ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহই সময়ের দাবি
২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকরের খিলাফত, হযরত ওমরের খিলাফত ও হযরত ওসমানের খিলাফতের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রে যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করছিলো, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনাই নাই। ত্রিশ হিজরি পর্যন্ত মুসলমানরা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি অধিকার করে এমন এক আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপন করতে সমথ্র্ হয়েছিলো যে, পৃথিবীর অন্য অঞ্চলগুলির অস্তিত্ব তার কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিলো। তখনকার দিনে মুসলমানরা ইচ্ছা করলে সারা পৃথিবী জয় করে নিতে পারত। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের নীতি ইসলামি আদর্শের অনুকূলে নয় বলে সে কাজ থেকে তারা বিরত ছিলো। দিন দিন মুসলমানদের চরম উন্নতি দেখে অমুসলমানদের একটি বিশিষ্ট দল জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলো। তারা দেখল শক্তি পরীক্ষায় ইসলামকে পরাস্ত করা যাবে না। তাই ইসলামকে বিপন্ন করা আর মুসলমান শক্তিকে প্রতিহত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তারা মুসলমান হতে লাগলো। ইসলাম ধর্মে শ্রেণি সংগ্রাম নেই, কৌলিন্যের অভিমান নেই, বংশীয় ও গোত্রীয় প্রাধান্য নেই। ইসলামে আছে ভেদহীন ও শ্রেণিহীন ভাতৃত্ব। ভ্রাতৃত্বের এই প্রাণস্পর্শী চেতনাই হচ্ছে জাতির প্রাণশক্তি। ইবাদাত ও জাতীয়তার এই অপূর্ব একত্ব যা ইসলামে তাওহীদ নামে কথিত।
শত্রুরা বাইরে থেকে ইসলামের দুর্ভেদ্য দুর্গে আঘাত হানতে অপারগ হয়ে তার ভিতরে প্রবেশ করতে আরম্ভ করলো। আর মুসলিম সংহতিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে লাগলো। এই ষড়যন্ত্রকারীদের লিডার ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা। সে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বনু হাশেম ও বনু উমাইয়াদের মধ্যে যে শত্রুতা ছিলো তাকে ঝালিয়ে তুলতে লাগলো। রসুলের বংশধরদের শ্রেষ্ঠত্ব, হযরত আলীর নবুয়াত প্রভৃতি সম্পর্কে মদিনা, কুফা, বসরা, দামেস্কো ও কায়রো শহরগুলিতে জোর প্রচারণা চালাতে লাগলো। আর খুব সাবধানতার সাথে হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। সাহাবাগণ ইসলামের মৌলিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলে ইবনে সাবা মদিনায় বিশেষ কোন সুবিধা করতে না পেরে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যান্য নগরে গমন করলো এবং অনেক স্থানে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সফল হলো। কিন্তু মুসলমানরা বুঝলো না নওমুসলিম ইবনে সাবার ষড়যন্ত্রের কথা। তারা সংহতিকে নষ্ট করে বিদ্রোহী সেজে ইবনে সাবার নেতৃত্বে পঁয়ত্রিশ হিজরিতে ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থল মদিনায় চড়াও হলো। আর আমিরুল মুমিনিন হযরত ওসমানকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করলো। ভিতরে ভিতরে এই ষড়যন্ত্রে ও হত্যাকা-ে মদিনারও কিছু সংখ্যক মুসলমান শরিক ছিলো। মুসলমানরা হযরত ওসমানকে যেদিন হত্যা করলো সেদিন তিনি বাড়িতে বসে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। পবিত্র কুরআন এর উপর তাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়।
হযরত ওসমানের এই হত্যাকা-ে মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের দরজা প্রকাশ্যভাবে খুলে গেলো। এই হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে উষ্ট্রের যুদ্ধ, হযরত আলী এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধ, মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদের সাথে ইমাম হোসেনের কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মারওয়ানের সময় নোমান বিন বশিরের সাথে মারজে রাহিতের যুদ্ধ, খলিফা আব্দুল মালিকের শাসনামলে মুসাব ও তার ভাই আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের বিদ্রোহ ও কাবা শরীফকে ঘেরাও করার কা-, হিশামের সময় জায়েদ বিন আলির বিদ্রোহ, মারওয়ানের শাসনামলে আবু মুসলিম খোরাসানীর বিদ্রোহ, মুনসুর আব্বাসির খিলাফতে মদিনায় মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসামের আর বসরায় তার ভাইয়ের বিদ্রোহ প্রভৃতি মুসলমানদের এই গৃহ বিবাদগুলি জাতিকে চরম পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
এই যে মুসলমানদের মধ্যে নানান দল, মত, গৃহবিবাদ এসবের মূল যদি অনুসন্ধান করা যায় তাহলে দেখা যাবে, একজন প্রতিভাবান ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এক একটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। এই পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে- সব দলের মূলে আছেন একজন করে রাজনৈতিক লিডার। ধর্মের নামেও যত দল তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে এসবের মূলেও আছেন একজন করে ধর্মীয় নেতা। ধর্মীয় নেতারা কোরআন ও হাদিসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রঙে নিজেদের মতবাদ প্রচার করেছেন বলেই এত ধর্মীয় দল তৈরি হয়েছে। সর্বপ্রথম মাযহাবি দলাদলির সৃষ্টি হয় মহামতি ইমাম চতুষ্টয়কে কেন্দ্র করে। কারণ কোনো ইমামই প্রিয় নবীর ২৩ বছরের সামগ্রিক হাদিস সংগ্রহ করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের কিয়াসের আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। যিনি যত কম হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন তাকে তত বেশি কিয়াস করতে হয়েছিলো। অবশ্য প্রত্যেক ইমাম বলে গেছেন, এমন এক সময় আসবে যখন তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সামগ্রিক হাদিস চোখের সামনে দেখতে পাবে। তখন আমাদের এই কিয়াসগুলোকে আল্লাহর নবীর হাদিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখো। যদি মিলে যায় উত্তম, আর যদি না মিলে তাহলে আমাদের অভিমত বাদ দিয়ে আল্লাহর নবীর সিদ্ধান্তকেই গ্রহণ করবে। কিন্তু পরবর্তী যুগে তা আর হলো না।
প্রিয় নবীর সামগ্রিক হাদিস পাওয়া সত্ত্বেও কুরআন ও হাদিসের কষ্টি পাথরের কিয়াসী মাসলাগুলোকে পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থাই অবলম্বিত হলো না। ইমামগণের তিরোধানের পর তাদের ছাত্ররা যখন বিরাট বিরাট আকারে পৃথক পৃথকভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন দেখা গেলো অতি ভক্তির আতিশয্যে তারা আপন আপন ওস্তাদের সিদ্ধান্তগুলোকে সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে আলেম তৈরীর কারখানা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো এবং পরে ইমামগণের নাম অনুযায়ী এক একটা দলের নামকরণ করে নেয়া হলো। যেমন ইমাম হানাফীর নামানুসারে হানাফী মাজহাব, ইমাম শাফিয়ীর নামানুসারে শাফিয়ী মাজহাব, ইমাম মালিকীর নামানুসারে মালিকী মাজহাব ইত্যাদি। কিন্তু একটি প্রশ্ন, যে সকল ইমামদের নাম অনুযায়ী এক একটি দলের নামকরণ করে নেয়া হলো, এই সব মহামতি ইমামদের জন্মের আগে মুসলমান ছিলেন কিনা? যদি থেকে থাকেন তাহলে তারা কোন দল ভুক্ত ছিলেন? আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারব যে, মহামতি ইমামগণের পূর্বের হাজার হাজার সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকে কুরআন ও হাদিসপন্থী মুসলমান ছিলেন।
যাহোক, দল চতুষ্টয়কে কেন্দ্র করে অন্ধভক্তির অতিশয্যে ধর্মের নামে পরবর্তী যুগে শত শত দলের সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসবের মূলে যে শিক্ষার অভাব তা নয়। আল্লাহর মর্জি চক্রবৃদ্ধি হারে শিক্ষিতের হার আমাদের মধ্যে বেড়েই চলেছে। কত জ্ঞানী, গুণী, হাফেজ, কারী, মৌলভী, মাওলানা, মুন্সি, মুফতি, ইমাম, খতিব, ফকীহ, বক্তা হাদীয়ে জামান, মুজাদ্দেদে মিল্লাত, মুফতিয়ে আজম, শামসুল উলামা, পীরে কামেল যে আমাদের মাঝে আছেন, তার ইয়ত্তা নাই। এসবের পরেও দলের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তার একমাত্র কারণ শিক্ষিত ব্যক্তি বা অন্ধভক্তির অতিশয্যে এক একটি করে দলের ওকালতি করছে। ফলে পরস্পারের মধ্যে পরস্পরের ভ্রাতৃভাব মোটেই গড়ে উঠতে পারছে না। আমাদের দেশের বহু গণ্যমান্য আলেমকে দেখা যায়, সারা জীবন তারা অন্য দলের বিরুদ্ধে বই-পুস্তক লিখে শক্তি ক্ষয় করে গেছেন। কোন দলের হাফেজের পিছনে নামাজ হবে না, কোন দলের মুহাদ্দিসের কাছে হাদিস পড়া হারাম, কোন দলের আকিদা গ্রহণযোগ্য নয়, কোন দলের মাওলানার সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়া চলবে না, কোন দলের দাওয়াত নেওয়া নাজায়েয, কার দাঁড়ি কতটুকু লম্বা ইত্যাদি বিষয় নিয়েই তাদের মাথা ব্যথা বেশি। পর্যবেক্ষকদের মতে, আলেমগণ যদি মাযহাবি ঝগড়া বাদ দিয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মৌলিক নীতিতে এক হয়ে সংহতিকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের পা-িত্যকে যদি কাজে লাগাতেন, তাহলে শতধা বিচ্ছিন্ন এই মুসলমান জাতির মধ্যে সংহতি ফিরে আসতো। আল্লামা ইকবাল বলেছেন, এক মুসলমান জাতির লাভও এক, লোকসানও এক। সকলের নবী এক, সকলের ধর্ম এক, একই ঈমান, এক কাবা, এক আল্লাহ, এক কুরআন সকলের, সুতরাং মুসলমান যদি এক হতে পারতো, তবে সেটা কি বড় কথা হতো না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নাইজেরিয়ায় নিহত ১৮
আবু তাহের মিয়ার মৃত্যুতে শোক ও দোয়া মাহফিল
চীন জুলাই-আগস্টে আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জাম দেবে
সনাতন ধর্মই ভারতের জাতীয় ধর্ম : যোগী আদিত্যনাথ
হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজার চেকপয়েন্টে অপেক্ষমাণ: জাতিসংঘ
মধ্যরাতে তোপের মুখে হাসনাত আবদুল্লাহ
মধ্যরাত থেকে সারা দেশে বন্ধ হতে পারে ট্রেন চলাচল
দূষণের শীর্ষে ঢাকার বাতাস আজ ‘দুর্যোগপূর্ণ’, দ্বিতীয় স্থানে লাহোর
সংঘর্ষের পর এবার ঢাকা অবরোধের ঘোষণা ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের
গাজার উত্তরে ফেরার অনুমতি দিল ইসরায়েল, লেবাননে যুদ্ধবিরতি বাড়ল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
শিক্ষার্থীদের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় যা বললেন ঢাবি উপাচার্য
ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি করা সেই এসআই গ্রেফতার
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৪৭ হাজার ৩০০
মঞ্চে আসছে সুফিবাদী নাটক 'পাখিদের বিধানসভা; কেমন চলছে পাখিদের শেষ সময়ের প্রস্তুতি?
ভ্যালেন্সিয়াকে গোলবন্যায় ভাসালো বার্সা
বিবর্ণতা কাটিয়ে ইউনাইটেডের স্বস্তির জয়
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গ্রেফতার
রোনালদোর গোলে আল নাসেরের সহজ জয়
মৌলভীবাজার সীমান্তে বাংলাদেশীকে কুপিয়ে হত্যা করল ভারতীয়রা
আজ চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করবেন মির্জা ফখরুল