ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে

Daily Inqilab অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

প্রায় দেড় যুগের বল্গাহীন দুর্নীতি-দুঃশাসন, লুটপাটে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ভগ্নদশা জাতির সামনে উলঙ্গভাবে ধরা পড়ে। অনেকে বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরও আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এতটা ভগ্নদশায় উপনীত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে কথাকথিত উন্নয়নের ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে মূলত সর্বগ্রাসী লুণ্ঠন, অর্থপাচারের ভয়াবহ চিত্রটিকে আড়াল করার সাথে সাথে জাতির কাঁধে হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপর নানামুখী সংস্কারের চ্যালেঞ্জ থাকলেও সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা ঘুচিয়ে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করার সাথে সাথে বাজারের মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ করা। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ২ মাস পার হয়ে আসার পর দেশের পরির্বতন প্রত্যাশী জনগণ অর্থনৈতিক খাতে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের হিসাব মেলাতে শুরু করেছে। দীর্ঘ ১৮ বছরের জঞ্জাল দু’-তিনমাসেই সরিয়ে ফেলা হয়তো সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ার বাস্তবতা উদ্বেগজনক। বিশেষত বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রায় নাভিশ্বাস সৃষ্টি করছে। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী দলবাজ সিন্ডিকেট এখনো নেপথ্যে সক্রিয় থেকে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করায় নিত্যপণ্যের বাজারে টালমাটাল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোতে বিদ্যমান অচলাবস্থা ও সংকট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভগ্নদশা ও সংস্কারের প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি ইতিবাচক অবস্থায় পৌঁছতে আরো সময় লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংকিং খাতের দৈন্যদশা লাঘবে রাতারাতি উন্নয়নের কোনো যাদুর চেরাগ কারো হতেই নেই। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে চলতি আর্থিক বছরে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। তবে বিগত সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের যেসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হতো তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তি ও অনাস্থা ছিল। এখন সেসব বিষয়ে ফাঁকিবাজি বা বিভ্রান্তির কোনো আশঙ্কা নেই বলেই ধরে নেয়া যায়। বিগত সময়ে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে তিন-চারটি প্রধান বাধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে আহুত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত সম্পর্কে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে মূল্যস্ফীতি, ঋণের চাপ, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের আশ্বাস ও সংষ্কারের ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আগামী বছর থেকে অর্থনীতিতে নতুন গতি ফিরে আসার আশাবাদ জেগে উঠেছে। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বার্তা ও প্রস্তাবনা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে ঢাকা সফর করেছেন এবং করছেন।

প্রায় দুই দশক ধরে দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ হয়নি। উচ্চ শিক্ষিত ও কর্মক্ষম জগোষ্ঠির চাপ বাড়লেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাইরে দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না হওয়ায় সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকার শ্রম বাজারে বাংলাদেশিদের নিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিগত সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচ্চ ভাবমর্যাদা ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে সে সব সম্ভাবনা আবার নতুনভাবে ধরা দিতে শুরু করেছে। খরা কাটতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের প্রধান অংশীদার দেশগুলোতে বাংলাদেশের জন্য নতুন দুয়ার খুলে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স প্রবাহে নতুন গতি দেখা দিয়েছে। প্রবাসী কর্মীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থা রেখে রেমিটেন্স পাঠিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনেও প্রবাসী শ্রমিক তথা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি ডায়াসপোরা অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে স্বৈরাচারের নিয়োগকৃত দলবাজ আমলা, বিচারপতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখনো নানামুখী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে। প্রশাসন ও বাজারে তাদের আধিপত্য অক্ষুণ্ন রেখে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন অসম্ভব হতে পারে। কেউ কেউ এখনো প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা করছেন। এসব আশঙ্কা অমূলক নয়। গার্মেন্ট সেক্টরে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হওয়া ইত্যাদি বিষয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে গণ্য করা যায়। গত দুই মাসে দুই দফা জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়েছে। পথে পথে চাঁদাবাজি, পুলিশি হয়রানিও কমেছে। এহেন বাস্তবতায় বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী চক্র পরিকল্পিতভাবে বাজারের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে একদিকে জনগণের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে জনগণের অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলার রাজনৈতিক কারসাজি সম্পর্কে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার। জরুরি কিছু সংস্কার শেষে একটি সুষ্ঠু-স্বচ্ছ নির্বাচনের কাক্সিক্ষত পরিবেশ নিশ্চিত করাই এ সরকারের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক খাতের পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকে সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করে সর্বোচ্চ তদারকি ও বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিস্ময়কর রেকর্ড
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতি ঐক্যবদ্ধ
সংস্কার ও জাতির স্বপ্ন
জাতীয় ঐক্য দৃঢ় ও সুসংহত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে  চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন