চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি

Daily Inqilab মো. সহিদুল ইসলাম সুমন

০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পেতে পারে। চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও নতুন ঋণের বিষয়ে দরকষাকষি করতে ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করেছে। সফর শেষে প্রতিনিধিদলটি জানায়, চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড়ে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে রাজস্ব আয় বাড়ানো সংক্রান্ত একটি কমিশন গঠনসহ কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আগামী পাঁচ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ সভায় চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদিত হলে তার দিন পাঁচেক পরে, অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি তা ছাড় করা হবে।

এমনিতেই আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) গত তিন কিস্তির ঋণের কিছু শর্ত বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঋণের সুদহার বাড়ানো, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করা, ডলারের দাম বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ ইত্যাদিতে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। সব মিলে উদ্যোক্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তারা ইতোমধ্যে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের বিপক্ষে কথা বলেছেন। আইএমএফ ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় করার আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছে। তারা আগের শর্ত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু নতুন শর্ত আরোপ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আগে বছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বাড়ত ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। এখন বাড়ছে ৯ শতাংশের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ কমায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে দশমিক ৯১ শতাংশ। বিনিয়োগ কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। ২০২২ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকেই এ অস্থিরতা চলছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ তলানিতে পড়েছে। আগে ঋণের সুদ ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ।এছাড়া অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে উদ্যোক্তাদের চাহিদা অণুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এতে ঋণের গতি কমেছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বেসরকারি খাতে যেভাবে ঋণের প্রবাহ কমছে তা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

উদ্যোক্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো ও ঋণের সুদহার বাড়ানো হলেও এর কোনো সুফল মেলেনি। মূল্যস্ফীতি কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এখন তা বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ওঠেছে। মূল্যস্ফীতির হার কমানোর নেওয়া উদ্যোগেও কমেনি।

আইএমএফের শর্তে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমছে। কিন্তু দাম বাড়ার কারণে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে সেগুলোর দাম বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। বিশেষ করে, গণপরিবহণ ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত পরিবহণের ভাড়া কমছে না। এতে ব্যবসায়ীদের হিসাব-নিকাশে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি দাম কমানোর সুফল পাওয়া থেকে ভোক্তারাও বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, জ্বালানি উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করলে আমাদের বাজার এটি নিতে পারে না। কারণ, এখানে সে অবকাঠামো নেই। এটি করতে হলে আগে অবকাঠামো করতে হবে। নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সেটি নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সচেতন করতে হবে। তারপর এটি কার্যকর করলে সুফল মিলবে।

আইএমএফ ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছে। এটি করলে ডলারের দাম উঠানামা করবে। তখন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি সমস্যায় পড়বেন। কারণ, এখন ডলারের দাম একটি সীমার মধ্যে থেকে উঠানামা করে। বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে আর সীমা থাকবে না। তখন জুয়া খেলার মতো হয়ে যাবে ডলার বাজার। অসাধু চক্র ডলার মজুত করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এতে বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জিং হবে।

আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকমানের করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের শেষ দিন থেকে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে তা খেলাপি হবে। উদ্যোক্তারা বলেছেন, এ নীতি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। কারণ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে উদ্যোক্তাদের সময় লাগছে। কারণ, রপ্তানি করলে তিন মাসের মধ্যে ডলার দেশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আমদানি করলেও তা বিক্রি করে তিন মাসের মধ্যে ঋণ শোধ সম্ভব হয় না। ফলে নতুন নীতিমালার ফলে অনেক উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়বে। ফলে ব্যবসার গতি কমে যাবে। উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, সরকারি নীতি এখনও ব্যবসাবান্ধব হয়ে ওঠেনি। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায়ই ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়। আইএমএফ-এর এবারের মিশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় খেলাপি ঋণের বিষয়ে আরও একটি নতুন শর্ত দিয়েছে। বলেছে, কোনো খেলাপি ঋণ নবায়নের পর সঙ্গে সঙ্গে তা খেলাপি মুক্ত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়নের পর কমপক্ষে তিন মাস পর তাকে খেলাপি মুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অচিরেই প্রজ্ঞাপন জারি করতে অনুরোধ করেছে। ওই তিন মাস ঋণটিকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

এ ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম বাংলাদেশে এখনই প্রয়োগ করলে ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়বে। কারণ, ঋণ পরিশোধ করার পরও খেলাপি মুক্ত না করলে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা আটকে যাবে। তখন ঋণ নবায়নের অনেকেই নিরুৎসাহিত হবেন। তখন আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নিজেকে খেলাপি মুক্ত করার চেষ্টা করবেন, যা ঋণ আদায়কে বাধাগ্রস্ত করবে। সর্বোপরি, আইএমএফের এই শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি অনেক গুণ বেড়ে গেছে, মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। উন্নত বিশ্বের শর্তাবলী বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশে বাস্তবায়ন করতে গেলে মানুষের কষ্ট দিন দিন বেড়েই যাবে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। তাছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না তাতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন
মানব পাচার রোধ করতে হবে
মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত
বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
ছাত্র সংসদ এখন সময়ের দাবি
আরও

আরও পড়ুন

অবৈধভাবে’ চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ

অবৈধভাবে’ চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ

টেকনাফের গভীর অরণ্যে এক বন্য হাতির বাচ্চা প্রসবের সময় মা হাতির মৃত্যু, শাবক উদ্ধার

টেকনাফের গভীর অরণ্যে এক বন্য হাতির বাচ্চা প্রসবের সময় মা হাতির মৃত্যু, শাবক উদ্ধার

ইলিয়াসের লাইভ টকশোতে ১৫ই আগস্ট সম্পর্কে যা বললেন মেজর ডালিম বীর বিক্রম

ইলিয়াসের লাইভ টকশোতে ১৫ই আগস্ট সম্পর্কে যা বললেন মেজর ডালিম বীর বিক্রম

ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়েছে কি?

ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়েছে কি?

গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসানের ওপর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ

গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসানের ওপর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ

স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাক্ষাৎ, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা খালেদা জিয়ার

স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাক্ষাৎ, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা খালেদা জিয়ার

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের আলোচনা,  যা বললেন মির্জা ফখরুল

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের আলোচনা, যা বললেন মির্জা ফখরুল

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাবেক সিইসি আবদুর রউফ

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাবেক সিইসি আবদুর রউফ

এটি আসলে একটি ভিন্ন জগৎ, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ : ড. ইউনূস

এটি আসলে একটি ভিন্ন জগৎ, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ : ড. ইউনূস

অবৈধভাবে’ চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ

অবৈধভাবে’ চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের কমিটি ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ

৭ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

৭ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

সংষ্কারের নামে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে এদেশের মানুষ কোন ভাবেই মেনে নিবেনা : আমিনুল হক

সংষ্কারের নামে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে এদেশের মানুষ কোন ভাবেই মেনে নিবেনা : আমিনুল হক

কবরে লুকানো ছিল অস্ত্র, আটক ১

কবরে লুকানো ছিল অস্ত্র, আটক ১

লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জে পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনতাই মামলার আসামি গ্রেপ্তার

লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জে পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনতাই মামলার আসামি গ্রেপ্তার

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল রোজার আবেগঘন স্ট্যাটাস

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল রোজার আবেগঘন স্ট্যাটাস

ভারতে নয় জজদের প্রশিক্ষণের জন্য বিজ্ঞ মুফতিদের কাছে পাঠান

ভারতে নয় জজদের প্রশিক্ষণের জন্য বিজ্ঞ মুফতিদের কাছে পাঠান

এক্সিকিউটিভ স্টাডি অ্যাব্রোডের আয়োজনে অস্ট্রেলিয়ান এডুকেশন এক্সপো অনুষ্ঠিত

এক্সিকিউটিভ স্টাডি অ্যাব্রোডের আয়োজনে অস্ট্রেলিয়ান এডুকেশন এক্সপো অনুষ্ঠিত

আড়ানী পৌরসভায় গণ-অভ্যুত্থানের ছবির উপর জয় বাংলা স্লোগান- ছাত্রজনতাসহ সকলের নিন্দা ও ক্ষোভ

আড়ানী পৌরসভায় গণ-অভ্যুত্থানের ছবির উপর জয় বাংলা স্লোগান- ছাত্রজনতাসহ সকলের নিন্দা ও ক্ষোভ

এবারের আন্দোলনের ঘোষক ও রূপকার তারেক রহমান : আজাদ

এবারের আন্দোলনের ঘোষক ও রূপকার তারেক রহমান : আজাদ

নালিতাবাড়ীতে গর্তে পড়ে শিশুর মৃত্যু

নালিতাবাড়ীতে গর্তে পড়ে শিশুর মৃত্যু