আয়নাঘর এক ভয়ংকর বন্দিশালা
০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
আয়নাঘর নামটি শুনে অনেকেরই চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে স্বচ্ছ কাচে ঘেরা সুন্দর পরিপাটি একটি কক্ষ বা ঘর। অথচ, বাস্তবতা বড়ই ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় এক চিত্র প্রকাশ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরোধীমত দমনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক নির্যাতন সেলের নাম আয়নাঘর। ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথম আয়নাঘর নামক শব্দটি পরিচিতি পায়। তবে তার অস্তিত্ব নিয়েছিল এক ধরনের ধোয়াশা বা বিভ্রান্তি। আওয়ামী লীগ সরকারের চোখে চরম শত্রু বলে বিবেচিত হতো যারা তাদের হয় খুন না হয় গুম করে রাখা হতো আয়নাঘরে। ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত এই আয়নাঘর প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুারো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্র। এতোদিন কিউবার অভ্যন্তরে মার্কিন সেনাদের গুয়ান্তানামো বে কারাগারের খবর কিংবা ইরাকে বেসামরিক ব্যক্তিদের জন্য আবু গারিব কারাগারের ভয়াবহ নির্যাতনের খবর বিশ^বাসী জেনে এসেছে। এখন সেটি পুরনো খবর। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে সারাদেশে আয়নাঘরের মতো নির্যাতন সেল তৈরি করেছিলেন।
যারা আয়নাঘরে বিভীষিকাময় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা এখন একে একে মুখ খুলে আয়নাঘরকে ব্যাপক পরিচিত করেছেন। জানা যায়, আয়নাঘরের মতো সারাদেশে ডিজিএফআই’র নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো বন্দিশালা ছিল। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আয়নাঘর নিয়ে মানুষের বিদ্যমান কৌতূহল খানিকটা মিটিয়েছেন। গুম বিষয়ে প্রাপ্ত সকল অভিযোগের তদন্ত এই কমিশন করবে। এজন্য সেপ্টেম্বর মাসেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন ২৫ সেপ্টেম্বর বহুল আলোচিত আয়নাঘর বা বন্দিশালা পরিদর্শন করে। এরপর তারা ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি’র নিয়ন্ত্রণে থাকা বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা আয়নাঘর সম্পর্কিত বেশকিছু বিষয় জনসন্মুখে তুলে ধরেন। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বহুল আলোচিত এই আয়নাঘর বা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল ডিজিএফআইয়ের কম্পাউন্ডে অবস্থিত। দোতলা বিশিষ্ট বিল্ডিংটির নিচতলায় ২০ থেকে ২২টা সেল আছে। উপরের তলায়ও কিছু কক্ষ আছে। এসব স্থানে সারাদেশ থেকে গুম করা মানুষদের বন্দি করে রাখা হতো। তিনি বলেন, গুম সংক্রান্ত অভিযোগ সবচেয়ে বেশি র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসি’র বিরুদ্ধে।
সারাদেশে গুম হওয়া মানুষের প্রকৃত সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব জানা না গেলেও মাত্র দুই সপ্তাহে কমিশনের চারশত অভিযোগ প্রাপ্তি প্রমাণ করে বিপুল সংখ্যক মানুষ গুম বা নিখোঁজ হয়েছেন। আয়নাঘরের ছোট ছোট ২০ থেকে ২২টি কুঠুরিতে গুম হওয়া মানুষদেরকে বন্দি করে রাখা হতো। তাদের সার্বক্ষণিক চোখ বন্ধ করে রাখা হতো। গুহার ভেতর দিন-রাতের কোনো পার্থক্য করা যেতো না। তাদের খাবার, ঘুম ও অন্যান্য কাজকর্ম সারতে হতো চোখ বাঁধা অবস্থায়। এখানে অন্য বন্দিদের কেউ কাউকে দেখতে পেতো না। দম বন্ধ করা মৃত্যুকূপে অনেকের বছরের পর বছর কেটেছে। কেউ কেউ সেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশে^র বিভিন্ন দেশে চরম স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারগণ বিরোধীমত দমনে নৃশংসতম পদ্ধতি প্রয়োগ করেও নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। শেখ হাসিনাও পারেননি। তাকেও ছাত্র-জনতা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। তার পতন ও পলায়নের পর সকল স্তরের মানুষের কাছে আয়নাঘরের ইতিহাস একটি চরম আলোচিত ও আগ্রহের বিষয়। যারা আয়নাঘরের বন্দিশালায় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদের দাবিকে সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছিল। সরকার পক্ষের কেউই এর অস্তিত্ব মানতে রাজি ছিল না। এখন নির্যাতিতদের অভিজ্ঞতা শুনে মিডিয়াগুলো আয়নাঘরের ওপর সত্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন তুলে ধরছে।
যদিও গুজবলীগের কারণে এখনো সাধারণ মানুষের মনে কিছুটা বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিতর্কিত ও ব্যর্থ করতে তারা হাজারো মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়াতে সদা ব্যস্ত। আওয়ামী লীগের গুজববাহিনী এখনো প্রচার করছে, আয়নাঘর বলে দেশে কোথাও কিছু ছিল না। এগুলো সবই ছাত্র-জনতার বানানো কাহিনী। হাসিনার বিরুদ্ধে এগুলো ইউনূস সরকারের এক ধরনের ষড়যন্ত্র। তাই এই ধরনের নির্যাতন সেল বা নাম না জানা আয়নাঘর সম্বন্ধে মানুষের কৌতূহল মেটানো জরুরি। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন আয়নাঘরের ধারণা কি শুধুই মিথ বা কল্পকাহিনী? বাস্তব কিছু নয়? যদিও আয়নাঘরে বন্দি থাকা নর্থসাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, জামায়াতের মরহুম আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আযমী, মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিস্টার আরমান ও ইউপিডিএফ-এর মুখপাত্র মাইকেল চাকমাসহ অনেকে দীর্ঘ বছর আয়নাঘরে বন্দিদশা থেকে বের হয়ে দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। তাদের পূর্বাপর আরো অনেকে আয়নাঘরের বিভৎস ইতিহাস জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন। আয়নাঘরের ইতিহাস এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক কোনো খবর নয়। এটি এখন মূলধারার সকল মিডিয়ার খবর। পত্র-পত্রিকাসহ অনেক চ্যানেলে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত সংবাদও প্রকাশ করেছে।
সুতরাং আয়নাঘরের অস্তিত্ব নাই বলে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের গুজবলীগের দাবি অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন সেই আয়নাঘর পরিদর্শন করে আরো বলেছে, আয়নাঘর সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করা হয়েছে। জানা যায়, বন্দিদের অনেকে দেয়ালে তাদের হস্তাক্ষর, নাম-ঠিকানা, বিভিন্নজনের কথা, ফোন নম্বর ইত্যাদি লিখেছিল। কিন্তু হাসিনার পতনের পর সেই দেয়ালে পেইন্ট করে সব কিছু মুছে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার তদন্ত রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করবে। সেখানে কমিশন নিশ্চয় আয়নাঘরের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থার সুষ্পষ্ট প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে। তদন্ত কমিশন তাদের মতো করে কাজ করুক। এর বাইরেও বর্তমান সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে ডিজিএফআই’র আয়নাঘরসদৃশ্য ডিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর গোপন নির্যাতন সেল বা সকল গোপন বন্দিশালার অবস্থান ও সেখানে সংঘটিত নৃশংস নির্যাতনের ইতিহাস মানুষ সঠিকভাবে দেখতে ও জানতে পারে। এজন্য এগুলোকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। তার আগে এই স্থানগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। নিরাপত্তায় রাখতে হবে। এর কোনো চিহ্নই মুছে ফেলা যাবে না। যেখানে যা যা আছে , যেভাবে আছে, ঠিক সেভাবে সংরক্ষণ করে সাধারণের দেখা ও জানার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। এগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেদনাদায়ক ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ভবিষ্যতে সাক্ষ্য বহন করবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সিলেটের টানা জয়ে উচ্ছ্বসিত স্বাগতিক দর্শকরা
সংবিধানে জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ থাকতে হবে - সারজিস আলম
মুরাদনগরে শীতার্ত মানুষের মাঝে পীরসাহেব চরমোনাই'র পক্ষ থেকে কম্বল বিতরণ
লিটনকে সেরা ছন্দে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরাতে চাই: প্রধান নির্বাচক
মাস্তুল ফাউন্ডেশন বিতরণ করলো ১ লক্ষ কেজি চাল
লক্ষ্মীপুরে রঙ-কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুখাদ্য, ২ ফ্যাক্টরি সিলগালা
সীমান্তে বিএসএফের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ
উৎসব মুখর পরিবেশে পালিত হলো জাবির ৫৪ তম দিবস
২ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ, কারখানা সিলগালা
কুষ্টিয়ায় স্কুল কমিটি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ, আহত ৩০
জুলাই বিপ্লবে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির চাকার পিষ্ট হয়ে নিহত মাহবুব আলমের পরিবারের পাশে তারেক রহমান
ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির ক্ষতি করতে পারবে না : আমিনুল হক
যায়যায়দিন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হলেন খুরশীদ আলম
বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড
ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫
চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না
ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ
পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১
ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন
ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ