ঢাকা   শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪ | ২৫ কার্তিক ১৪৩১

তরুণ প্রজন্ম এবং ৭ নভেম্বরের বিপ্লব

Daily Inqilab ড. মোর্শেদ হাসান খান

০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৩ নভেম্বর থেকে রেডিও টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল না। সেনানিবাস এবং বঙ্গভবনে ঘটে চলা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে সাধারণ জনগণ এমনকি সেনাবাহিনী অন্ধকারে ছিল। অনিশ্চয়তা এবং ভারতীয় আগ্রাসনের ভীতির মাঝে জনতার দিন কাটছিল। তার উপর সেনাবাহিনীর মধ্যে ধারণা তৈরি হয় খালেদ মোশারফ ভারতপন্থি এবং তিনি ভারতের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বাসিত করবেন।

এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ হিসাবে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ব্যাপক প্রচারণাকে দায়ী করা হয়। কাকতালীয় অথবা নিয়তির পরিহাস হলেও এসময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা খালেদ মোশারফের উদ্দেশ্য নিয়ে সিপাহী জনতার মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়। কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ সিপাহীদের নজরে পড়ে। তার উপর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের একটি মিছিল বের হয় শেখ মুজিব এবং চার নেতা হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে। মিছিলটি পলাশী থেকে শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেষ হয়। তারা এই দাবিতে পরের দিন হরতাল ডাকে। এ মিছিলের সম্মুখে ছিলেন খালেদ মোশারফের মা এবং বড় ভাই রাশেদ মোশারফ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। এমন নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মিছিল এবং নেতৃত্বে খালেদ মোশারফের পরিবারের সদস্যÑ এই ছবি ৫ নভেম্বর প্রতিটা পত্রিকার প্রথম পাতায় খালেদ মোশারফের র‌্যাংক পরিধানের ছবির নিচে ছাপা হয়েছিল। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যরা যদি পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর দাবিতে মিছিল করে তাহলে জনমনে কী ধারণা তৈরি হবে?

আরেকটি ঘটনা ঘটে সেনানিবাসের প্রধান প্রবেশ পথে। ৪ নভেম্বর ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা এসে উপস্থিত হন এবং খালেদ মোশারফের সাথে দেখা করতে চান। খালেদ মোশারফ সেনানিবাসে অনুপস্থিত থাকায় ব্রিগেডিয়ার ভোরা খালেদ মোশারফের জন্য একটি উপহার বাক্স রেখে যান। এমনিতেই সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত ছিলেন, তার উপর এসকল ঘটনা সিপাহী-জনতার মনে সন্দেহ ঘনীভূত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা সময়ের আলোচনা করছি যখন জনগণ ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবর রহমানের উৎখাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে এবং ভারত বিদ্বেষ স্মরণকালের মধ্যে তীব্র।

খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল দুইজনেই সেনা বাহিনীতে তাদের প্রভাব এবং কর্তৃত্ব নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার মাঝে ছিলেন। শাফায়াত জামিলের ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ বিগ্রেডের মাত্র তিনটি ইউনিট তাদের সমর্থন করছিল। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল পরস্পরের মাঝে অবিশ্বাস দেখা দেয়। শাফায়াত জামিলকে না জানিয়ে খালেদ মোশারফ ১০ম বেঙ্গলকে রংপুর থেকে ঢাকা আনেন। নিয়তির টানে আরও দুজন খালেদ মোশারফের আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম ঢাকায় এসে তার পাশে অবস্থান নেন।

জিয়াউর রহমান গৃহঅন্তরীণ হওয়ার পর থেকে সেনানিবাসে গোপনে সিপাহীদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরিতে উদ্যোগী হন জাসদ নেতা অবসর প্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। জিয়াউর রহমান গৃহঅন্তরীণ অবস্থায় তাহেরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। তিনি উদ্ধারে সাহায্য চেয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাহের তার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং নিজ অভিলাষ পূর্ণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পান। আবু তাহের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক পা অস্ত্রপ্রচার করে অপসারণ করা হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বেসামরিক পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল। তিনি গণচীনের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। তার আদর্শের সাথে জাসদের মিল দেখতে পান। তাহের জাসদের উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। তিনি জাসদের সশস্ত্র ইউনিট গণবাহিনীর প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল জাসদ। জাসদের অসংখ্য তরুণ নেতা-কর্মী রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের হাতে নিহত হন অথবা কারাগারে নির্যাতিত হন। তবুও উগ্রবাদিতা, অসহিষ্ণু ও হিংসাত্মক আচরণের কারণে জাসদ জনসমর্থনে পিছিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাসদ এবং সর্বহারা পার্টিকে তারুণ্যের অপচয় বলে মতামত দিয়েছেন।

আবু তাহের সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে গণবহিনীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, যেখানে শুধুমাত্র সৈনিক নিয়োগ হবে এবং সুবেদার পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদ থাকবে। নিয়মিত সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে তারা দেশের বিভিন্ন কাজে অংশ নেবে। রাশিয়া এবং চীনের বিপ্লবের পটভূমিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী চিন্তাধারা সেসময় অনেক দেশে উদ্ভব হয়, সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হুজুগ দেখা দেয়। দুঃখজনকভাবে এসব স্বপ্নবিলাসের সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক থাকায় অধিকাংশই ব্যর্থ হয় এবং মাঝখানে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশেও তাহেরের পরিকল্পনা মুখ থুবডে পড়ে এবং জাসদ বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যায়। আবু তাহেরের পরিবার এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী তাকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। বিশেষ করে ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় তার পক্ষে জনগণের সহানুভূতি গড়ে তোলা সহজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমানকে খলনায়কের ভূমিকায় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগ সবসময় একাজে উৎসাহ দিয়েছে। অথচ জিয়াউর রহমান সিপাহীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং তার ফলে সিপাহীদের মর্যাদা এবং জীবনমানের উন্নয়ন হয়। ৭ নভেম্বরের ছুটিও সিপাহীদের দাবি ছিল, যা ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাতিল করা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আবু তাহের সেনা বাহিনীতে যে অসন্তোষের বীজ বুনেছিলেন তার রেশ ধরে ৭৫ থেকে ৭৭ তিন বছর সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য সিপাহী এবং অফিসারের রক্ত ঝরেছে। তাহেরের বিপ্লবী সিপাহীদের ৭ নভেম্বর খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং কর্নেল এ টি এম হায়দারকে হত্যা করার মাধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে ভাতৃহত্যার সূচনা হয়। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।

৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করলে আবু তাহের তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান। এমনকি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতামত উপেক্ষা করে জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক কষেন। তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা সেনানিবাসে ৪ নভেম্বর থেকে ১২ দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ শুরু করে। সিপাহীদের ন্যায্য কিছু দাবির সাথে সুকৌশলে তার সমাজতান্ত্রিক দাবি ঢুকিয়ে দেন। সাথে রং চড়িয়ে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের আওয়মী লীগ এবং ভারতপ্রীতির গুজব ছড়ান। সিপাহীরা উত্তেজিত হতে থাকে। তারা প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমানের আটক এবং পদত্যাগ ভালভাবে নেয়নি। ৬/৭ নভেম্বর মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপাহীরা ফাঁকা গুলি করে বিদ্রোহ জানান দেয়। এর পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের যে তিনটি পদাতিক ইউনিট খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দিন (১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত-দেশে থেকে যাওয়া একমাত্র অফিসার) এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হক তাদের অনুগত কিছু সৈনিকসহ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি থেকে উদ্ধার করে তাদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। অনেকে প্রচার করেন তাহেরের সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে, যা সত্য নয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিদ্রোহ অনুঘটক হিসেবে কাজ করলেও, জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন এই দুজন সেনা কর্মকর্তা। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থানকালে এই রেজিমেন্ট এবং চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসার, নন কমিশন্ড অফিসার এবং সিপাহীরা জিয়াকে আগলে রাখে। এখানে উল্লেখ্য ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে ফারুকের ট্যাংক ইউনিটের সাথে রশীদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করেছিল এবং চতুর্থ বেঙ্গল শাফায়াত জমিলের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ৭ নভেম্বর তারা সকলে জিয়ার চারিদিকে প্রতিরক্ষা তৈরি করে।

সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার পর জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে অবস্থানরত সকল সিনিয়র অফিসারকে তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সৈনিকরা নিজ উদ্যোগে সেনানিবাসের সকল অফিসারকে খুঁজে জিয়ার সামনে হাজির করে। এদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী বীর উত্তম। তিনি সেসময় যশোর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং ৬ নভেম্বর ঢাকার মিটিংয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। এসকল অফিসার এবং অনুগত সৈনিকরা জিয়ার চারিদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে এবং তাকে সুরক্ষিত রাখে উশৃঙ্খল সিপাহী এবং সেনানিবাসে অনুপ্রবেশকারী তাহেরের সন্ত্রাসীদের থেকে।

জিয়াউর রহমান খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি শাফায়াত জামিলের সাথে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন এবং তাকে নিশ্চিন্তে সেনানিবাসে ফেরার আহ্বান জানান। শাফায়াত জামিলের বিপ্লবের মাত্রা এবং ব্যাপকতা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তিনি জিয়াউর রহমানের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। যখন উপলব্ধি করেন তার পদাতিক বাহিনী বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গেছে এবং বিপ্লবী সিপাহীরা বঙ্গভবনে প্রবেশের চেষ্টা করছে তখন তিনি দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন এবং শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় আশ্রয় নেন। মীর শওকত আলী কর্নেল আমিনুল হককে পাঠিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। দুঃখজনক পরিণতি হয় খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের। তারা বঙ্গভবন ছেড়ে শেরেবাংলা নগরে অবস্থানরত রংপুর থেকে আগত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাউনিতে আশ্রয় নেন। এটা তাদের অনুগত বাহিনী হওয়ায় তারা সেখানে নিরাপদ বোধ করেছিলেন। এ ইউনিটের কমান্ডে তখন ছিলেন মেজর নওয়াজিশ। তিনি জিয়াউর রহমানকে ফোন করে খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের উপস্থিতির কথা জানান। জিয়াউর রহমান তাদের নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংঘের সিপাহীরা এসে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের উত্তেজিত করে তুলে এবং এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে হত্যা করে।

তাহের ৭ নভেম্বর ভোর রাতে সেনানিবাসে এসে জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে আহ্বান করেন এবং সাথে করে নিয়ে যেতে চান। তাহেরের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে এবং জিয়াউর রহমানের প্রাণহানির আশংকায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে বাধা দেন এবং রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাহেরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহের বিফল হয়ে ফেরত যান। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জ্যেষ্ঠ অফিসার পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন, তাহেরের সাথে জিয়াউর রহমানের সেনানিবাস থেকে বের না হওয়া সঠিক ছিল। এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। জিয়াউর রহমান তাহেরের আয়ত্তে চলে গেলে তাকে জিম্মি করে নিজের মতন ভাষণ আদায় করে নিতেন এবং জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতেন। এমন ধারণা অবাস্তব শোনালেও সমাজতন্ত্রীরা যেকোনো উপায়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনকে বৈধ মনে করে। উপরন্ত তাহের উগ্রপন্থী রাজনীতিতে ইতোমধ্যে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহের তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন অফিসার হত্যায় সিপাহীদের উৎসাহ দিয়ে, যার ফলাফল ছিল মর্মান্তিক।

১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় জনতা যেমন সম্বিত ফিরে পেয়েছিল, তেমনি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জিয়ার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার ভাষণ শুনে জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, চলমান অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পায়। একজন জনপ্রিয়, দৃঢ়চেতা মুক্তিযোদ্ধার দেশ শাসনের দায়িত্ব নেওয়ায় জনগণের দুঃশ্চিন্তা লাঘব হয়। সাধারণ সিপহীরা ট্রাক নিয়ে, ট্যাংক নিয়ে জনতার সাথে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ৭ নভেম্বর সকালেই সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আসে। এর পর জনতা সামরিক ট্রাক এবং ট্যাংকের উপর উঠে আনন্দ করতে থাকে। এই আনন্দ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার আনন্দ, মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ, অপশক্তি প্রতিরোধের আনন্দ। এ আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল রাজপথে। এই সফল বিপ্লব সিপাহী-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছিল, যার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী, যা আমারা আজও অনুভব করি। ৭ নভেম্বর না হলে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র এবং সুশাসনের ধারায় ফিরত না। অভাব, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং অরাজকতায় জর্জরিত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করে আমাদের তরুণদের ৫ আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। কাজ মাত্র শুরু। হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যাবে যদি আমারা সফল হতে না পারি। আমারা সবাই বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি
তরুণদের বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে হবে
পরিবহনব্যবস্থা
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
আরও

আরও পড়ুন

দুঃশাসন ও নির্যাতন সরকার পতনের মূল কারন - মাসুদ বিন সাঈদী

দুঃশাসন ও নির্যাতন সরকার পতনের মূল কারন - মাসুদ বিন সাঈদী

হত্যা মামলার আসামি হয়েও অফিস করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা

হত্যা মামলার আসামি হয়েও অফিস করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা

বিএনপি জনসাধারণের নিরাপত্তায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে

বিএনপি জনসাধারণের নিরাপত্তায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে

কাবুলে তালিবানের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক ভারতের

কাবুলে তালিবানের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক ভারতের

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

৭ নভেম্বরের পোস্টার ছিড়ে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন সমীচীন কাজ নয় : ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক

৭ নভেম্বরের পোস্টার ছিড়ে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন সমীচীন কাজ নয় : ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক

কুয়াকাটায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে বাধা ও হামলার অভিযোগে শতাধিক দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা

কুয়াকাটায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে বাধা ও হামলার অভিযোগে শতাধিক দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা

'আত্মহত্যা করেছেন বলিউড অভিনেতা নীতিন চৌহান'

'আত্মহত্যা করেছেন বলিউড অভিনেতা নীতিন চৌহান'

বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. এর জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই

বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. এর জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই

মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি

মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি

তরুণদের বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে হবে

তরুণদের বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে হবে

জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে দেশে কোন নির্বাচন করতে দেয়া হবে না -মোস্তফা

জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে দেশে কোন নির্বাচন করতে দেয়া হবে না -মোস্তফা

ব্র্যাক ব্যাংক রিডিং ক্যাফেতে জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ নিয়ে আলোচনা

ব্র্যাক ব্যাংক রিডিং ক্যাফেতে জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ নিয়ে আলোচনা

হলিউডশীর্ষ পাঁচ

হলিউডশীর্ষ পাঁচ

বলিউডশীর্ষ পাঁচ

বলিউডশীর্ষ পাঁচ

চার ব্যান্ড নিয়ে ঢাকা রেট্রো কনসার্ট

চার ব্যান্ড নিয়ে ঢাকা রেট্রো কনসার্ট

ঢাকা আসছেন ব্ল্যাক ডায়মন্ডখ্যাত বেবী নাজনীন

ঢাকা আসছেন ব্ল্যাক ডায়মন্ডখ্যাত বেবী নাজনীন

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক ফোরামের আলোচনা সভা

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক ফোরামের আলোচনা সভা

ক্যাপশন

ক্যাপশন

ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করায় ফ্যামিলি মেনে না নেওয়া প্রসঙ্গে?

ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করায় ফ্যামিলি মেনে না নেওয়া প্রসঙ্গে?