে পারে। তবে আনসার বাহিনীর অনুগত পক্ষ তাকে তেমন বক্রতার চোখে হয়তো দেখবে না। কেননা বড় ভাইয়ের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়ায় তারা অনেকটা আত্মপ্রসাদ লাভ করবে এবং আহ্লাদিত হবে। পুলিশ সম্মান, সুনাম, খ্যাতির কী ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে তা পুলিশও জানে, সাধারণ জনগণও জানে। সাবেক আইজিপি বেনজীর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আইজিপি ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে আমার বিশ্লেষণাত্মক লেখা বিভিন্ন ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে অনেকটাই বেগবান করেছে। এ আন্দোলনে পুলিশ যেভাবে ছাত্র-জনতার মুখোমুখী হয়েছিল তা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। নিরীহ ছাত্র-জনতার বুকে তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাখির মতো হত্যা করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন থানায়, পোস্টে এবং অপারেশনে অনেক পুলিশ সদস্যেরও জীবনপাত ঘটেছে। এ সংখ্যাটিও কম নয়। আমার কাছে হতাহতের সংখ্যা বড় নয়। কেননা, একটি মৃত্যুর দায়ও সভ্য সমাজের কেউ এড়াতে পারে না। এর মাধ্যমে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হলো সে ক্ষত জাতিকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভোগাবে। তার মেরামত ও সংস্কারে পুলিশ ও আনসার বাহিনীকে নতুন করে জন্ম নিয়ে পুরাতন আর্বজনার স্তূপ সরাতে হবে। হতাহতের বিবেচনায় আনসার বাহিনীর সংখ্যা পুলিশের মতো নয়। তারা ছাত্র-জনতার মোকাবেলায় অনেকটাই সহনীয় আচরণ করেছিল এবং নৈতিকভাবে বারিত হয়েছিল বলে আমার কাছে মনে হয়। সর্বোপরি দাবি ও অধিকার বিষয়ে কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের অনমনীয় আচরণে তারাও একটি পক্ষ বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। কেননা, ফ্যাসিস্ট সরকার পুলিশ বাহিনীকে সেভাবে ক্ষমতায়ন করে ব্যবহার করে ব্যবহারগত দিক থেকে আনসার আর পুলিশ বাহিনীর এ পার্থক্যটি সচেতন মানুষের ধারণার মধ্যে আছে। এ যাবত আনসার বাহিনীতে যে সংস্কার ও সদস্যগণের যতটা কল্যাণ হয়েছে, তাতে আনসার বাহিনী পুলিশ বা সমাজের অন্য সকল বিভাগের নিম্নতম ধাপে তাদের অবস্থান। তারা পুলিশের মতো মুখ উঁচিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত সুবিধাদি আদায় করে নিতে জানে না। আর এ জন্যই ১৯৯৪ সালের আনসার বিদ্রোহে তারা ধরাসায়ী হয়েছিল।
সাম্প্রতিক আনসার বাহিনীর আন্দোলন ছিল একটি বিশেষ গ্রুপের, যারা অঙ্গীভূত আনসার হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। সারাদেশে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এ অঙ্গীভূত আনসারের সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এ আনসার সদস্যদের প্যানেল থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গার্ডে অঙ্গীভূতির জন্য মেসেজের ভিত্তিতে আনসার-ভিডিপি বাহিনী থেকে সিসি অর্ডার হয়ে থাকে। যাই-হোক, সারা বাংলাদেশে ৭০ হাজারের মতো আনসার সদস্য রোটেশনাল প্রদ্ধতিতে বিভিন্ন গার্ডে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। বিভিন্ন প্রত্যাশী সংস্থার চাহিদা এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাতার ভিত্তিতে মাসিক প্রায় পনের হাজার টাকা কম/বেশী অর্থে প্রত্যাশী সংস্থা সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা সেবা কিনে থাকে। তার বিনিময়ে অঙ্গীভূত আনসারগণ নিরাপত্তা সেবা প্রদান করে থাকে। সারা দেশে আনসারদের মাধ্যমে যে সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে তা খুবই তাৎপর্যময় অর্থ বহন করে থাকে। পৃথিবীর কোনো বাহিনী এত সস্তায় নিরাপত্তা সেবা প্রদান করে থাকে বলে আমার মনে হয় না।
যাই-হোক, অঙ্গীভূত আনসার সদস্যগণের দাবির যৌক্তিকতা সরকার বিবেচনার্থে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন এবং তাদের স্বার্থের বিষয় বিবেচিত হবে মর্মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রেস রিলিজও প্রদান করা হয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে আনসার বাহিনীতে চাকরির সুবাদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আনসারদের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনায় আনার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু আনসার বাহিনীর সদস্যগণ সরকারের কোনো কথা না শুনে সচিবালয়কে ঘিরে রাখে এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে, যা কোনো অবস্থাতেই সমীচীন ছিল না। পরবর্তীতে ছাত্র ব্রিগেড তাদের মুখোমুখি হয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। আনসার সদস্যদের এ অনমনীয়তার পিছনে কোনো বিশেষ গ্রুপের ইন্ধন না থাকলে অবস্থা এ পর্যায়ে যেতে পারে না। বিগত সরকারের অনেক অনুগত ছাত্রলীগ, যুবলীগ, অথবা ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগতদের পক্ষ থেকে আনসাররা প্ররোচণা বা মদদ পেয়ে থাকতে পারে বলে আমার কাছে মনে হয়।
বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আমিনুল হক ছিলেন ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী এনামুল হক শামীমের ভাই। কাজেই উস্কানি ও মদদের বহুমুখিতায় আনসার সদস্যগণ খুবই বেপরোয়া হয়েছিল বলে আমার কাছে মনে হয়। এছাড়া এ সংকটের জন্য বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে দায়ী করা যেতে পারে। কেননা, আন্দোলনের অংশ হিসেবে সচিবালয়ে ঘেরাওয়ের পূর্বে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গন এবং রাজপথে তাদের বিভিন্নভাবে মহড়া হয়েছিল। এ মহড়া ও সূচনা পর্বের পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত ছিল। সংকটের সূচনা বুঝেই তাদের আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় হয়তো বা অনেক ঘাটতি ছিল। এটাকে এক ধরনের নেতৃত্বের সংকট ও ব্যর্থতা বলে অনুমিত হয় এবং এটা এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসা উচিত ছিল। সর্বোপরি এটাকে দায়িত্বহীন নেতৃত্বের সংকটের এক খারাপ অধ্যায় হিসেবে অনেকেই আখ্যায়িত করে থাকে। অঙ্গীভূত আনসারদের প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং অবহেলাকে এ ঘটনার দায় থেকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের দাবি, অধিকারের কথা উপর মহলে তুলে ধরার মতো সাহসী মানসিকতা সম্পন্ন কর্মকর্তার কোনো ভূমিকা ছিল না বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। শুরুতে পুলিশের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলাম। পুলিশের একটি অংশ গণঅভুত্থ্যান কালে কর্মস্থল থেকে পলায়ন করেছে। তাদের মধ্যেও একটি ক্ষোভ কাজ করেছে। আন্দোলন মোকাবেলা করা, গুলির আদেশ দেওয়া ইত্যাদি ছিল কর্তৃত্ববাদী পুলিশী আচরণ। এ বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যগণও বুঝে। তারা মনে করে যে, কর্মকর্তাদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে অপারেশন ও মাঠ পর্যায়ে সাধারণ সদস্যগণকে। এমত পরিস্থিতিতে অফিসার ও সাধারণ সদস্যদের মধ্যেও একটি দূরত্ব তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণ সদস্যরা মনে করে যে, কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও ক্ষমতায়নে পুলিশের সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্ধ অনেক কর্মকর্তাই এ সময়ে অবিবেচকের মতো ভূমিকা পালন করেছিল বিধায় এখানেও নেতৃত্বের সমস্যা প্রকটতর ছিল। পুলিশ, আনসারের নেতৃত্বের সমস্যার দ্রুত অবসান ঘটিয়ে মুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গঠনে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল
ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা
মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা
বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা