ঢাকা   শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২৪ কার্তিক ১৪৩১

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

গত প্রায় ১৬ বছরে দেশ থেকে কি পরিমান অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো হাতেই নেই। জিএফআই বা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির দেয়া তথ্যে প্রতি বছর দেশ থেকে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি বা গড়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। প্রকৃত অংক এর চেয়ে বেশি হতে পারে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে তোলার পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে কার্যত দেশকে দেউলিয়াত্বের মুখে রেখে গেছে। দিল্লীতে পালিয়ে গিয়েও তিনি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে নানা রকম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। শেখ পরিবারের নিকটতম সদস্য ও মাফিয়াতান্ত্রিক শাসনের সুবিধাভোগী দোসরদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও শত শত কোটি ডলার পাচার করা বেশিরভাগ লুটেরা-দুর্নীতিবাজ বিদেশে পালিয়ে গিয়ে দেশবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে পাচারকৃত বিপুল অর্থই তাদের মূল শক্তি বলে জানা যায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ছাড়াও অসংখ্য গুম-খুন ও গণহত্যার মামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে হাসিনাসহ তার ৪৫ সহযোগির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে না পারলে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর লন্ডনভিত্তিক ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার সাথে ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররা দেশ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে বলে জানিয়েছেন। ব্যাংক অধিগ্রহণ, ঋণ জালিয়াতি এবং পণ্য আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ২ লাখ কোটি টাকা পাচারের শীর্ষে থাকা এস আলম গ্রুপের অর্থপাচারের সাথে ডিজিএফআই, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর একশ্রেণীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানে থাকা বেসরকারি ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তাদের অস্ত্রের মুখে পদচ্যুত করার সাথে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেক্টরের এমন লুটপাটের নজির নেই। অথচ এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে তাদের অর্থপাচারের অভিযোগ সত্য নয় বলে বিবৃতি দিয়েছে। একে অর্থনীতিবিদরা ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দেয়ার ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ নতুন নয়। আবার শুধু যে ব্যাংক খাত থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে তা নয়, আরও অন্যান্য খাত থেকেও পাচার হয়েছে। শেখ হাসিনার এই দোসররা লুটপাট ও অর্থপাচার করে দেশের অর্থনীতিকে তলানিতে নিয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের আর্থিক খাতকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মাফিয়া কায়দায় ব্যাংক দখল, জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থপাচারের সাথে জড়িত ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। পাচারকৃত অর্থের জোরে একদিকে পতিত স্বৈরাচার যেমন আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে নানা অপপ্রচার, প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চক্রান্তে লিপ্ত, অন্যদিকে এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপের মত কর্পোরেট লুটেরা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি ল’ফার্মের মাধ্যমে সরকারের সাথে আইনগত লড়াইয়ের সাহস দেখাচ্ছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা দিয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকার। এ ক্ষেত্রে গঠিত টাস্কফোর্স পুনর্গঠণ করা হলেও কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে এখনো তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে ধীরগতি কিংবা শৈথিল্য কাম্য নয়।
অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে বিগত সরকারের সময় গঠিত টাস্কফোর্স সঠিকভাবে কাজ করেনি। সঙ্গত কারণেই এ টাস্কফোর্স দিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন। কাজেই অর্থ ফেরতের কথা মুখে বললে হবে না। কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের পরিকল্পিত লুটপাট ছাড়াও দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, সুশাসন ও বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে দেশগুলোর সাথে এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশকে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় হাবে পরিণত করতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এখনো সর্বত্র রয়েছে। তারা সুযোগমত সরকারকে ব্যর্থ করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। দেশকে অস্থিতিশীল করে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করাই তাদের লক্ষ্য। শেখ হাসিনা দিল্লীতে বসে ষড়যন্ত্র করছেন। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে বিপুল অর্থও তার ও তার দোসরদের কাছে রয়েছে। পতিত স্বৈরাচারের রাজনীতিতে পুর্নবাসনের সম্ভাবনা না থাকলেও শুধুমাত্র বিপুল পরিমান অর্থের জোরে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ফলে পাচারকৃত অর্থের হদিস এবং এর লেনদেন বন্ধে অংশীদার দেশগুলোর সাথে কার্যকর কূটনৈতিক ও আইনগত বোঝাপড়া নিশ্চিত করা জরুরি। অবৈধভাবে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি ডলারের সিকিভাগও যদি ফেরত আনা যায় দেশকে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। ভবিষ্যতে এমন বল্গাহীন ব্যাংক জালিয়াতি ও অর্থপাচারের সুযোগ বন্ধ করতে অর্ন্তবর্তী সরকারকে শুধু টাস্কফোর্স গঠন করে বসে থাকলে চলবে না। পাচারকৃত অর্থ জব্দ ও দেশে ফেরত এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। অবৈধ অর্থের জোরে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যাতে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এসব আশ্বাস এখনও বাস্তাবয়ন হয়নি। ফলে সরকারকে অর্থনীতি পুনর্গঠনে নিজ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অর্থ সংস্থান করতে হবে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

পরিবহনব্যবস্থা
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন
সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন
আরও

আরও পড়ুন

'নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করে ট্রাম্পকে হাসিনার অভিবাদন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নোংরা খেলায় কঙ্গনা রানওয়াত'

'নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করে ট্রাম্পকে হাসিনার অভিবাদন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নোংরা খেলায় কঙ্গনা রানওয়াত'

ফর্মে ফিরতে বাবরকে কোহলির পথে হাঁটতে বললেন পন্টিং

ফর্মে ফিরতে বাবরকে কোহলির পথে হাঁটতে বললেন পন্টিং

মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার

মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার

সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!

সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!

সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে

সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে

ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩

ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩

সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা

সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা

যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু  - ডা.মাজহার

৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু - ডা.মাজহার

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?

প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?

ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা

ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা

মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!

মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!

আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন

আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন

পরিবহনব্যবস্থা

পরিবহনব্যবস্থা

রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর

রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর

ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন

ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন

অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা

অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা

৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর

৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন