ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

এভাবেও ফিরে আসা যায়

Daily Inqilab ড. মো. ফখরুল ইসলাম

১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম

হাতি স্থলজ প্রাণিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলেও একবার গভীর কাদার মধ্যে পড়ে গেলে তার নিজে থেকে উঠে দাঁড়ানো খুব কঠিন। বিশেষ করে, পালের গোদা বৃংগল যদি তেমন কোনো বিপদের সম্মুখীন হয় তাহলে খেঁকশিয়ালের দলও তাকে দ্রুত মেরে খেয়ে নেবার ফন্দি এঁটে ফেলে। বন্যপ্রাণির মধ্যে এই তৎপরতা হরদম লক্ষ্যণীয়। সভ্য মনুষ্য সমাজে রাজনীতির অমোঘ নীতির বেলায় অনেক ক্ষেত্রে একই ধরনের প্রবণতা কম। তবুও আধুনিক সভ্যতার দাবিদার কিছু মানুষ ক্ষমতা পেলে বন্যচরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। তারা ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে স্বগোত্রের অধিকার হরণ করে মত্ত হয়ে উঠে। তারা নিজেদের পরিণতির কথা ভুলে যাবার দিন থেকে আত্মপতনকে ত্বরান্বিত করতে শুরু করে। এ নিয়ে প্রকৃতির খেয়ালে কোনো বৈপরিত্য লক্ষ করা যায় না। তাইতো ইতিহাস নতুন করে লেখা শুরু হয়ে যায়।

কদিন আগে একটি বহুল আলোচিত বিষয়ে কিছু ছবি পোস্ট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক সহকর্মী লিখেছিলেন, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’। সেখানে বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে পাশাপাশি সোফায় বসে আছেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাস্যজ্জ্বল ছবি। পাশে আরেকটিতে পদ্মাসেতুর উপরে বসা দেশের আরেকজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাতে আঁকা কার্টুন। পদ্মাসেতুর নিচে অথৈ পানিতে পড়ে গিয়ে হাবুডুব খেতে থাকা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ড. মুহম্মদ ইউনূসের কার্টুন, যাদের ‘টুপ করে ব্রিজ থেকে পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়া’ হয়েছে- এমন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।

গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ছয় বছর অসুস্থতা ও রাজনৈতিক রোষাণলে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন থাকার পর সেদিন তিনি বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তাই এই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি দেখার জন্য টিভির পর্দায় অনেকের চোখ রাখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। তার উপস্থিতির সংবাদের ভিডিও টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সাথে কুশল বিনিময়ের দৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু মুখের কথা ভিডিওতে প্রকাশিত হয়নি। তবে তাদের দুজনের কথা বলার দৃশ্য দেখে টিভিদর্শকদের অনেক মন্তব্য করতে দেখা গেছে।

এক সহকর্মী লিখেছেন, ‘কেবলমাত্র বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ ও আপোসহীন ভালোবাসা বেগম খালেদা জিয়াকে এবং বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে একই ফ্রেমে, পাশাপাশি বসার সৌন্দর্যের উপলক্ষ এনে দেয়। পরিচ্ছন্ন-উচ্চতর ব্যক্তিত্ব,আকর্ষণীয় চারিত্রিক দৃঢ়তা, সুচিন্তা, সুবচন, সুকর্ম, নিষ্ঠা, সুপদক্ষেপ, আর সকলের প্রতি সুবিবেচনার অঙ্গীকার বড়সড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘এই দুজন মানুষকে যে পদ্মাসেতু থেকে টুস করে ফেলে দিতে চেয়েছিলো, সে নিজেই আজ পালিয়ে গেছে। ভাগ্য! আজ তারাই দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। খুবই সুন্দর মুহূর্ত, দেখে ভালো লাগছে।’ ক্ষমতা, জশ, সম্মান শুধু মাত্র আল্লাহর তরফ থেকেই আসে। যুগে যুগ ওরা চক্রান্ত করে, আর মহান আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন মহাকৌশলী।

মানুষের মনের ভেতর দুঃখ-কষ্ট, যাতনা অতিবেশী ঘনীভূত হয়ে বাসা বাঁধতে শুরু হলে কঠিন অসুখ দূরে থাক, যে কারো একটি সাধারণ অসুখও সেরে উঠতে চায় না। তখন সেই রোগীর জন্য ওষুধ, পথ্য কোনটিই ঠিকমতো কাজ করতে চায় না। মন থেকে অশান্তির মেঘ কেটে গেলে শরীর এমনিতেই চাঙ্গা হয়ে উঠার সুযোগ পায়। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি হয়তো তেমন কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। অনেকের কাছে সেখানে সশরীরে উপস্থিতি অনেকটা অকল্পনীয় ব্যাপার মনে হলেও মহান আল্লাহতা’য়ালা হচ্ছেন মহাপরিকল্পনাকারী। তাঁর ইচ্ছা কে খ-াতে পারে?

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেনাকুঞ্জের মতো জাতীয় এবং সামরিক-সম্পর্কিত স্থানে কোনো অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এটি রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করেছে।

সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সেদিনের অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এটি ছিল তার এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে অংশগ্রহণ। অনুষ্ঠানে তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি, তবুও তার উপস্থিতি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানো হয় এবং তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এটি ২০১৮ সালের পর প্রথম কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে তার প্রকাশ্য অংশগ্রহণ। একইসঙ্গে বিএনপির অন্যান্য শীর্ষ নেতাদেরও এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যা দলীয় রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনাটির রাজনৈতিক তাৎপর্য কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে। এর মাধ্যমে সকল শ্রেণির জনগণের সাথে তার রাজনৈতিক সম্পর্কের পুনঃস্থাপন সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। পাশাপাশি বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী ও বিএনপির মধ্যে দৃশ্যমান দূরত্ব ছিল। সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি এ সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ইঙ্গিত করে। এটি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান এবং সহযোগিতার বার্তা বহন করে।

সেনাকুঞ্জের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি তার জনপ্রিয়তা এবং ব্যক্তিগত অবস্থানকে জনগণের দৃষ্টিতে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। এটি রাজনৈতিক সমর্থকদের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করেছে, যা হয়তো অচিরেই বিএনপির মধ্যে ও দেশের মধ্যে আন্তঃদলীয় ঐক্য বাড়াতে সাহায্য করবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বা পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এটি সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে একটি সম্ভাব্য সমঝোতার বার্তাও দিতে পারে, যা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সহায়ক হতে পারে বলে মনে হয়। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিদিন যেসব অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ ও প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছে তার আশু নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশনেত্রী শুধু সেনাকুঞ্জেই নয়, দ্রুত পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে এভাবে তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অনুপ্রেরণা দান করুন আন্তরিকভাবে এটাই কাম্য।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান

শুধু নারীদের জন্য

শুধু নারীদের জন্য

নিথর দেহ

নিথর দেহ

আত্মহননে

আত্মহননে

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম