বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটেরাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে
০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া কাজ দিতে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করে সদ্য বিতাড়িত ও পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। এ আইনের উদ্দেশ্য মোটেই মহৎ ছিল না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম ও লুটপাট অবাধ ও প্রশ্নহীন করার জন্যই আইনটি করা হয়। এটি ‘দায়মুক্তি’ আইন হিসাবে পরিচিত পায়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি বাতিল করেছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আইনটি বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে গত শনিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, সংসদ কার্যকর না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে আইনটি বাতিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১৪ নভেম্বর আইনের দুটি বিধান অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরও আগে অন্তর্বর্তী সরকার (১৮ আগস্ট) বিশেষ বিধান আইন স্থগিতের ঘোষণা দেয় ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাময়িক সময়ের জন্য আইনটি করার কথা বলা হলেও দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ায়। বিগত সরকার শেষ দফায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, লুণ্ঠন জারি রাখার স্বার্থেই। এ আইনের আওতায় শতাধিক প্রকল্প নেয়া হয়। কয়েক লাখ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়। এই আইনেই রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত শ্বেতহস্তী হিসেবে পরিগণিত হয়। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ১৫ থেকে ২৫ বছর মেয়াদী আরো বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করা হয়। এ প্রসঙ্গে ভারতের আদানির সঙ্গে চুক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করার জন্য তারই প্রিয়ভাজন আদানির কোম্পানি আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়, যা এক পেশে চুক্তির উদাহরণ হিসাবে পরিগণিত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কুখ্যাত দায়মুক্তি আইন বাতিলের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে লাগাতার দাবি জানানোর পরও লুটেরা সরকার তা বাতিল করেনি এবং এ আইনের আওতায় একের পর এক চুক্তি করেছে। আইনটি কার্যকর থাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করা যায়নি। মামলা ও বিচার করা সম্ভব হয়নি। আইনে বলা হয়েছে: ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা। প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন করা যাইবে না।’ এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে: ‘আইন বা তদ্বাধীন প্রণীত বিধি সাধারণ ও বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না।’
সরকারের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম ও কর্মপ্রক্রিয়া অনুসৃত হওয়া বিধেয়। কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা যেমন আবশ্যক, তেমনি যারা কাজ নির্বাহ করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আলোচ্য আইনে এসবই রহিত করা হয়। ফলে খাতটি অনিয়ম-দুর্নীতির অভয়ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৩ বছরে রেন্টাল ও আইপিপি খাতে সরকারকে কেবল ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের অতিঘনিষ্ট ১২টি কোম্পানিকেই দিতে হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক বা না হোক, সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় করুক বা না করুক বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে প্ল্যান্ট ভাড়া বারদ দিতে হয়েছে পূর্বনির্ধারিত বিশাল অংকের অর্থ। খবরে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ (কয়লাভিত্তিক) ক্রয়ের জন্য ২৫ সালা একটি চুক্তি সম্পাদন করা হয়। এই চুক্তির আওতায় আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে এক লাখ ১৭ হাজার ৫৮ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। কয়লাভিত্তিক অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের তুলনায় এটা ১৫ শতাংশ বেশি। আদানিকে কয়লার দাম পরিশোধ করতে হয়েছে প্রতিটন ৪০০ ডলার হিসাবে, বাজারে যার দাম ২০০ ডলারের নিচে। স্মরণ করা যেতে পারে, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মোদির আজ্ঞাবাহী আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ওদিকে ভারতের এক বিজেপি নেতা, বাংলাদেশে ভারতের পরিষেবা কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এর আগে গরু রফতানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত, যা শাপে বর হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। কখনো চাল, কখনো আলু-পেঁয়াজ কখনো বা অন্য কোনো পণ্য রফতানি কমিয়ে বা বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে জব্দ করতে গিয়ে শেষে ভারতই জব্দ হয়ে গেছে। এখন আর ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে আমাদের গরু আমদানি করতে হয় না। আলু-পেঁয়াজ বা অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা সামনে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের মানুষ যুৎসই জবাব দিতে মোটেই দেরি করে না বা করবে না। ইতোমধ্যেই দাবি উঠেছে, আদানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার। সরকারকে বিষয়টি আমলে নিতে হবে। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যে কোনো চুক্তি সংশাধন অথবা বাতিল করার অধিকার সরকারের আছে।
পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন বাতিল হওয়ার পর এ খাতে পরিকল্পিত ও নির্বিচার লুণ্ঠন বন্ধ হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। অবিলম্বে এমন ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সব রেন্টাল, কুইক রেন্টালের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা সম্ভবপর হয়। অন্যান্য বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে কোনো ত্রুটি ও অসমতা থাকলে তা সংশোধন করতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জ বা অন্য কোনো অন্যায্য চার্জ থাকলে তা বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। দায়মুক্তি আইন বাতিলের পর এখাতে এ যাবৎ অনিয়ম-দুর্নীতি যা কিছুই হয়েছে, তা বিচারের আওতায় আনার পথ খুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার পর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (ক্রিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের আমলে গণভবনের লোকজনকে নিয়ে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল।’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তারা সিন্ডিকেট করে লুটপাট করেছে। এটা ইতোমধ্যেই অনেকের জানা হয়ে গেছে, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। প্রকল্প খাতে লুটপাট হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকা। বিদেশে টাকা পাচারের তো হিসাব-নিকাশই নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও পিছিয়ে নেই। এখাতে অনুপুংখ তদন্ত হলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। আমরা এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ তদন্ত যেমন চাই, একই সাথে চাই যারা লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
১৬৫ রানের দিনে বাংলাদেশের আরেকটি ব্যাটিং ব্যর্থতা
‘দেশের হয়ে খেলার মত মানসিক অবস্থায় নেই সাকিব’
এমবাপে-বেলিংহ্যামের গোলে জিতে বার্সার আরও কাছে রিয়াল
লিভারপুলের বিপক্ষেও হার,টানা সাত ম্যাচ জয়হীন সিটি
বিবর্ণ এভারটনকে হেসেখেলেই হারাল ইউনাইটেড
সংস্কার থেকে নির্বাচন সবটাই সম্পন্ন করবো
মগবাজার রেলগেটে ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে প্রাইভেটকার
অস্থিতিশীল প্রসঙ্গে যা বললেন পান্না, নেটদুনিয়ায় সমালোচনা
সকল বিচারপতিকে নিয়ে বিশেষ সভা ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি
ফ্যাসিস্ট সরকারের দোষরদের বিরুদ্ধে তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ
চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ বাল্কহেড জব্দ, গ্রেপ্তার ৪
তারুণ্যের উৎসবে বিপিএলের ‘ডানা ৩৬’ উন্মোচন
খুলনায় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত
এ দেশ আমাদের, আমরা কোথাও পালিয়ে যাবো না: জামায়াত আমীর
ফেনী নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান, ৩৭টি মেশিন জব্দ
মির্জাগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
মৌলভীবাজারে গারোদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ওয়ানগালা উৎসব পালিত
রউফের রেকর্ডের দিনে পাকিস্তানের বিশাল জয়
নভেম্বরে রেমিট্যান্স এলো ২৬ হাজার কোটি টাকা, চার মাস ২ বিলিয়নের উপরে
ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়াই সত্যের সৌন্দর্য : তারেক রহমান